বাজেট, শিক্ষা খাত এবং কিছু কথা
১ জুলাই ২০২২ ১৭:২০
জাতীয় বাজেট নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই এর দুর্বোধ্যতা কিংবা প্রণয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোকপাতের প্রয়োজনবোধ করি। এ দেশের অধিকাংশেরও বেশিরভাগ মানুষের কাছে বাজেট মানে পত্রিকার শিরোনামে হাজার হাজার কোটি টাকা হিসাবের অঙ্ক কিংবা অর্থমন্ত্রীর ব্রিকফেস হাতে হাস্যোজ্জ্বল ছবি। যে বাজেটের আয়ের প্রধানতম উৎস রাজস্ব আয়। আরেকটু ব্যাখ্যা করে বললে বাজেটের বেশিরভাগ টাকা আসে জনগণের পকেট থেকে। সেই বাজেট-ই দুর্বোধ্যতার কারনে দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের বোধগম্যতার বাইরে থেকে যায়। বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া নিয়েও অনেক কথা। অজপাড়া গ্রামের রহিমুদ্দিন, করিমুদ্দিন তো দূরে থাক্, সকল সংসদ সদস্যরাও বাজেট প্রণয়নে প্রভাব ফেলতে পারেন না। অর্থাৎ বাজেটে মতামত দেওয়ার অবারিত সুযোগটা এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি।
বাজেটের সহজ ব্যাখ্যা হলো সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। আমরাও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বাজেট করি। কিন্তু একটি দেশ যখন নির্দিষ্ট অর্থবছরে কোথায় কত টাকা ব্যয় হবে তার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করে তখন সেটিকে জাতীয় বাজেট বলা হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বাজেটের সাথে জাতীয় বাজেটর ঋণাত্মক সম্পর্ক। অর্থাৎ আমরা আয় বুঝে ব্যয় করি আর রাষ্ট্র ব্যয় বুঝে আয় করে। সে অনেক কথা, সদ্য পাশকৃত বাজেটের শিক্ষা খাত প্রসঙ্গে কথা বাড়ানো যাক।
‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’ শিরোনামে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট পাশ হলো। এ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। খাতভিত্তিক বরাদ্দে এবার দ্বিতীয় অবস্থানে শিক্ষা। সদ্য পাশকৃত বাজেটে শিক্ষা খাতের দিকে চোখ দিলে দেখা যায়, মোট বরাদ্দের পরিমাণ গত অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু বরাদ্দ কমেছে জিডিপির তুলনায়। গেলো অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য এটি বেড়ে ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা করা হয়েছে। কিন্তু জিডিপির তুলনায় গত কয়েক বছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দিকটিতে ক্রমহ্রাসমান চিত্র। ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপির তুলনায় শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ২ দশমিক ০৯ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে সেটি কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক ০৮ শতাংশে। এবার তা আরও কমেছে। দুঃখজনকভাবে ১৯৭২ সালের পর থেকে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির তুলনায় বরাদ্দ ৩ শতাংশের উপরে ওঠেনি। অথচ আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে যে পরিমাণ দক্ষ ও সৃজনশীল লোকবল প্রয়োজন এখন পর্যন্ত আমরা তা গড়ে তুলতে পারিনি। কারন উন্নত দেশগুলো শিক্ষা ও গবেষণা খাতে মোট বাজেটের যতটা বরাদ্দ দেয় আমরা সে জায়গায় বিপরীত অবস্থানে। উন্নত দেশে শিক্ষার বাইরে গবেষণার জন্য আলাদাভাবে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য বরাদ্দের অপ্রতুলতা দিবালোকের মতই স্পষ্টতর হচ্ছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজেটের আকার বড় করলেও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজনের তুলনায় বাজেটের এমন স্বল্পতা কাম্য হতে পারে না। গবেষণায় দেখা গেছে, স্নাতকে চার বছর থাকাকালীন একজন শিক্ষার্থী প্রায় ৫ হাজার ৭৬০ কর্মঘণ্টা ব্যয় করে। শিক্ষাজীবনের এই বড় সময়টা পেরিয়ে গিয়েও প্রতি বছর বেকারত্বের কলাম জুড়ে নেয় এর একটি বড় অংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপ মতে, কেবল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকেন। এমন নির্মম বাস্তবতায় শিক্ষাকে আরও বাস্তব ও কর্মমুখী করে গড়ে তুলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের বিষয়টি অবশ্যই অধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে করোনার ছোবলে যে খাতগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা তন্মধ্যে অগ্রগণ্য। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে বরাদ্দ পেলেও জিডিপির তুলনায় এর ক্রমহ্রাসমান চিত্র বর্তমান বাস্তবতায় হতাশাব্যঞ্জক। আজকের পৃথিবীতে প্রত্যেকেই প্রযুক্তিনিভর শিক্ষাব্যবস্থায় বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষত করোনার থাবা প্রযুক্তিগত দিকটির গুরুত্ব আমাদের হাড়ে হাড়ে শিখিয়ে গেছে। অনলাইনে পাঠদান কিংবা পরিক্ষা কার্যক্রমের মত নতুন বিষয়গুলোর সাথে আমাদের পরিচয় ঘটার সুযোগ করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট এবং মোবাইল-ল্যাপটপ প্রত্যেকের হাতে থাকা অনিবার্য। এই ডিভাইসগুলোর অভাবে করোনাকালে শহর এবং গ্রামের শিক্ষার্থীরা সমহারে সুবিধা ভোগ করতে পারেনি। অর্থাৎ ডিভাইসের অভাবে অনেকেই পিছিয়ে পড়েছে। অথচ পাশকৃত বাজেটে শিক্ষাখাতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা আইসিটি খাতের কয়েকটি দিক মিলাতে গেল রীতিমত ভ্রু কুঁচকানোর দরকার পড়ে। ল্যাপটপ থেকে শুরু করে কম্পিউটারের নানা সামগ্রীর আমদানিতে এবার রেয়াত সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাশাপাশি ল্যাপটপ আমদানিতে পূর্বে সরকার মূসক অব্যাহতি দিয়ে গেলেও চলতি বাজেটে তা বহাল থাকছে।
বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বলতে গেলেও অনেক কথা। ছোট্র একটি উদাহরণ টেনে লেখা শেষ করতে চাই। মানসিক স্বাস্থ্য মানবজীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচিত। মানসিক স্বাস্থ্যের বেখেয়ালিপনা থেকে প্রতিনিয়ত আমরা যে সমস্যায় ভুগি সেটি হলো বিষণ্নতা। আর এই কারণেই বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করেন। বিশেষ করে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে এর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। বিষয়টিকে খুব পাত্তা না দিলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিষণ্নতা বিশ্বের প্রধান রোগ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশে আত্মহত্যার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২১ সালে সারা দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ২০২০ সালে যেটি ছিল মাত্র ৪২ জনে। অর্থাৎ এক বছরের মাথায় দ্বিগুণ হয়েছে। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে এখনও ক্রমবর্ধমান হারে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এই সংবেদনশীল বিষয়টি নিয়ে যতটা সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ কিংবা উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন সেটি আমরা লক্ষ্য করছি না। শিক্ষা খাতে এমন অগণিত বিষয় আছে সমৃদ্ধির লক্ষ্য নিশ্চিত করতে যেগুলোর দিকে আরও বাড়তি নজর দেওয়া উচিত। গুরুত্বপূর্ণ এই খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায় থাকলাম।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এজেডএস