কিউএস র্যাঙ্কিংয়ে আমাদের অবস্থান এবং প্রাসঙ্গিক কথা
১৭ জুন ২০২২ ১৭:২১
কিউএস র্যাঙ্ককিংয়ের সেরা ৮০০ তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়। যুক্তারাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে যেখানে ৮০১ থেকে ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। একাডেমিক খ্যাতি ,চাকরির বাজারে সুনাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষক প্রতি উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাতের ভিত্তিতে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং করে প্রতিষ্ঠানটি।
২০১২ সালে কিউএস র্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০১তম। এরপ ২০১৪, ২০১৯ সালের র্যাঙ্কিংয়ে আর পেছনে যায়। জানা যায়, এ বছর প্রতিবেশী দেশ ভারতের ৯টি প্রতিষ্ঠান বিশ্বের সেরা ৪০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে। এছাড়াও পাকিস্তানের ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেরা ৫০০ এর তালিকায়। এই তালিকা থেকে দেখা যায় যেসব দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় এই তালিকায় নেই তাদের অনেক দেশের সাথেই আমাদের দেশের কয়েকটি বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে। তারা অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের দেশের চেয়ে দুর্বল। অথচ আমরা জানি বাংলাদেশ শিক্ষা ক্ষেত্রেও এগিয়ে যাচ্ছে। অন্তত দেশে আজ অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অসংখ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকলেও অন্তত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে মানুষের ধারণা আজও বেশ স্বচ্ছ। প্রতি বছর এইচএসসি পরীক্ষার পর ছাত্রছাত্রীদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিযোগীতা দেখে সেটা অনুমান করা যায়। একটি আসনের বিপরীতে কত অসংখ্য ছাত্রছাত্রী অংশ নেয়। তালিকায় আমাদের দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় থাকুক আর না থাকুক তাতে খুব বেশি কিছু যায় আসে না কিন্তু অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। কেন এতগুলো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আমাদের দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থাকে না। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তাহলে কি কোন গলদ রয়ে গেছে। থাকলে সেটা কোথায়। তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। তার আগে শিক্ষা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। সবচেয়ে বড় কথা যে, সবক্ষেত্রে যদি আমরা অন্য দেশকে ছাড়িয়ে যাই তাহলে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকাটা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। বরং এই ক্ষেত্রে আমাদের কোথায় ঘাটতি রয়েছে তা নিয়ে গবেষণা করা দরকার। এবং যে জায়গায় ঘাটতি রয়েছে তা পূরণে উদ্যোগ নিতে হবে।
শিক্ষা মানুষের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত শক্তি জাগ্রত করার কাজ করলে বাস্তবিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না। শিক্ষা তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সফল হচ্ছে না। প্রয়োগের উদ্দেশ্য এবং ধরণেই এমনটা হচ্ছে বলাই যায়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের আজকের শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল চাকরি পাওয়া। একটা সার্টিফিকেট আর চাকরি তারপর জীবনে আর কোন দুঃশ্চিন্তা থাকে না। আমাদের দেশে চলে আসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বহুবার ঘষামাজা করা হয়েছে। কখনো কোন বিষয় বাতিল করা হয়েছে আবার প্রয়োজনের খাতিরে কোন বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল ব্রিটিশরা। মূলত ব্রিটিশদের তৈরি করা শিক্ষা ব্যবস্থাতেই কিছুটা পরিবর্তন করে আজও আমাদের দেশে চলছে। ইংরেজ সাহেবদের সেই ইচ্ছার প্রতিফলন আজও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখতে পাই। আমাদের পোশাকে, আমাদের চালচলনে আমরা সর্বদাই সেই সাহেবদের অনুসরণ করার করি। নিজেদের সংস্কৃতিকে গুলিয়ে আমরা পর সংস্কৃতির শিক্ষাই লাভ করতে শিখেছি।
পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে দেশে রীতিমত যুদ্ধ হয়। যদিও চলতি বছরেই পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এতদিন যা নিয়ে যুদ্ধ হতো সেটা হলো জিপিএ ফাইভ নিয়ে। এটা রীতিমত দেশের অভিভাবকদের কাছে মানসম্মানের ব্যাপার। সন্তান যদি জিপিএ ফাইভ না পায় তাহলে পাড়া মহল্লাাসুদ্ধ মানুষ গালমন্দ করতে থাকে। এমনকি নিজের মা বাবার মুখটাও সারাক্ষণ কালো হয়ে থাকে। কয়েক বছর ধরে মানে জিপিএ প্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই এ রকম একটা ব্যাপার চোখে পরছে। আমাদের সময়কালে জিপিএ ছিল না ছিল ডিভিশন। সেখানে এখনকার মত গ্রেড পয়েন্ট ছিল না তবে স্টার মার্কস, লেটার মার্কস,বোর্ড স্ট্যান্ড এসব বড় বড় সব স্থান ছিল। এখন সেসব নেই। যুগের পরিবর্তনের সাথে সবকিছু পরিবর্তন হয়। এটাও না হয় হয়েছে। কিন্তু তাই বলে জিপিএ বিক্রি হবে এটা মেনে নেওয়া যায় না।
সর্বোচ্চ ফলাফল যদি কেনা সম্ভব হয় তাহলে সেখানে শিক্ষার মান বলে কিছুই থাকে না। অবশ্য আমাদের দেশে অনেক জিনিসই কিনতে পাওয়া যায়। সার্টিফিকেট কেনা বেচা তো হয়ই। রেজাল্ট, সার্টিফিকেট এমনকি মনুষত্ব পর্যন্ত বিক্রি হয়ে যায় এদেশে। মনুষ্যত্ব বিক্রি করে দিব্বি চোখ বুঁজে চাকরি করে যাচ্ছে সারাজীবন। প্রশ্ন ফাঁস করে যারা এতকাল ভালো রেজাল্ট করেছে তারা তো বহাল তবিয়তে দেশের বড় আদৌ দেশের উন্নয়ন চায় বলে মনে হয় না। একবার ভেবে দেখলে গা শিউরে ওঠে যে আজ পর্যন্ত কত ছাত্রছাত্রী প্রশ্ন ফাঁস করে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে, কত ছাত্রছাত্রী জিপিএ ফাইভ কিনে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে তাদের সে সংখ্যা কত। এ তো গেল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথা। এরপর চাকরির বাজারে এসেও নানা কারসাজি হয়। এখানেও প্রশ্ন ফাঁসের গোলমাল আছে, আছে টাকা এবং লোকবল খাটিয়ে পরীক্ষার হলেই ম্যানেজ করার কারসাজি।
অথচ সক্রেটিস এরিষ্টোটল, প্লেটোর হাত ধরে যে শুদ্ধ শিক্ষার ইতিহাস বয়ে চলেছে তার বিপরীত ব্যবহারের ফল যে আমাদের এমন বেহাল দশা করে ছাড়বে তা কে জানতো। যে শিক্ষা মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে না তার কোন প্রয়োজন নেই। আজকাল যেন সেই মূল লক্ষ কেবল সার্টিফিকেট। সেটা লেখাপড়া করে হোক বা টাকা দিয়ে কিনে হোক কার্যসিদ্ধি হলেই হলো। কোনমতে একটা সার্টিফিকেট পেলেই সব শেষ। তারপর এদিক সেদিক ধরাধরি করে একটা চাকরি বাগিয়ে সমাজে দিব্যি মেধাবী সেজে ঘুরে বেড়ানো যায়।
আজ কেন্দ্রের সামনে লেখা থাকে নকলমুক্ত পরীক্ষা কেন্দ্র। যেখানে প্রশ্নপদ্ধতিই সৃজনশীল তবে নকলের কথা আসছে কেন। নকল তো সেই মুখস্থের যুগে। তবে শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় কেন? করলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। বরং অন্য কোন বিষয়ে তার আগ্রহ আছে ধরে নিতে হবে। কোন নির্দিষ্ট পরীক্ষায় ফেল বা কম মার্ক পেলেই জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। জীবনের সাফল্য ব্যর্থতা নির্ভর করে মনুষ্যত্ব অর্জনে।
শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মারাত্বক ক্ষতির। শিক্ষা যদি কোন ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে তুলতে না পারে তাহলে ধরে নিতে হবে সেই শিক্ষা কেবল বিষ ঢেলেছে অমৃত নয়। আজ যারা বড় বড় পদে থেকেও বড় বড় চুরি করছে তারাও তো শিক্ষিত। তাহলে এই অন্যায় তারা করছে কিভাবে। এটা সম্ভব হচ্ছে কারণ তারা শিক্ষা অর্জন করলেও তা সার্টিফিকেট অর্জনের মধ্যেই সিমাবদ্ধ রয়ে গেছে। আর তাই শিক্ষা বিষয়টা আজ এতটা প্রশ্নবিদ্ধ। র্যাংকিংয়ে নাম না থাকায় আমাদের দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেশের তুখোড় মেধাবী সন্তানরা লেখাপড়া করতে যাচ্ছে সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সমান মান বজায় রেখে এগিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক:শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক
[email protected]
সারাবাংলা/এজেডএস