আসুন, একটু ঝেড়ে কাশি!
২২ জুন ২০২২ ২২:৩৭
নীতির সাথে নৈতিকতা সম্পর্কিত। যা মান্য তাই নীতি। নীতির কাজ মূল্যবোধ নির্ধারণ করা, আদর্শের মানদণ্ড নির্ণয় করা। আর নৈতিকতা হলো নীতির বাহ্যিক রূপ। নৈতিকতা নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করে। নীতির স্থান কেবল ব্যক্তির চিন্তা-চেতনায়, বিবেকে, মগজে। আর নৈতিকতা শোভা পায় ব্যক্তির আচার-আচরণে, কাজে, কর্মে। তাহলে এ কথা বলা যায়—আমরা যা বলি, যে কাজ করি, যে ভাবাদর্শ মানি তা আমাদের ভিতরকার লালনকৃত নীতি-নৈতিকতারই প্রতিচ্ছবি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে বাহ্যিক দৃষ্টিতে সবসময় ধরা না পড়লেও আমরা প্রত্যেকেই তো কোন না কোন মতাদর্শ অন্তরে ধারণ করে থাকি এবং সে মোতাবেক জীবন পরিচালনা করি, তাহলে প্রত্যেকেই কি আমরা নীতিবানের কাতারে পড়ি? কিন্তু তা তো নয়! তাই হলে তো সমাজে আর কোন মিথ্যা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সুদ, ঘুষ, অন্যায়, অবিচারের স্থান থাকতো না।
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদেরকে নীতি সম্পর্কিত আরো কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। নীতির প্রকারভেদ আছে কি? নীতি কি পরিবর্তনশীল? পূর্বেই বলা হয়েছে- যা মান্য তাই নীতি অর্থাৎ যা মেনে চলা প্রয়োজন বা আমরা মেনে চলি তাই নীতি। যেহেতু এখানে ভালো বা খারাপের কোন শর্ত নেই, তাই নীতিরও কোন রূপভেদ নেই। তবে নীতির একটি পরিমাপ আছে। যা আদর্শের মানদণ্ডে দিয়ে নির্ণয় করা যায়। যে নীতি আদর্শ ও মূল্যবোধের মানদণ্ডে এগিয়ে থাকে পরিমাপে তার স্থান উচ্চে। আর যে নীতি পিছিয়ে বা শূন্য অবস্থায় থাকে তার অবস্থান নিম্নে। উচ্চমুখী নীতি গ্রহণীয় আর নিম্নমুখী বর্জনীয়। এই উচ্চ ও নিম্নমুখী নীতির তারতম্যের মধ্য দিয়েই আমদের জগত-সংসারের যাবতীয় ভালো-মন্দ, সুখ-অসুখ, ন্যায়-অন্যায়, সুবিচার-অবিচার, আলো-অন্ধকারের দেখা মেলে। তবে নীতির এসব ধর্ম আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়; আমরা আলোচনা করবো নীতির পরিবর্তন নিয়ে। নীতি পরিবর্তনশীল। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে নীতির রূপ বদলায়, সংশোধন হয়, পরিবর্তন আসে। এক্ষেত্রেও একই বিষয়- পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে আসা নীতি মূল্যবোধের দণ্ডে উচ্চে থাকলে গ্রহণীয় আর নিম্নে থাকলে বর্জনীয়।
পৃথিবী প্রতিনিয়ত আধুনিক হচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন কাজ-কর্মে, আচার-ব্যবহারে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে।আধুনিকতার সাথে তাল মেলাতে নীতিকেও তার স্বরূপ বদলাতে হচ্ছে। পরিবর্তিত হতে হচ্ছে পরিবর্তনের সূত্র মেনে। এখন লক্ষনীয় হলো এই পরিবর্তিত নীতি আমাদের সমাজ-সামাজিকতা ও পারিপার্শ্বিকতার বিচারে কতটুকু গ্রহণীয় আর কতটুকু বর্জনীয়। সমাজ বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য করলে সহজেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে তাকালে দেখা যাবে আমরা প্রত্যেকেই এক বহুরূপী নীতি অনুসরণ করে চলছি। প্রতিনিয়তই মুখোশ পড়ছি। ভয়ংকারসব মুখোশ। এ মুখোশেরও আবার বহুরূপ। অন্দরে এক, বাহিরে আরেক। এসব মুখোশ যেন সুবিধাবাদের আখড়া! যখন যে রূপ সুবিধা দিতে পারবে সেরূপকে প্রকাশ্যে আনছি, বাকিদেরকে সযত্নে লুকিয়ে রাখছি। আবার তাদেরকেও সামনে আনছি উপযুক্ত সময়ে। লুকোচুরির এই খেলায় আমরা দারুণ পারদর্শী। যাদের পারদর্শীতা একটু কম তারাই সমাজের চোখে অপরাধী হিসাবে ধরা পড়ছে, অন্যরা হচ্ছেন সাধু! বস্তুত নৈতিকতার প্রশ্নে আমরা সকলেই কোথাও না কোথাও গিয়ে বিদ্ধ হই কিন্তু অর্থ-করি, সামাজিক অবস্থান বা চাতুর্যতা আমাদেরকে সেসব থেকে রেহাই দিয়ে যায়। এই রেহাই পাওয়ার সংস্কৃতি সামাজিক অস্থিরতাকে বাড়িয়ে তোলার বড় সহায়ক। এই নীতি গ্রহণীয় নয়। তাই এ থেকে পরিত্রাণ প্রয়োজন।
সমাজ আমাদেরকে প্রতিযোগী করে তুলছে। প্রতিনিয়তই নিত্য নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করছে। এই প্রতিযোগিতার যুদ্ধে জিতে থাকার তাগিদে হেরে যাচ্ছি আমরা নীতির যুদ্ধে। আমাদের মানুষিকতা তৈরি হচ্ছে- আমাকে এগিয়ে থাকতে হবে সে যেকোন মূল্যেয় হোক। যেকোন মূল্যে এগিয়ে থাকার এই অভিলাষ থেকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মরা শিখছে বৃহৎ কোন সুবিধা অর্জনের জন্য কিঞ্চিৎ অন্যায় করা সমাজের চোখে অপরাধ নয়। তাই কঠোর নজরদারি দিয়েও ঠেকানো যাচ্ছে না প্রশ্ন ফাঁস। শত প্রচেষ্টার পরেও টেনে ধরা যাচ্ছে না কিশোর গ্যাং এর দৌড়াত্ব। মনে রাখা প্রয়োজন, বেআইনী ভাবে পরিচালিত ভালো কাজও রাষ্ট্রের বিকাশিত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
এখন আমাদের আর হেচকি নয়, জোরেসোরে একটা কাশি দেওয়া প্রয়োজন। যে কাশিতে আমাদের ভিতরকার সব ছলনা, ভণিতা, বহুরূপী, সুবিবাধাবাদি স্বভাব পয়জন আকারে বেড়িয়ে আসবে। তবেই রোগে-শোকে জরাজীর্ণ সমাজের ফুসফুসে স্বস্তি ফিরবে, রোগমুক্তি ঘটবে।
লেখক: কলামিস্ট