বন্যায় হাহাকার: মানবতা ও মনুষ্যত্বের পরীক্ষা
২১ জুন ২০২২ ২০:৪৪
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো বন্যা। প্রায় প্রত্যেক বছরই কম-বেশি বন্যা হয়। তাই প্রস্তুতিও নিতে হয় আগে থেকেই। বর্ষা মাসের বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢল এই দুই মিলিয়ে বিভিন্ন নদ-নদীর জল বাড়তে থাকে। ফলে বন্যা হয়। চলতি বছর সিলেট ও সুনামগঞ্জের ভয়াবহ বন্যায় মানুষের দুর্ভোগের চিত্র আমাদের কষ্ট দিচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বহু মানুষ তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। মানুষ মানুষের জন্য। জীবন জীবনের জন্য। আজ যদি আমরা মানুষের পাশে না দাঁড়াতে পারি তাহলে ভবিষ্যতের কাছে আমরা দায়বদ্ধ থাকবো। যার যার অবস্থান থেকে একটু সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেই এ মহাদুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। কারণ কেবল বন্যার জল থাকা অবস্থায়ই না বরং জল নেমে যাওয়ার পরেও যে বিশাল চ্যালেঞ্জ থাকে সেটাও মোকাবেলা করতে হয়। যারা নদীর দুপাড়ে বসবাস করে তারা প্রথমে সমস্যায় পরে। তারপর একে একে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগও আমাদের দেশে এখন একটি নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। বিভিন্ন জেলায় নদ-নদীর পানি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিমধ্যেই দেশের অনেক এলাকা বন্যা কবলিত হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। তারা বেশ দুর্ভোগে রয়েছে। বন্যার পানি আসার সময় এক ধরনের ভোগান্তি আবার নেমে যাওয়ার পর অন্য রকম ভোগান্তি হয়। বন্যার কারণে প্রাণহানির চেয়ে মানুষের ভোগান্তি হয় কয়েকগুণ বেশী। এই ভোগান্তি খাদ্যের,সুপেয় পানির,ওষুধের এবং পয়ঃনিষ্কাশনের। যে বা যারা এই ভোগান্তি সহ্য করেছেন কেবল তারাই জানেন এর দুর্দশা।
এ বছর আষাঢ় মাসের শুরুতেই কয়েকটি জেলায় বন্যার খবর বিভিন্ন পত্রপত্রিকা মারফত জেনেছি। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। ঘরে খাবার নেই, খাবার কেনার জন্য আশেপাশে বাজারও নেই। কেই বা দোকান করবে। সবারই তো জীবনের মায়া আছে। অনেকের ভাসমান লাশও পাওয়া যাচ্ছে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। তবে সেই সংখ্যাও কম। ফলে সরকারী বা বেসরকারী ত্রাণই এসব বানভাসী মানুষের ভরসা হয়ে দাড়ায়। বহুদিন আমরা চলতি বছরের মতো দুর্ভোগে পরিনি। জলবায়ু যে হারে পরিবর্তন হচ্ছে এর ফলে ভবিষ্যতে এ ধরনের বন্যার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ১৯৮৮ সালের বন্যা দেখিনি। কারণ তখন আমার জন্মই হয়নি। মা বাবার মুখে গল্প শুনেছি। সেই সময়কার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তারা আজও বলেন। শুনেছি বাড়ির মধ্যে দিয়ে নাকি স্রোত গেছে। চালের উপর চুলা নিয়ে রান্নাবান্না করেছে আর নৌকার পাটাতনের উপর জড়সড়ো হয়ে ঘুমিয়েছে। ১৯৯৮ সালেও বন্যা হয়েছিল। তখন আমি বুঝেছি, বন্যা কি? কতটা কষ্ট আর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সময় পার করতে হয়। দেশে এবছরও বন্যা হয়েছে। চারদিকে শুধু বানভাসি মানুষের হাহাকার। তাদের যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার চিত্র। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ।
শুধু মানুষ নয়, গরু, ছাগল হাঁস, মুরগী সবকিছু নিয়ে এক তীব্র দুর্ভোগে দিনাতিপাত করছে বানভাসি মানুষ। আমাদের দেশের মানুষ অসীম সাহসী। আমি জানি এ যুদ্ধ ভালভাবেই সামাল দেবে বানভাসি এসব মানুষ। এদেও মনের জোর অপরিসীম। পানিতে বন্দী লাখ লাখ মানুষের জীবন। থমকে আছে তাদের জীবনযাত্রা। থমকে আছে বললে ভুল হবে। চলছে। জীবন কখনো থেমে থাকে না। কিন্তু এই দুঃসহ সময়টা যেন থমকে আছে। আমি জানি যেসব মানুষ নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে তারা জলের বৃদ্ধি এবং কমার বিষয়টি লক্ষ করে। প্রতিদিন এমনকি প্রতি বেলায় পানি কতটুকু বাড়লো বা কমলো সে খবরও এরা রাখে। রাখতে হয়। কারণ পানির সাথেই তাদের জীবিকা, তাদের জীবন। অব্যাহত পানি বৃদ্ধিতে বন্যাদুর্গত মানুষ যে সীমাহীন দুর্ভোগে রয়েছে তা জাানি। ঘরের ভেতর পানি, উঠানে পানি সব জায়গায় পানি। শোবার জায়গা নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই (যেহেতু টিউবওয়েলগুলো বন্যার পানির নিচে), খাবার রান্নার জায়গা নেই, বাজার নেই আবার থাকলেও সেখানে যাওয়ার মত অবস্থা নেই, স্কুলগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র থাকায় ক্লাস বন্ধ, এরকম নানাবিধ সমস্যা নিয়ে থাকতে হচ্ছে বানভাসিদের। এই পরিস্থিতিতে দুর্গতদেও পাশে থাকা আমাদেও জন্য একান্ত আবশ্যক। সরকারিভাবে ত্রাণ পৌছে দেওয়া হচ্ছে বন্যাদুর্গতদেও মাঝে। কিছু বেসরকারী সংস্থাও, সংগঠনও এগিয়ে এসেছে। তাহলে আমি আপনি কেন বসে থাকবো? আমাদের দেশে নানা রকম দুর্যোগ রয়েছে। ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস এসব দুর্যোগের মত বন্যাও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
প্রবল বন্যায় ইতিমধ্যেই মারাও গেছে বেশ কয়েকজন। এর মধ্যে বেশীরভাগই শিশু। কারণ এ পরিস্থিতিতে শিশুদের মুত্যুর সম্ভাবনাই থাকে বেশী। কারণ ঘর বাড়ি সব জায়গাতেই যেখানে জল সেখানে বাচ্চাদের দেখেশুনে রাখা একটু অসুবিধাই বটে। তারপরও শিশুদের দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ওরা সাঁতার জানে না। এরকম দুঃসময়ে আমাদের প্রতিটি মানুষের উচিত এসব বানভাসি মানুষের পাশে দাড়ান। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। দুর্ভোগ আর নিদারুণ কষ্টে থাকা এসব মানুষকে একমুঠো খাবার, এক বোতল বিশুদ্ধ পানি বা অসুখ বিসুখ দেখা দিলে তার পাশে আমরা দাড়াতেই পারি। প্রতিদিন আমরা অনেক টাকাই অকারণে আামদের চিত্ত বিনোদনের জন্য খরচ করি। ধুমপান করি, চা কফি খাই। এসব যদি একবেলা না করি, একবেলা যদি বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজিতে টাকা না খরচ করে সাহায্যের জন্য রেখে দেই তাহলে অনেক কিছুই সম্ভব। একটি হাতের ক্ষমতা কম থাকলেও তার সাথে যখন আরেকটি হাত যোগ হয় এভাবে অনেক অনেক হাতের সমন্বয়ে যোগ হয় বিশাল সংগ্রহ। সেসব নিয়ে তো আমরা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি। বুক ফুলিয়ে বলতে পারি আমরা এসেছি তোমাদের পাশে, চিন্তা করো না। শুধুমাত্র এখন এই পানি থাকা পরিস্থিতিই যে দুঃসময় তা কিন্তু নয়। বরং বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরও নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। অনেক রোগের প্রার্দুভাব ঘটে। এসময়ও খাবারেরও সংকট দেখা দেয়।
বন্যা পরবর্তী সময় অবকাঠামোগত সমস্যা দেখা দেয়। কারণ যেসব এলাকায় বন্যার পানি ওঠে সেসব এলাকার রাস্তাঘাট পানির নিচে থাকে। ফলে পানি চলে যাওয়ার পর তা ব্যাবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পরে। ফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা সংস্কারের উদ্যেগ নিলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে, এছাড়া ব্রিজ, কালভার্ট সংস্কারের প্রয়োজন হয়। বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সবকিছুর পূর্ণনির্মান করতে হয়। কিন্তু পুননির্মান করা মত আর্থিক সামর্থ্য এদের থাকে না। কৃষি জমি বিনষ্ট হওয়ায় জমি চাষের জন্য প্রস্তুত করে ফসল উৎপাদন করতে সময় লেগে যায়। আবার যদি কেউ ব্যবসা নির্ভর জীবন যাপন করে তাও কিন্তু ব্যবসা দাড় করাতে দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। অনেকেই বন্যার সময় তাদের মানে বন্যা পরবর্তী সময়ে জীবনযাত্র স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লেগে যায়। এই সময় দল মত নির্বিশেষে এদের পাশে দাড়ানো উচিত। মানসিকভাবে বিপর্যস্থ থাকা এসব মানুষের পাশে সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের দাড়ানো উচিত। আমাদের প্রমাণ করা উচিত যে তারা একা নয়। তাদেও পাশে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আছে। তাদের কষ্টে আমরাও কষ্ট পাই। বাঙালী জাতি গৌরবের জাতি। এর সুদীর্ঘ ইতিহাস থেকে জানা যায় যুগে যুগে যত বিপদ সামনে এসে দাড়িয়েছে সবাই হাতে হাত রেখে তা মোকাবেলা করেছে। তাই এত সহজে এ জাতিকে কাবু করা যাবে না।
বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস বা ভূমিকম্প বা যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগই আসুক না কেন বাঙালী জাতিকে এতে পরাস্ত করা যাবে না। সাময়িক দুর্ভোগ ও দুঃশ্চিন্তা হবে মাত্র। আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতি। আমরা হাতে হাত মিলিয়ে শক্রর মোকাবেলা করতে জানি। আমরা একজনের বিপদে বুক আগলে দাড়াতে পারি। তাই বন্যা দুর্গতদের সাহায্যে আমরা আমদাদের সবটুকু নিয়ে ওদের পাশে গিয়ে দাড়াবো। ওরা যে এই বিপদে একলা নয় তা বোঝাতে হবে।
লেখক: শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক
সারাবাংলা/এজেডএস