বানভাসি মানুষের আর্তনাদ কবে শেষ হবে
২২ জুন ২০২২ ১৯:০২
জাতি খুব শোকাভিভূত! বাংলাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে শোকের মাতম চলছে। প্রত্যেকটি মানুষ হাহুতাশে দিন কাটাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন সংকট প্রকটভাবে ঘনীভূত হচ্ছে। দুবেলা দুমুঠো ভাত কি তারা খেতে পারছে? শান্তিতে কি ঘুমাতে পারছে? চোখের সামনে ঘর বাড়ি মুহূর্তের মধ্যে ভেসে যাচ্ছে। মানুষের প্রিয় গৃহপালিত পশুগুলো মরে ভেসে যাচ্ছে অচেনা সমুদ্রে। অবুঝ ছোট্ট শিশু গুলো ক্ষুধার্ত নাকাল হয়ে মৃত্যুর পথযাত্রী। বয়স্ক বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধা বন্যায় ভয়ে থরথর কাঁপছে। আকাশ কালো মেঘের মেলা বসেছে। দিনভর বৃষ্টি। এই বৃষ্টি যেন জাতিকে মহাদুর্যোগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মোদের সোনার সবুজ শ্যামল বাংলাদেশে ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারি আর আর্তনাদে দেশের আকাশে বাতাসে প্রকৃতির রূপ মলিন হয়ে গেছে। চারিদিকে কান্নার শব্দে এ যেন এক মৃত্যুর দেশে পরিনত হওয়ার অবস্থা তৈরী হচ্ছে। ক’দিন তো চট্রগ্রামের সীতাকুণ্ডের পোড়া লাশের গন্ধ দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এই ভয়াবহ চিত্র শেষ হতে না হতেই অতি বন্যায় পানির স্রোতের ঘূর্ণিপাকে মানুষের মৃত্যু মানুষেই আবার খুব কাছে থেকে দেখতে পাচ্ছে। এতক্ষণ ধরে বলছিলাম সিলেট বিভাগের আকস্মিক বন্যার কথা। এ বন্যার ভয়াবহতা বর্ণনা করা কিংবা মিডিয়ায় দেখলে চোখের জল চলে আসে। জাতির সচেতন নাগরিক হিসাবে কেউ নিস্তব্ধ থাকতে পারে না। কেউ ছুঁটে যাচ্ছে বানভাসি মানুষের জন্য সহযোগিতা করতে আবার কেউ গবেষণা করছে কেন এই বন্যা হচ্ছে? বাঁধ নির্মাণে কি ত্রুটি আছে?না কি রাষ্ট্রের কোনো অলসতায় একের পর এক মানুষের কান্নার পরিস্থিতি তৈরী হচ্ছে!
বানভাসি মানুষের আত্ম চিৎকার। কেউ বলছে নৌকা নিয়ে দ্রুত আসুন আমাদের প্রাণ বাঁচান। কেউ তিন চার ধরে অনাহারে দিনাতিপাত করছে। আবার কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে নানা সংকটের কথা অকপটে বলছে। পানি বন্দী মানুষ যেকোনো মুহূর্তে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছে। এছাড়াও অনেকেই ফেসবুক সহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাঁচার জন্য আকুতি করছে। আমাদের দেশের গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম এখন সিলেট বিভগের বন্যার পরিস্থিতি কোন পথে তা প্রতিটা সময় বিশ্লেষণ করছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য থেকে জানা যায় ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বর্ষণের কারণে ১২ ঘণ্টাতেই সুনামগঞ্জে চার ফুট পানি বেড়ে যায়। চেরাপুঞ্জিতে ২৪ ঘন্টায় ৯৭২ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ১২২ বছরে এটি সর্বোচ্চ রেকর্ড। সেই বৃষ্টির পানি খুব দ্রুত গতিতে সুনামগঞ্জ এবং সিলেট অঞ্চলে নেমে এসেছে। সেজন্য বন্যা অল্প সময়ে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি দুই জেলার ৪০ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী। সিলেট ও সুনামগঞ্জের বাইরে আরও ৯ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে বন্যায়। এবারের বন্যায় সড়ক-রেল যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, মুঠোফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সুনামগঞ্জের পুরোটা এবং সিলেটের বেশির ভাগ এলাকা সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যা উপদ্রুত সুনামগঞ্জ ও সিলেটে ব্যাংক লেনদেন বন্ধ। দোকানপাট, হাটবাজারসহ অন্যান্য জনজীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। কিন্তু নৌকা যেন সিলেট বিভাগের মানুষের জন্য সোনার হরিণ। ৫০ হাজার টাকা দিয়েও একটা নৌকা ভাড়া পাওয়া যায় না।
