স্বপ্ন হলো সত্যি
২২ জুন ২০২২ ১৭:৪২
বরিশালের রাবেয়া সুলতানা রাজধানীতে কাজ করেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়। স্বপ্ন দেখতেন একদিন পদ্মা সেতু দিয়ে ফিরবেন বাড়ি। কিন্তু যখন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়, তখন তার সেই আশা অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। দক্ষিণাঞ্চলের অনেকের মতো রাবেয়াও হতাশ হয়ে পড়েন। ভাবেন আর কোনোদিন হয়তো পদ্মা সেতু হবে না। কিন্তু সরকার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে নিরাশ করেনি। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এবার সত্যি। ২০২২ সালের ২৫ জুন সরকার পদ্মা সেতু খুলে দিচ্ছে সবার জন্য। আর তাই এই ইদেই পদ্মা পাড়ি দিয়ে পরিবারের কাছে ফিরবেন রাবেয়া। উচ্ছ্বসিত রাবেয়া বললেন, ‘স্বপ্ন এবার সত্যি হলো। নির্ঝঞ্ঝাটে কম সময়ে এবার ইদে বাড়ি ফিরব। কী যে ভালো লাগছে।’
রাবেয়া সুলতানার মতোই উচ্ছ্বসিত ফরিদপুর আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাণিক মজুমদার। তিনি বলেন, আমরা ধন্যবাদ জানাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। কারণ, তিনি এই স্বপ্নের সেতুর অঙ্গীকার করেছেন এবং এখন সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে। আমরা ইদে সেতুর ওপর দিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। ঈদের আগে খুশির খবর!
মাওয়া ঘাট দিয়ে নিয়মিত গাড়ি চালান ফরিদ মিয়া। সেতু চালু হলে কেমন সুবিধা হবে জানতে চাইলে বলেন, আবহাওয়া খারাপ থাকলে যেমন ঝড়, বন্যা প্রভৃতি সময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরি বন্ধ থাকত। আমাদের তখন দুঃখের সীমা থাকত না। আবার শীতের সময় ঘন কুয়াশায় যেকোনো সময় ফেরি বন্ধ হয়ে যেত। যাত্রীর পাশাপাশি আমরাও চরম দুর্ভোগের শিকার হতাম। সেতু চালু হলে ঝড়, বৃষ্টি, কুয়াশা কিছুই আর বাধা হবে না। এবারের ঈদে আগের মতো জনদুর্ভোগ থাকবে না, পরিবহনের চাপও কমবে।
সামনেই কোরবানির ঈদ। সারাদেশ থেকে রাজধানীতে কোরবানির পশু আসবে। প্রতিবছরই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ও ব্যবসায়ীদের গরু খামারি পশু পরিবহনে বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন। সময় ও খরচ বেশি লাগে রাজধানীতে আসতে। যেমন মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও ফরিদপুরের অধিকাংশ পশু ব্যবসায়ীরা ট্রলারে পশু নিয়ে রাজধানীতে আসতেন। অন্যদিকে যশোর, মাগুরা, সাতক্ষীরা, নড়াইল ও ঝিনাইদহের ব্যবসায়ীরাও ট্রাকে করে গবাদি পশু ঢাকায় আনেন। পদ্মা পার হতে এসব ট্রাকের জন্য এতদিন ফেরিই ছিল ভরসা। বিড়ম্বনার সঙ্গে যুক্ত হতো বাড়তি খরচ। সেতু চালু হলে এবার ফেরিঘাটের বিড়ম্বনা ও পরিবহন খরচ দুটোই কমবে।
পরিবর্তন আসছে জীবন ও জীবিকায়। স্বপ্নের এই সেতু চালু হলে মানুষের জীবন ও জীবিকায় পরিবর্তন আসবে। নতুন পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। ফারুক আহমেদ তালুকদার দীর্ঘদিন পরিবহন ব্যবসায় জড়িত। জানালেন, পরিবহন ব্যবসার পরিকল্পনার কথা। শরীয়তপুর বাস মালিক সমিতির সভাপতি ফারুক আহমেদ তালুকদার বলেন, সেতু চালু উপলক্ষে জেলায় নতুন বাস সার্ভিস যোগ হবে। আমরা আশা করি, সুন্দর ও ভালো সার্ভিস দিতে পারব। পরিবহনের সংখ্যা বাড়বে, বাড়বে কর্মসংস্থানও। সেতু চালু হলে এই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়বে।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা থেকে ২০ বছর আগে মাওয়া ঘাটে বেকারি ও চায়ের দোকান দিয়েছিলেন মোহাম্মাদ রফিক। দৈনিক ১২ হাজার টাকা আয় হয়। শুক্র ও শনিবারে ভিড় বেশি থাকে। এই দুদিন ২০ হাজার টাকা আয় হয়। দোকানের মাসিক ভাড়া ১৮ হাজার টাকা হলেও মাস শেষে ভালো আয় থাকে।
ব্যবসা আগের মতো থাকবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে রফিক বলেন, সেতু চালু হওয়ার খবর আনন্দের। এই সেতুর কারণেই আমাদের পদ্মাপারে আজ এত উন্নয়ন। বিকল্প কিছুর ব্যবস্থা করতে হবে। আর যদি পদ্মা সেতু দেখতে পর্যটক আসে, তাহলে ব্যবসা আগের মতোই থাকবে। এখনো দিনে-রাতে সব সময় মানুষ থাকে, সবাই তো যাত্রী না, পর্যটকের সংখ্যাই বেশি।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেলিত সরকার ও জনপ্রতিনিধিরা। সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বাঙালির গৌরব, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, আর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রতীক পদ্মা সেতু। পাহাড়সম ষড়যন্ত্র, বিরোধিতা আর অনিশ্চয়তা ডিঙিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন প্রস্তুত উদ্বোধনের জন্য। অপেক্ষা ২৫ জুনের।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবে রূপ পাওয়ায় হিংসায় পুড়ছে বিরোধীদল। আর সেই ক্ষোভ থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে উগরে দিচ্ছেন নানা নেতিবাচক মন্তব্য। শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপু এমপি বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের স্বপ্ন। পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সর্বসাধারণ মানুষের স্বপ্ন। পদ্মা সেতু উদ্্বোধন হলে এই ২১ জেলায় উন্নয়ন হবে এবং অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনমান অনেক উন্নয়ন হবে। এরই মধ্য এই এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে।
স্বপ্নের সেতুর কাজের অগ্রগতি নিয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, সেতু পারাপারের জন্য প্রয়োজনীয় সব কাজ প্রায় শেষ। স্মৃতি হাতড়ে তিনি আরও বলেন, নদীশাসনে আমরা যথেষ্ট প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছি। এর জন্য বেশ কয়েকবার হোঁচট খেতে হয়েছে। এর মধ্যে মহামারি এলো। এর জন্য সবকিছুই বন্ধ ছিল। কিন্তু আমরা পরিকল্পনা করলাম যে এখানে বায়োবাবল তৈরি করব। আর এটা করা অনেক কঠিনই ছিল। এজন্য আমাদের কাজের গতি কমে গিয়েছিল; কিন্তু কাজ বন্ধ হয়ে যায়নি। ২৪ ঘণ্টাই কাজ হয়েছে।
বাকিটা এখন বাস্তবতা। ২৫ জুনের সেই স্বপ্নযাত্রাও স্মরণীয় করতে চায় সংশ্লিষ্টরা। পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে অর্থনীতিবীদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু চালুর ফলে দেশের অর্থনীতিতে যে বড়ো ধরনের প্রভাব পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক আগে থেকেই এডিবি-জাইকা ও বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। যমুনা সেতুর অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, এ রকম বড়ো সেতুগুলো দরিদ্র অঞ্চল এবং কম দরিদ্র অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেয়। তিনি আরও বলেন, বড়ো বেনিফিট হচ্ছে বিনিয়োগ এবং উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। সেটা করতে হলে বিনিয়োগের পথে যে জটিলতাগুলো আছে, সেগুলো নিরসন করতে হবে। যেমন আছে তেমন চললে বেনিফিট আসতে দেরি লাগবে।
বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, মোট জনসংখ্যার পাঁচভাগের একভাগ অর্থাৎ ৩ কোটিরও বেশি মানুষ এই সেতুর মাধ্যমে সরাসরি উপকৃত হবে। প্রতিবছর দারিদ্র্য কমবে দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিপি) মতে, সেতুটির ফলে দেশের জিডিপি বাড়বে ১ দশমিক ২২ শতাংশ এবং আঞ্চলিক জিডিপি বাড়বে সাড়ে ৩ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, পদ্মা সেতু বছরে দেশের অর্থনীতিতে ৩৫ হাজার কোটি টাকার জোগান বাড়াবে। ২০৪১ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশাবাদ অর্থনীতিবিদদের।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি