আপনাদের প্রমোদভ্রমণের জেলাটি কাঁদছে
২০ জুন ২০২২ ১৩:২৩
কক্সবাজারে তখনও এত হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেনি। নাম জানতাম সৈকতের। ফোর্থ ইয়ারে হাইজিন ট্যুরে গিয়ে সবাই এখানে উঠেছিলাম। ভাগ্য ভালো হলে সার্কিট হাউসে একটা রুম মিলতো। সিভিল সার্জন অফিসের দোতলায় কয়েকটা রুম হলো। বেশিরভাগ সময়ে ঢাকার বড়কর্তাদের দখলে থাকতো। অনেক তদবির করে এখানে একবার উঠেছিলাম। ২০০৩ সালে কক্সবাজার ও বান্দরবানে প্রথম যাই ক্যান্সার সচেতনতার কর্মসূচী নিয়ে। ২০০৬ থেকে প্রায় প্রতিবছর যাওয়া হয় এই দুই জেলায়। এখন আর আবাসন সমস্যা হয় না। অসংখ্য হোটেল- মোটেল-কটেজ গড়ে উঠেছে। হালের ফ্যাশন হলো, স্বাস্থ্যবিভাগসহ সরকারী নানা প্রশিক্ষণ, পরামর্শ সভা হয় কক্সবাজারে। সারাদেশ থেকে অংশগ্রহণকারীরা যোগ দেন। ঢাকা থেকে প্রশিক্ষক ও বড় কর্মকর্তারা আসেন। বাজেট নিশ্চয়ই বেড়ে যায়। তা হোক। পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়ানোটা হয়। মনে প্রফুল্লতা আসে। এরপর উৎপাদনশীলতা নিশ্চয়ই বাড়ে! আজকাল পেশাগত সংগঠনগুলোর সাধারণ সভা ও সম্মেলন আয়োজনের পছন্দের ভেন্যু এই কক্সবাজার।
তো সেই যুগে কক্সবাজারে থাকার জায়গা জোগাড় করতে ফোন করতাম খায়রুল বাশার সাহেবকে। তিনি চাঁটগায়ের লোক। বিভাগীয় স্বাস্থ্যশিক্ষা কর্মকর্তা হওয়ায় জেলা স্বাস্থ্যশিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বুকিং দিয়ে রাখতেন। এভাবেই পরিচয় উচা প্রু’র সাথে। খুব দক্ষ ও আন্তরিক একজন তরুণ কর্মকর্তা। সব জায়গায় আমার সাথে থাকতেন বাশার সাহেব। দাপ্তরিক দায়িত্বের বাইরে সামাজিক কর্মকান্ডে তার একাগ্রতা প্রশংসনীয়।
এখন স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরে পরিচালকের দায়িত্বে থাকা ডা. মিসবাহর বাড়ি কক্সবাজারে। ডা. মিসবাহ, উচা-প্রু, এদের খুব ভাগ্যবান মনে করতাম। কত প্ল্যান- প্রোগ্রাম করে, কত দূর থেকে টাকা-পয়সা খরচ করে আমরা কক্সবাজার যাই। আর ওরা জন্ম থেকেই আছে এই শহরে!
সব আনন্দ সবসময় একরকম থাকে না কারও। সাইক্লোন, টর্নেডো যখন উপকূলে আঘাত হানে, কত প্রাণ এবং সম্পদ হারিয়ে যায় তার ধাক্কায়। স্বপ্নের শহর কক্সবাজারের ভাগ্যবান মানুষরাও তখন অসহায় হয়ে যায় প্রকৃতির রুদ্ররূপের কাছে। বছরে একবার আমরা যারা প্রমোদভ্রমণে গিয়ে ভাগ্যবান মানুষদের খোঁজখবরের চেষ্টা করি, দুর্যোগের দিনে তাদের খবর নেই কয়জনে?
পূন্যভূমি শহর সিলেট। হজরত শাহজালাল আর শাহ পরানের মাজার জেয়ারতের আকর্ষণ দূরদরান্তের মানুষের। সিলেট যাবো, অথচ এক ওয়াক্ত নামাজ পড়বো না মাজার সংলগ্ন মসজিদে! মাজার জেয়ারত করে পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির জন্য দোয়া করতে ভুলেন না অনেকেই। সিলেট শহর শুধু নয়, পুরো সিলেট বিভাগজুড়ে অনেকগুলো জায়গা আছে, ভ্রমণবিলাসীদের পছন্দের তালিকায়। পাহাড়, ঝর্ণা আর সবুজের মাখামাখি একটা জেলা।
কতবার যে সিলেট গিয়েছি। নির্ভেজাল ভ্রমণের ভাগ্য তেমন হয়নি। ক্যান্সার সচেতনতার ফাঁকে ফোকরে, ঝটিকা সফর। তারপরও মনে দাগ কেটে আছে। তামাবিল, জাফলং, মাধবকুন্ড, লালাখাল, রাতারগুল, লাউয়াছড়া, বিছানাকান্দি, ভোলাগঞ্জ, টিলাগড়। একটু এডভেঞ্চার প্রিয়দের জন্য হাওর। শনির হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকির হাওর। অবস্থাপন্নদের অবকাশের জন্য হাল আমলের প্যালেস, গ্রান্ড সুলতান। নাজিমগড় টি-রিসোর্ট।
একবার ডা. শাহরিয়ার ভাইয়ের আমন্ত্রণে সিলেট গেলাম প্রায় বিশজনের দল নিয়ে। পথে ড্রিমল্যান্ড পার্কে সবাই খুব মজা করলাম। ‘লোকে বলে, বলে রে, ঘরবাড়ি বালা না আমার।’ সুনামগঞ্জে যাবো, আর হাসন রাজার বাড়ি না দেখে ফিরে আসবো? ‘একটি কুঁড়ি দু’টি পাতা রতনপুরের বাগিচায়…’। ভূপেন হাজারিকার গানের কলি।
সিলেট এলাকার মধ্যে ঢুকলে চা-বাগানের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য একবার উপভোগ করতেই হবে। মেডিকেল কলেজের সহপাঠী বন্ধু ডা. আমিনুল পাশ করার পর থেকেই চা-বাগানে। ডানকান ব্রাদার্সের শমশেরনগর বাগানে রাত কাটিয়েছি কয়েকবার। চা-বাগানে বড় সাহেবদের বাংলো মানে রাজ-রাজড়াদের কারবার। কেতাদুরস্ত কর্মচারীরা সব কাজ করে দিচ্ছে। আমিনুল আবার আমার শ্বশুরবাড়ির এলাকার। তাই খাতিরযত্নের কমতি নয়, বাহুল্য ছিলো। চা-বাগানের নারী শ্রমিকদের নিয়ে প্রোগ্রাম করেছি কয়েকবার। সিলেট গেলে ডা. শামিম ভাইয়ের সাথে দেখা হতোই। মাজারের পাশে উনাদের একটা হোটেলের রেস্তোরাঁয় পাকোড়া খেতে খেতে নানা বিষয়ে আলোচনা হতে। ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী ডা. কামালউদ্দিন ভাই সিলেটে বদলি এবং সেটেল হওয়ার পর থেকে উনার আতিথেয়তা এড়ানোর উপায় নেই। ওসমানী মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল মইনুল ভাই আর তার সহধর্মিণী গাইনির প্রফেসর নাসরিন আপার সাথে দেখা বা কথা হবেই সিলেট গেলে। আমার বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার আনিস বেশ কিছুদিন সিলেটের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিল। হজরত শাহজালালের দরগা গেটের উল্টা দিকে পাহাড়ের উপর অফিস। এবং শূন্য বাসা। একবার এখানেই আস্তানা গেড়েছিলাম। ওদের ফোর হুইলার জিপে বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভ করে বেড়াতে নিয়ে গেল এক তরুণ প্রকৌশলী। গল্প করতে হঠাৎ দেখি ছাতক সার কারখানা। ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ে পড়েছি ছাতক আর ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার কথা। আজ সশরীরে সেখানে। বন্ধু আনিসের বাসাতেই আলাপ হলো ইঞ্জিনিয়ার মোতালেবের সাথে। আমার স্ত্রীর বড় ভাই ফুয়াদ ভাইয়ের বন্ধু। কিছুদিন পরেই জানলাম, প্রাণবন্ত মানুষটিকে করোনা কেড়ে নিয়েছে।
আমার পুরানো দুজন রোগী নিয়মিত ফোন করেন আমাকে। ব্যস্ততার মাঝেও এই দুজনের ফোন ধরি, কথা বলি। একজনের নাম ইসলাম উদ্দিন। অন্যজন রহিমা। প্রথমজনের বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা, অন্যজন হবিগঞ্জের। দুজনেই আমার জন্য উপহার হিসেবে কিছু না কিছু আনবেন বা পাঠাবেন। আমি বকাঝকা করলেও সাতকড়ার লোভ ছাড়তে পারি না। মাঝে মাঝে ফোন করে জানতে চান, আমি সিলেটে কোন প্রোগ্রামে আসছি কি না। আমি যেন একটু জানাই। এবার আমাকে অবশ্যই আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবেন। আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায় সহজ সরল মানুষের ভালোবাসায়।
সাতকড়া নিয়ে ফেসবুকে সুন্দর একটা পোস্ট দিয়েছিলো সিলেটের তরুণ চিকিৎসক ডা. আলিম আল রাজি। সাতকড়া নাকি মিষ্টিও হয়! ফেসবুকের মাধ্যমেই এই তরুণ চিকিৎসক আমার পছন্দের। গত বছর রোটারির প্রোগ্রামে সিলেট গেলাম। হোটেলে এসে দেখা করলো ডা. আলিম। সামনাসামনি প্রথম দেখা। মানুষের মাঝে কত ভালোবাসা। পৃথিবী কত সুন্দর। আর কত ভাগ্যবান সিলেটের মানুষরা। সারাদেশ থেকে মানুষ ছুটে আসে সিলেটে। আর এরা এখানেই জন্ম নিয়ে হেসেখেলে বেড়াচ্ছে এখানে!
প্রিয় পাঠক, পুরো সিলেট বিভাগ এখন বন্যায় ভাসছে। বিভাগের আশি ভাগ এলাকা প্লাবিত। জেলাগুলি প্রায় বিছিন্ন। পূন্যভূমির ভাগ্যবান মানুষরা বড় কষ্টে আছে। ভারতের মেঘালয়ের অতিবৃষ্টি সিলেট বিভাগকে ভাসিয়েছে। টিনের ছাউনি কিংবা একতলা বাড়ির ছাদ পর্যন্ত ডুবে গেছে। আমার পুরনো রোগী রহিমা কিংবা ইসলাম উদ্দিনের বাড়িতে কি পানি উঠেছে? চিকিৎসার কাগজপত্র বন্যার তোড়ে ভেসে যায়নি তো?
চা-বাগানের শ্রমিকদের অবস্থা কি? ডা. কামাল, ডা. মইনুল, ডা. নাসরিন, ডা. আলিমের সাথে কথা বলা দরকার। তারা নিশ্চয়ই ত্রাণ, চিকিৎসার ব্যবস্থা নিচ্ছেন। বাংলাদেশের মানুষের ঐতিহ্য আছে মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার। আমরা দূর থেকে কি করতে পারি? সুসময়ে আমাদের প্রয়োজনে যাদের সাথে যোগাযোগ করি, এই দুঃসময়ে অন্তত তাদের খোঁজখবর নেই। তাদের পাশে দাঁড়াই অন্তত মানসিকভাবে। পারলে সাধ্যমত সহায়তা পাঠাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির অধ্যাপক সৈয়দ হামিদ ভাই একটা ব্যাংক একাউন্ট দিয়েছেন একটি সংগঠনের। আরও অনেক বিশ্বস্ত সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে। তাদের মাধ্যমে আমরা পাশে দাঁড়াতে পারি। আর হাওড়ে পরিবেশবিনাশি যেসব নির্মাণকাজ মানুষের এই দুর্ভোগে ভূমিকা রাখছে, সে বিষয়ে জনমত গড়ে তুলতে পারি।
লেখক: অধ্যাপক, ক্যান্সার রোগতত্ত্ব
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
আপনাদের প্রমোদভ্রমণের জেলাটি কাঁদছে ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন মুক্তমত