মানুষের জীবন সংকটে যারা সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে না। তাদেরকে আমরা মনুষ্যত্ববোধের মানুষ কি বলতে পারি? পুঁজিবাদ কি শিক্ষা দেয়? পুঁজিবাদ শুধু খোঁজে মুনাফা। জাতির এই সংকটে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। মানবতার বড় অভাব। তার চেয়ে উদ্বিগ্ন হতে হয় পুরো সংকট নতুন করে সৃষ্টি হয়। সেটা হচ্ছে ভারতের উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে আসছে তিস্তা ও ধরলা নদীতে। যার ফলে সেখানে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এতে করে লালমনিরহাট, রংপুর ও নীলফামারীর বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় হাজারো পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। নদীর উপর ভারত সরকারের নতুন কোনো ইস্যু নয়।
নদী বাঁচাও, দেশ বাঁচাও- এই স্লোগানে দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক সংকট ও পরিবেশবাদী সংগঠন গুলো বছরের পর বছর আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছরের বাংলাদেশে কোনো সরকার নদী রক্ষার আয়োজন করে নি। বরং ভারত সরকারের কাছে নতজানু স্বীকার করে আসছে। এই সুযোগ ভারত সরকার কখনও নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রেখে বাংলাদেশকে মরুকরণ করার চেষ্টা করে আবার বর্ষামৌসুমে বাঁধ খুলে দিয়ে পানিতে ডুবে মারে। অথচ আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে আন্তর্জাতিক নদীকে কেউ জোরজবরদস্তি করে নদীর পানি প্রবাহ নিয়ে বৈষম্য করতে পারবে না কিন্তু ভারত আন্তর্জাতিক নীতি লঙ্ঘন করে আসছে আমরা কী বরাবরই চুপ থাকব?
অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং ভারত থেকে আসা উজানের ঢলে সিলেট ও সুনামগঞ্জে ২য় দফায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। এছাড়াও কুড়িগ্রামসহ উত্তরের বেশ কিছু জেলার বন্যা পরিস্থিতির জন্য হুমকি হয়ে আছে।
সিলেট ও সুনামগঞ্জের পরিস্থিতি অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। দুইটি শহরই পানির নীচে চলে গেছে। এমন প্রলয়ঙ্করী বন্যায় দেশ প্লাবিত হবে কখনও কী কল্পনা করতে পারছি? উত্তর সবার আগে থেকে জানা।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পরিবেশবাদী সংগঠকরা বারবার সর্তক বার্তা দিয়ে আসছে পরিবেশের আর্তনাদ বুঝার চেষ্টা করতে হবে এবং পরিবেশ বাঁচাতে এগিতে আসতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাষ্ট্র কখনও বুঝার চেষ্টা করে নি। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসে হঠাৎ কী কারণে এমন ভয়াবহ বন্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো? তবে তার আগে একটু বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন পৃথিবীর আদি সভ্যতা ও মনুষ্যবসতি নদীতীরেই। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ইরাকে ইউফ্রেতিস-তাইগ্রিস নদের সুমেরীয় সভ্যতা, সিন্ধু নদের মোহেনজোদারো ও হরপ্পা সভ্যতা, চীনের হোয়াংহো ও ইয়াংসি নদী সভ্যতা এবং মিসরীয়দের নীলনদের সভ্যতা। এমনকি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বেনিয়ারা নদীপথে দিয়ে যাতায়াতের মাধ্যমে সম্পদ লুট করে নিয়ে যেত আবার ফিরে এসে বসতি স্থাপন করত। পশ্চিম- উত্তর-পূর্ব তিনদিক থেকেই অসংখ্য নদনদী আমাদের দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। আর এসব নদ-নদীর তীরে বাঙালি জাতির বসবাস এবং বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশে নামে পরিচিতি আছে। এ দেশের মানুষ নদীর পানি দিয়ে আঁশ পাট, ধানসহ প্রায় সব ধরনের ফসল উৎপাদন করে জীবন নির্বাহ করে। আমিষ জাতীয় খাদ্যের অভাব পূরণের জন্য নদীতে সুস্বাদু হরেক রকমের মাছ এবং মাছের রাজা ইলিশ পাওয়া যায়। ফলে নদ, নদী যে মানবজাতির পরম উপকারী বন্ধু তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গবেষকদের জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৫১ বছরে প্রায় অর্ধেক সংখ্যক নদী শুকিয়ে গেছে কিংবা মরে গেছে। আর সরকারি তথ্যমতে, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৪০৫-এ। আর বেসরকারি হিসাব বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ২৩০। কোন পথে যাচ্ছে দেশ? আমাদের নদীগুলো কেন হারিয়ে যাচ্ছে? রাষ্ট্র কী এই প্রশ্ন গুলো নিজেদের ভিতরে তুলেছেন। আবার সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে নদ-নদী, খাল-বিল অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ার কারণে পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। নদ-নদী সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। যার ফলাফল হিসাবে আমরা সিলেট বিভাগে প্রলয়ঙ্করী বন্যার ধ্বংসলীলা দেখতে পাচ্ছি। কারণ সিলেটেও প্রতিটি নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। হাওরে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, রাস্তা ও স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পাহাড়-টিলা। এর দায় কার? রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রকৃতি, জলাভূমি, নদ- নদী, বনভূমি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা। কিন্তু রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নদী দখল করে রাখে। আমাদের দেশে নীতি, আইন, পরিসংখ্যান সব আছে কিন্তু দুঃখের বিষয় তার প্রয়োগ নেই। উন্নয়নের নামে প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস করে মানব সৃষ্টি দুর্যোগ তৈরী করা রাষ্ট্রের কাম্য নয়।
প্রাকৃতিক সংকট আর মানবসৃষ্ট সংকট মিলিত হয়েছে ভয়াবহ সংকট তৈরী করছে আমাদের দেশে। মানব জাতি বাঁচাতে দ্রুত পরিবেশের প্রতি যত্মশীল হওয়ার কি বিকল্প কোনো পথ নেই। কিন্তু যত্নশীল হওয়ার তো দূরের কথা উদাসীনতায় পৃথিবী ও আমাদের দেশের মানুষের বসবাস। বসবাসের যোগ্য পৃথিবীকে অযোগ্য করে গড়ে তুলতেছি। শেকল বন্দি দেশে পানি বন্দী মানুষ। অসহায়ত্বের কী শেষ? না আর্তনাদের নেই শেষ।
আদিকাল থেকে মানুষ প্রকৃতিকে ব্যবহার করে জীবন ও জগৎকে সুন্দর ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্য করে গড়ে তুলেছে। প্রকৃতিকে ব্যবহার করার আগে প্রকৃতির প্রতি আগে তাকানো উচিত। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের যদি এই শিক্ষা জাগ্রত না হয়। তাহলে বছরে বছরে ভিন্ন ধরনের সংকট তৈরী হবে। তখন তার দায় তো রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। মানুষ মানুষেরই জন্য। তবে মানবতার পরিচয় হোক জীবের সেবার মধ্য দিয়ে। জীব ও জগৎ বাঁচাতে দ্রুত পরিবেশের প্রতি যত্মশীল হতে হবে। সিলেট অঞ্চলে কেন ঘন ঘন বন্যা আঘাত হানছে, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
গবেষণার ওপর জোর বিশেষ জোর দিয়ে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। সিলেট ও সুনামগঞ্জ এলাকার মানুষ চরম অমানবিক অবস্থায় আছে। ওই দুই জেলাকে বন্যা দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হবে। জেলার সকল দুই তলা ভবন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবনকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা করে পানি বন্দী মানুষকে উদ্ধার করতে হবে। বন্যা পীড়িত মানুষের জন্য সুপেয় পানি, খাদ্য ও ত্রাণ সামগ্রী পর্যাপ্ত পরিমাণে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৌছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্র, সাংস্কৃতিক কর্মী, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও বিত্তবানদের সম্মিলিতভাবে বন্যাদুর্গতদের পাশে এগিয়ে আসতে হবে। বন্যাদুর্গতদের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে, তা অপ্রতুল। তাই এসব মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। অভিন্ন ৫৪ টি নদী নিয়ে ভারতের সঙ্গে জোরাল ভাবে আলোচনার যৌথ উদ্যোগ ও সমঝোতায় আসতে হবে। সিলেট অঞ্চলে বনভূমি–পাহাড়–ঠিলা ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। প্রতিবছর সিলেটেসহ সারা দেশের নদ, নদীগুলোতে ড্রেজিং করে নাব্যতা বাড়াতে হবে। দুর্যোগে পরবর্তী সময়ে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেরামত এবং বানভাসি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পরিমান অর্থ সহযোগিতা করে স্বাভাবিক জীবন যাপন ফিরায়ে নিয়ে আসা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস