শিক্ষকের নির্মম মৃত্যু এবং আমাদের অধঃপতিত সমাজ
২৯ জুন ২০২২ ১২:৫৭
শিক্ষকতা একটি পেশা। অন্য পেশার মতো এখান থেকেও একজন পেশাজীবির সংসার নির্বাহ হয়। তবে অন্য পেশার সাথে এর কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। কারণ শিক্ষকের দায়িত্ব অন্য পেশার থেকে অনেক বেশি। অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাকে এই পেশায় আসতে হয়। সন্তান মানুষ না হলে যেমন বাবা-মা’র ওপর দায় চাপে, সেই সমপরিমাণ দায় শিক্ষকের ওপরও আসে। তাকে শেখাতে না পারার ব্যর্থতার গ্লানি থাকে। আবার সফলতা আসলে বিপরীত চিত্র থাকে। এটাই শিক্ষকতা।
ছাত্রের নির্মম আঘাতে উৎপল কুমার নামের একজন শিক্ষকের করুণ মৃত্যু হয়েছে। তার মৃত্যুর পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই ঘটনাটিকে নৈতিক অধঃপতনসহ আরও নানাভাবে ধিক্কার জানাচ্ছেন। ধিক্কারের মতোই একটি ঘটনা এটি। আমিও ধিক্কার জানাই। কিন্তু এই ঘটনা কেন ঘটলো বা একজন শিক্ষকের গায়ে আঘাত করার মানসিকতা কি একদিনে তৈরি হয়েছে বা হওয়া সম্ভব? এই মানসিকতা তৈরির পেছনে শুধু ঐ অপরাধী ছাত্রকে দায় দিয়ে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। সমাজটা পঁচে যাচ্ছে সে খেয়াল রাখিনি। সমাজে শিক্ষকের যে অবস্থান ছিল আজ তা নেই।
ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ক্রমেই আলগা হয়েছে। যত সম্পর্ক ঢিলা হয়েছে তত শ্রদ্ধা, ভক্তি কমেছে। সেই বাদশা আলমগীরের মতো এখন আর শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালার মতো অবস্থা নেই! তার জন্য কেউ এককভাবে দায়ী নয়। পুরো সমাজ ব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে দায়ী। যখন আমি আমার সন্তানকে কাউকে সম্মান করাতে শেখাতে পারিনি তখন সে তার শিক্ষককেও অসম্মান করবে। একজন শিক্ষকের যে তার সন্তান তুল্য ছাত্রকে শাসন করার অধিকার আছে সেই বোধটাই সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। আর এখানেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমি একজন শিক্ষক এবং গত পনেরো বছর ধরেই ছাত্রছাত্রী পড়ানোর কাজটি করেছি। শিক্ষা দিতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে সবার কাছে ভালো হতে পারিনি। হওয়ার চেষ্টাও করিনি। সেটা সম্ভবও নয়।
শিক্ষককে লাঞ্চিত করার ঘটনা কিন্তু আমাদের দেশে প্রথম নয়। প্রায়ই ঘটছে। সে ছাত্র করুক বা অন্য কেউ। তার কয়টি ঘটনার প্রতিবাদ হচ্ছে? আবার ছাত্রের দ্বারা শিক্ষক লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। কোনো শিক্ষকের অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আর তাকে লাঞ্চিত করা এক কথা নয়। আবার এটা যে কেবল এই সময়েই ঘটছে মানে ছাত্র তার শিক্ষাগুরুর গায়ে হাত তুলছে বা হয়রানি করছে তা নয়। অনেক আগে থেকেই এই নৈতিক অধঃপতনের শুরু হয়েছে। একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছে সেই নৈতিকতার স্থান। যার ফলে আজ একজন শিক্ষককে কোনো অপরাধ ছাড়াই ছাত্রের হাতে প্রাণ দিতে হলো। আমরা যদি এখনও ঘুরে না দাঁড়াই তাহলে ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীকে শাসন করতে যাবেন কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ শাসন মানেই সেই ছাত্রের বিরাগভাজন হতে হবে।
আবার শুধু ছাত্রছাত্রী কেন অনেক অবিবেচক অভিভাবককেও দেখেছি তুচ্ছ কোনো কারণে তার সন্তানের হয়ে শিক্ষককে অপমান করতে ছাড়েন না। এক্ষেত্রে সেই ছাত্র আরও বেশি সাহস পায়। অবশ্য ছাত্রকে শাসন করা যদি অপরাধের ভেতর পরে তো অন্য কথা! একসময় মানে আমাদের সময় বাবা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে শিক্ষকদের বলে আসতো- আমার সন্তানকে রেখে গেলাম। ওকে পড়ানোর প্রয়োজনে যা শাসনের দরকার হয় করবেন। এখন ছাত্রছাত্রীকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত করা নিষেধ। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন শিক্ষকরা বেত নিয়েই ক্লাসে যেতেন। পড়া না হওয়ার জন্য, দুষ্টুমির জন্য বেতের বাড়ি খেতে হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের প্রতি একটুও ক্ষোভ ছিল না বা এখনও নেই। আমি মনে করেছি এই শাসনের অধিকার কেবল আমার শিক্ষকদেরই ছিল। আর এখন সামান্য শাসনও ধৈর্যের বাধ ভেঙে দেয়।
মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষা। শিক্ষা ব্যতীত অন্য চাহিদাগুলো পূরণ করতে এবং জীবনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে শিক্ষার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। আর এই শিক্ষা প্রদানের কাজটি যে করতে পারে তিনিই শিক্ষক। সুতরাং তাকে সম্মান করা বা শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষার শিক্ষাটাও পারিবারিকভাবে হওয়া দরকার। এটা বলছি যে, আমি পাবলিক পরীক্ষার কক্ষ পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনকালে অনেক অভিভাবককে তার সন্তানকে তাদের ভাষায় ‘একটু সুযোগ’ দেওয়ার আবদার শুনেছি।
এই আবদার ক্ষেত্রবিশেষে কোনো মান্য গণ্য ব্যক্তির রেফারেন্সে করা হতো। তাদের কথা না শোনায় তীর্যক বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়েছি। শিক্ষক প্রকৃতপক্ষে একজন সোনার কাঠি যার ছোয়ায় একটি শিক্ষার্থীর জীবন পাল্টে যেতে পারে। গ্রীসের সক্রেটিস, প্লেটোর হাত ধরে শিক্ষকের যে ধারণা বা স্বরুপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই শিক্ষা দানের প্রক্রিয়া আজও বহমান। শিক্ষকরা আমাদের গুরু। শিক্ষকরা এই সমাজেরই গুরু। প্রাচীনকালে গুরু টোল খুলে গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন। মাটিতে বসে টুল জাতীয় উঁচু একটি জিনিসে বই রেখে লেখাপড়া চলতো। প্রাচীন গুরুদের সম্মান ছিল সবার ওপরে। রাজ দরবারেও ছিল শিক্ষকদের সম্মান। যদিও এই দীর্ঘ যাত্রায় অন্যসব কিছু পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষকদের জীবনযাত্রার ধরন এবং কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু যে শিকড়ের সন্ধান শিক্ষক প্রদান করে সেই কাজটি এখনও সেভাবেই চলছে। সেটা মোবাইল বা ল্যাপটপ বা টেলিভিশনে- যেভাবেই হোক না কেন। শিক্ষকের সাথে ছাত্র-ছাত্রীর যে নিবিঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সেই সম্পর্ক আজীবন থেকে যায়। বাবা-মা’র পর শিশুর মনে পরিবর্তন করতে পারেন যে ব্যক্তি তিনি শিক্ষক। শিক্ষকের স্থান তাই বাবা-মা’র পরেই। এজন্যই শিক্ষকতা কোন পেশা নয় বরং এটি একটি ব্রত। এটিই শিক্ষকতা সম্পর্কে একটি সম্যক এবং পূর্ণাঙ্গ ধারণা। তবে বাস্তবে এটিকে পেশা হিসেবেই গ্রহণ করা হয়। পেশা হিসেবে গ্রহণ না করেও উপায় নেই। কারণ অন্য সবার মতোই শিক্ষকদের পরিবার আছে,সংসার আছে এবং সংসার ব্যয় আছে। তবে আর দশটা পেশা থেকে এর দায়িত্ব ও উদ্দেশ্য ভিন্ন। একটু নিষ্ঠা,একাগ্রতা এবং শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক আত্মত্যাগ দায়িত্বের মধ্যে থাকা আবশ্যক।
আমরা বুঝতেই পারি না শিক্ষকের কাঠিন্যের ভেতর কমলতা, রাগের ভেতর আদর থাকতো। এখন বুঝতে পারি। আমার পিতৃতুল্য শিক্ষকদের আজ খুব মনে পরে। তাদের কতজনের বেতের পিটুনি আমার হাতে লেগে আছে। আমার তাদের জন্য মায়া হয়। তারা শাসন না করলে আজ হয়তো এটুকুও করতে পারতাম না। হয়তো অমানুষের কাতারে নাম লেখাতে হতো। অর্থাৎ একটা পর্যায় এসে শিক্ষকদের দেওয়া সেই শারীরিক শাস্তির কথা আজ আর মনে নেই। কেবল তাদের মুখগুলো মনে আছে। মনে আছে কেবল তাদের ভালোবাসাটুকু। যে মানুষগুলোকে আমি কঠোর দেখেছি, যাকে দেখলে স্কুলের সব ছাত্রছাত্রী ভয়ে কাঁপতো, সেই মানুষটি আসলে একদম সহজ, সরল মানুষ। তারপরও বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজ আজ প্রশ্নে সম্মুখীন। তবুও শিক্ষক আজও শিক্ষক-ই। তারা দেবতুল্য পুরুষ। তারা পুজ্য।
আমার শিক্ষকরা যেমন বেঁচে থাকবেনা আমার মধ্যে, সব শিক্ষক বেঁচে থাকবে তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। একজন ছাত্রকে দিয়ে সব ছাত্র সমাজকে বিবেচনা করা উচিত হবে না। কারণ আমার বহু ছাত্রছাত্রী আমাকে শ্রদ্ধা করে। রাস্তায় দেখলে আবেগে চোখ ভিজে আসে। ভাবি, এমন পেশা আর দ্বিতীয়টি নেই। এটা আমার জন্য গর্বের। শিক্ষকতা সত্যিকার অর্থেই একটি গর্বের বিষয়। কিন্তু একজন উৎপল কুমারকে কেন মরতে হবে সেটা নিয়ে সতর্ক বা সচেতন হওয়া উচিত। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের কোন অংশে ঘূণ ধরছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। দেশের মেধাসম্পদ তৈরি করার মূল কারিগর হলো শিক্ষক। শিক্ষকের হাত ধরেই একজন শিক্ষার্থী দক্ষতা অর্জন করে। দেশকে কিছু দেওয়ার সুযোগ অর্জন করে। একটি শ্রেণিকক্ষ যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর আন্তরিকায় স্বার্থক শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সেখানে থাকবে বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা। আর না হলে একসময় আমাদের আরও খারাপ সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: শিক্ষক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
অলোক আচার্য মুক্তমত শিক্ষকের নির্মম মৃত্যু এবং আমাদের অধঃপতিত সমাজ