বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে
২১ জুন ২০২২ ২০:৫৬
বন্যা আমাদের দেশে একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতি বছরই এখানে কমবেশি বন্যা হয়ে থাকে। তবে সম্প্রতি অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি। চলতি মৌসুমে এটা ছিল সিলেটের তৃতীয় দফা বন্যা। পরপর দু’দফা বন্যার পর এবারের বন্যাটি স্মরণকালের ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। একের পর এক এক এলাকা ভেসে গেছে, বেড়ে চলেছে বানভাসি মানুষের সংখ্যা। যেদিকে চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। জনপদগুলো মনে হয় একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। পানির ¯্রােতে ভেসে গেছে বাড়িঘর, গাছপালা, সবকিছু। ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, ধর্ম-বর্ণ সবাই এখন সমান কাতারে অবস্থান করছে। সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের এক হিসাবে জানা যায়, সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র এবং সঞ্চালন লাইন তলিয়ে যাওয়ায় প্রায় সব এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ আছে। নেই মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সেবাও প্রায় বন্ধ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। হাসপাতাল, ব্যাংকসহ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় সেবাও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
সিলেট অঞ্চলে এ আকস্মিক ভয়াবহ বন্যার মূল কারণ উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে প্রবল বৃষ্টিপাত। সিলেট বিভাগের পর উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলাও পরপর বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যে (১৯ জুন, ২০২২) জানা গেছে, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোণা, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের ১৫টি জেলার ৭৩টি উপজেলা এখন বন্যাকবলিত। আশেপাশের বিভিন্ন এলাকাও পানিতে ডুবে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে ১০ জন। মারা গেছে অসংখ্য গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১২২ বছরের ইতিহাসে সিলেট ও সুনামগঞ্জে এমন বন্যা আর হয়নি। গণমাধ্যমের বদৌলতে বন্যার ভয়াবহতার ছবি দেখে আমরা আতঙ্কিত। মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অপেক্ষা করছে খাবারের জন্য চারদিকে শুধু থৈ থৈ পানি। দেখা গেছে, ছোট প্রিয় সন্তানকে বন্যার পানি থেকে নিরাপদে রাখতে ভাতের হাঁড়িতে বসিয়ে রাখছে। মর্মান্তিক এসব দৃশ্যগুলো সহজেই বুঝিয়ে দেয় আজ ওরা কত অসহায়!
বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ সংগঠকদের মতে, সিলেটের প্রতিটি নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে পানি ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। হাওরে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, রাস্তা ও স্লুইসগেট নির্মাণসহ নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পাহাড়-টিলা, গাছপালা। ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির জন্য মূলত এসবকেই দায়ী করেছেন তারা। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল অর্থাৎ ১৮ শতাংশ ভূখন্ড বন্যা কবলিত হয়। ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সমগ্র দেশের ৫৫ শতাংশের অধিক ভূখন্ড বন্যার প্রকোপে পড়ে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে, বন্যার প্রধান কারণ হচ্ছে ভ‚-তাত্তি¡ক কাঠামোতে বাংলাদেশ নিম্নভূমি ও সমতল এবং অধিকাংশ অঞ্চলের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তুলনামূলকভাবে কম। এছাড়াও আছে বঙ্গোপসাগরে জোয়ার-ভাটার তীব্রতা, বিপুল পরিমাণ পলি জমার কারণে বিভিন্ন নদ-নদীর স্বাভাবিক নিষ্কাশন ক্ষমতা হ্রাস, আবহাওয়াগতভাবে নিম্ন চাপের সৃষ্টি ও অধিক বৃষ্টিপাত, অপরিকল্পিতভাবে ভূমির ব্যবহার, নদী-অববাহিকা অঞ্চলে ব্যাপক বন কর্তন, গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ ও অন্যান্য নদীতে বাঁধ নির্মাণের প্রভাব ইত্যাদি।
বন্যাকবলিত এলাকায় আশ্রয় এবং খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করে। সিলেট ও সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় দেখা গেছে, দলবেঁধে মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ গলাবদ্ধ পানিতে হেঁটে হেঁটে ছুটছে, কেউ-বা ছুটছে নৌকায়। পত্রিকার একটি সংবাদে জানা যায়, পানিবন্দি এসব মানুষের দুর্ভোগের সময় একশ্রেণির মুনাফালোভী চক্র বানভাসি অসহায়দের গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দিতে নৌকা ভাড়া প্রায় পঞ্চাশ গুণ বাড়িয়ে ভাড়া আদায় করছে। অর্থাৎ যেখানে ভাড়া ছিল আট শ’ থেকে এক হাজার টাকা, সেখানে তারা ভাড়া নিচ্ছে পঞ্চাশ হাজার টাকা। পাঁচ টাকার মোমবাতির দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে এক শ’ টাকা। ভাবা যায় একবার, কোথায় হারিয়ে গেছে আমাদের মানবতা! তবে এমন ঘৃণতর কাজের পাশাপাশি ভালো কাজেরও প্রমাণ পাই আমরা। সেনাবাহিনীরা তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় অনবরত উদ্ধার করছে পানিবন্দি মানুষকে। বানভাসি মানুষের জন্য এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন গ্রাম ও শহরের পানিবন্দি মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে খাদ্যসামগ্রী, বিশুদ্ধ পানি, স্যালাইন ইত্যাদি। ভবনের মালিকরাও বিপর্যস্ত মানুষদের আশ্রয় দিচ্ছেন, যথাসাধ্য তাদের খাবারের ব্যবস্থাও করে দিচ্ছেন। এটাই মানবতা। এই যে মানবতা, অসহায়-দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোও এখানেই সত্যিকার মানুষের পরিচয়, আর মানুষের বেঁচে থাকার সার্থকতা।
বন্যাকবলিত এলাকায় উপস্থিত সংকট নিরসনে দুর্গতদের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা অবশ্যই জোরালো এবং নিশ্চিত করতে হবে। সরকার এবং বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্নভাবে এসব বানভাসি মানুষদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। কিন্তু শুধু সরকার কিংবা এসব সংগঠনের ওপর নির্ভর করলেই চলবে না, এসব অসহায় মানুষদের পাশে আমাদেরও দাঁড়াতে হবে। একটি কথা না বললেই নয়, শুধুমাত্র ফেসবুকে আপলোড করার জন্য কিংবা ছবি তোলার জন্য যেন ওদের পাশে ক্ষণিকের জন্য আমরা অনেকেই দাঁড়াই। বন্যার্তদের সাহায্য করার মিথ্যে সাইনবোর্ড গলায় ঝুলিয়ে আমরা যেন কেউ প্রতারণা করে কারো কাছ থেকে সাহায্য না উঠাই। মানবিকতার কথা ভেবে এই কঠিন সময়ে তাদের পাশে সত্যিকারভাবে আমাদের দাঁড়াতে হবে। নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী বানভাসি এসব মানুষদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। মানুষ হিসেবে এখন এটাই আমাদের একমাত্র দায়িত্ব এবং কর্তব্য।
সারাবাংলা/এজেডএস