Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রনেই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ

অ্যাড. মো. রায়হান আলী
২ জুলাই ২০২২ ১৬:৩১

সামাজিক অবক্ষয়ের আরেক নাম দুর্নীতি। একটি উন্নত দেশ, জাতি গঠনে যেমন দুর্নীতিমুক্ত সমাজ দরকার তেমনি একটি দেশ, জাতির উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় সে দেশের দুর্নীতি। দুর্নীতি নামক এ ভাইরাসটি কোন রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে প্রধান বাধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়ায়। দুর্নীতি দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোন আদর্শের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অসাধুতা বা বিচ্যুতিকে নির্দেশ করে। বৃহৎ পরিসরে ঘুষ প্রদান, সম্পত্তির আত্মসাৎ এবং সরকারি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করাও দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত। আর রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান অন্তরায় বা বাধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়ায় এই দুর্নীতি।

বিজ্ঞাপন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘দুর্নীতি হলো একটি ক্যান্সার, যা গণতন্ত্রের প্রতি নাগরিকের বিশ্বাসকে নষ্ট করে আর উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতার প্রবৃত্তিকে হ্রাস করে’।

পাকিস্তানি হায়েনাদের হাত থেকে এদেশ স্বাধীন হয়েছিল প্রায় ৩০ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জ্বতের বিনিময়ে। এত ত্যাগের একটাই উদ্দ্যেশ্য আমরা সুখে, শান্তিতে এক দূর্নীতিমুক্ত মাতৃভূমিতে বসবাস করা। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী আমরা কতটা দূর্নীতিমুক্ত হতে পেরেছি সেটা প্রশ্ন থেকে যায়। প্রায় প্রতিটা সেক্টরে কম-বেশি দুর্নীতির আনাগোনা।

বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী এই সংস্থার প্রকাশ করা ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই)’-এ এই তথ্য উঠে এসেছে। গতবার (২০২০ সালের পরিস্থিতি বিবেচনায়) এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। এবার বাংলাদেশের ১ ধাপ উন্নতি হয়েছে, তাতে অধঃক্রম (খারাপ থেকে ভালো) অনুযায়ী ‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত’ দেশের তালিকায় অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১৩তম। তবে স্কোর গতবারের মতোই ২৬ রয়েছে।

বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের ২০২১ সালের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপ) ১৪৭ নম্বরে। বাংলাদেশের এই অবস্থানকে খুবই হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি জানান, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ৮টি জরিপের ফলাফল থেকে সূচকটি নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত টানা ৫ বছর বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে টিআই প্রতিবেদনে তালিকাভুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। পরে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার যৌথভাবে শীর্ষে রয়েছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। দুর্নীতির ধারণা সূচকের (সিপিআই) ১০০ স্কোরের মধ্যে এই তিনটি দেশ পেয়েছে ৮৮ করে।

বিজ্ঞাপন

কম দুর্নীতিগ্রস্থ ১০টি দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নরওয়ে, সিঙ্গাপুর ও সুইডেন; এই তিনটি দেশেরই স্কোর ৮৫। আর ৮৪ স্কোর নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ড। এরপর চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে নেদারল্যান্ড (স্কোর ৮২), পঞ্চম লুক্সেমবার্গ (৮১), ষষ্ঠ জার্মানি (স্কোর ৮০), সপ্তম যুক্তরাজ্য (স্কোর ৭৮) ও অষ্টম স্থানে রয়েছে হংকং (৭৬)। ৭৪ স্কোর নিয়ে যৌথভাবে নবম স্থানে আছে কানাডা, আয়ারল্যান্ড, এস্তোনিয়া ও অস্ট্রিয়া। যৌথভাবে দশম স্থানে আছে ৭৩ স্কোর নিয়ে অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, জাপান ও উরুগুয়ে।

টিআই’র দুর্নীতির ধারণা সূচক অনূযায়ী ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ তালিকার এক নম্বরে ছিল। অর্থাৎ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়, ২০০৭ সালে সপ্তম, ২০০৮ সালে দশম, ২০০৯ সালে ১৩তম, ২০১০ সালে ১২ তম, ২০১২ সালে ১৩ তম, ২০১৩ সালে ১৬ তম, ২০১৪ সালে ১৪ তম, ২০১৫ সালে ১৩ তম, ২০১৬ সালে ১৫ তম, ২০১৭ সালে ১৭ তম এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ১৩ তম অবস্থান লাভ করে। এই সমীক্ষা থেকে একটি জিনিস প্রতীয়মান হয়, দুর্নীতিতে আমাদের অবস্থান সব সময়ই উল্লেখযোগ্য অবস্থায় ছিল যা আমাদের জন্য খুবই হতাশা জনক।

সাম্প্রতিক সময়ের নানান কেলেঙ্কারির কারনে দুর্নীতির সূচকের তেমন পরিবর্তন আনা সম্ভবপর হয় নি। তার মধ্যে অন্যতম দুর্নীতির কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো হল- সোনালী ব্যাংকের হল মার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের অর্থ লোপাট, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপের দুর্নীতি, বহুল আলোচিত রূপপুরের বালিশ কান্ড, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, ক্যাসিনো কান্ড, জনতা ব্যাংকের অ্যাননটেক্স, দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মান কাজে রডের পরিবর্তে বাঁশের ব্যবহার, গৃহহীনদের গৃহ নির্মান কাজে দুর্নীতি ইত্যাদি।

এসব আলোচিত কেলেঙ্কারি সহ জনগনের কাছে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য দুর্নীতির কারনে আমরা আজ দুর্নীতির সূচকে গত বছরের তুলুনায় তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। মাননীয় প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এগিয়ে চলছে এদেশের উন্নয়ন কার্যক্রম। সেই উন্নয়নের অংশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে আজ আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে এই শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা রাস্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে। এদেশ যখন এমন উন্নয়নে চলমান তখন একদল কুচক্রী মহলের চক্রের কারনে সম্প্রতিককালে কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা তো বীরের জাতি, তাই কোন অপশক্তিকে আমাদের ভয় পাবার নয়। তাই এ দুর্নীতি ব্যাধির মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। আমরা কি বাংলাদেশকে একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশে পরিণত করতে পারি না? দুর্নীতিকে এ দেশের মাটি থেকে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করার আরেকটি মুক্তিসংগ্রামে আমরা কি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি না? নিশ্চয়ই সকলের সার্বিক সহযোগিতায় দুর্নীতিমুক্ত করতে পারবো এদেশকে।

বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলা গভর্নরদের উপস্থিতিতে শেষ ভাষনে বলেছিলেন- ‘অন্য কাজ করুন বা না করুন, দুর্নীতি বন্ধ করুন। তবেই দেখবেন সমাজের সব কলুষতা কেটে গিয়ে দেশে ন্যায়বিচার, সততা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের উন্নয়ন তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে। মানুষের উন্নয়ন তথা দেশের উন্নয়ন গতিধারাকে নিশ্চিত করতে হলে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ যে আমাদের সামনে খোলা নেই’।

বঙ্গবন্ধু আরো অন্য এক ভাষনে বলেছিলেন- ‘কোনো অফিস-আদালতে দুর্নীতি হলে এবং আপনাদের নিকট কেউ ঘুষ চাইলে সঙ্গে সঙ্গে তিন পয়সার একটি পোস্ট-কার্ডে লিখে আমাকে জানাবেন। আমি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব, যাতে দুর্নীতি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়’।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে আমরা বদ্ধ পরিকর হলেও বাস্তবে কতটা সম্মিলিতভাবে কাজ করছি সেটা প্রশ্নই থেকে যায়। মা-মাটির স্বার্থ উদ্ধারেই যার মূল লক্ষ ছিল আমরা তার রেখে যাওয়া স্বপ্নের কতটা মূল্য দিয়ে যাচ্ছি? মূল্য আমাদের দিতেই হবে। এদেশ থেকে দুর্নীতির আখঁড়া মূলৎপাটন করে নিশ্চিহ্ন করতে সকল প্রকার অনিয়ম। দুর্নীতির প্রতিরোধে সরকার দুর্নীতি প্রতিরোধ (দুদক) গঠন করেছেন। দুর্নীতি প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট আইন করেছেন। দেশের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন করার দায় শুধু সরকারের উপর দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমরা সবাই যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেদেরকে সচেতন ও দুর্নীতিমুক্ত রাখি তাহলে দুর্নীতি প্রতিরোধ সহজ হবে।

এ কথা সত্য যে, সমুলে দুর্নীতি প্রতিরোধ করার মত কাজটি খুবই কঠিন ও জটিল, তবে মোটেও সাধ্যাতীত নয়। দেশপ্রেম, শক্তিশালী মনোবল ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নেতৃত্ব এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলাদেশে অবশ্যই দুর্নীতির গতিকে অনেকটাই নামিয়ে আনতে সক্ষম হবেন। আর তাহলেই বঙ্গবন্ধুর সেদিনের আহ্বানের ইতিবাচক সমাপ্তি সম্ভব হবে।

লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অ্যাড. মোঃ রায়হান আলী দুর্নীতি নিয়ন্ত্রনেই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

মানুষের হিংস্রতা কেন বাড়ছে?
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৪১

আরো

সম্পর্কিত খবর