সরিষাবাড়িতে হোক পাট-শিল্পের পুর্নজাগরণ
৭ জুলাই ২০২২ ১৫:২৪
ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাই ও যমুনা নদীর পলল দ্বারা গড়ে উঠেছে সরিষাবাড়ীর ভূঅঞ্চল। ব্রিটিশ আমলে সরিষাবাড়ীতে ছিলো গুরুত্বপূর্ণ নদী বন্দর। এখানে ছিলো ব্রিটিশ ও মারোয়াড়ীদের বেলিং কুটির। সে সময় সরিষাবাড়ী ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিলো। সরিষাবাড়ীকে বলা হতো দ্বিতীয় নারায়ণগঞ্জ। প্রাচ্যের দ্বিতীয় ডান্ডিও বলা হতো এই সরিষাবাড়িকে।
১৯০১ সালে ভারতের রাজ্য পুতনার অধিবাসী কুনিরাম শেঠী সর্বপ্রথম সরিষাবাড়িতে ‘কুনিরাম শেঠী এন্ড কো:’ নামে একটি পাটক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯০৫ সালের মধ্যে এই মহকুমার একমাত্র সরিষাবাড়ীতেই ভারতীয় ব্যবসায়ী মালিকানায় বিড়লা ব্রাদার্স লি:, মেসার্স লক্ষী নারায়ন মুদ্রা লি:, লুইচ ডেফার্স এন্ড কোং ও বেঙ্গল জুট বেলিংসহ কয়েকটি জুট প্রেস হাউজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কলকাতা ও ইউরোপ কেন্দ্রিক ব্যবসায় প্রসার লাভের কারনে সরিষাবাড়ী এলাকাটি বাণিজ্যিক রপ্তানি কেন্দ্র হিসেবে উপমহাদেশের দেশগুলোর কাছে পরিচিতি ছিল। ব্রহ্মপুত্রের ধারে সদর থানার ইটাইল নদীবন্দর হতে এক সময় পাট নিয়ে নৌকা কলকাতা, মাদ্রাজ ও হুগলী যেতো। সরিষাবাড়ীতে উৎপাদিত পাট নেওয়ার জন্য হাজার হাজার নৌকা যমুনা নদীতে ভীড় করতো। এখানকার পাট খুবই উন্নত জাতের হতো। পাটের আবাদ এখানে বেশী হওয়ার ফলে এখানে বেশকিছু কোম্পানী পাট কল গড়ে তুলে। সরিষাবাড়ী আলহাজ্ব জুট মিলস, পপুলার জুট মিলস, ইস্পাহানী জুট বেলার্স, বিজেএমসি, বিজেসিসহ অনেক সংস্থা পাটের ব্যবসা করতো। ইংরেজগণ সরাসরি এখানকার পাট নৌ পথে রপ্তানী করতো। পাট শিল্পের সাথে জড়িত হয়ে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো।
পাটশিল্প সমৃদ্ধ সরিষাবাড়ীতে ২২টি পাটের কুঠি ছিলো। প্রায় বাইশ হাজার শ্রমিক পাটের কুঠিগুলোতে কর্মরত ছিলো। বাংলাদেশের পাট ব্যবসায়ী কেন্দ্র হিসেবে নারায়নগঞ্জের পরই সরিষাবাড়ীর স্থান ছিলো। আজ তা বিলুপ্তির পথে। ধীরে ধীরে অধিকাংশ পাটকল বন্ধ হয়ে যায়। পৌরসভা এলাকায় আলহাজ জুট মিলস লিমিটেড, এআরএ জুট মিলস লিমিটেড ও পপুলার জুট মিলস লিমিটেড চালু ছিল। পরবর্তীতে আরামনগর বাজারে কেএইচবি ফাইবার লিমিটেড ও পোগলদিঘা ইউনিয়নের বয়ড়া এলাকায় মিমকো জুটমিল নামে দুটি প্রতিষ্ঠান চালু হয়। কিন্তু বেশিরভাগ কারখানাই বন্ধ হওয়ায় বেকার হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক ও তাদের পরিবার। মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছে সাবেক এই পাটশিল্প নগর।
বছর চারেক আগে পত্রিকার পাতায় পড়েছিলাম, বিশ্বের প্রথম পাটের পাতা থেকে তৈরি জৈব পানীয় (চা) এর জন্য কারখানা হচ্ছে সরিষাবাড়িতে। স্বাভাবিকভাবেই এমন সংবাদে যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলাম, এ শিল্পের পুনর্জন্মের বীজ রোপিত হবে এই আশায়। মূলত বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের অর্থায়নে সরিষাবাড়ী উপজেলার ঝালুপাড়া এলাকায় এই কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। এই কারখানা স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছিলো ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এখানকার চা শুধু বাংলাদেশেই নয়, দেশের বাইরেও রপ্তানি হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলো কর্তৃপক্ষ, যা ছিলো রীতিমতো আশাজাগানিয়া সংবাদ। সত্যি বলতে কি, পাট এমনই একটি কৃষিপণ্য, যার কোনো কিছুই ফেলনা নয়। পাটের পাতা থেকে যেমন চা তৈরি করে তা বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব, একইভাবে পাটকাঠি পুড়িয়ে উৎপাদিত চারকোল থেকে প্রিন্টার মেশিনের কালি, ফেসওয়াশ, পানির ফিল্টার, বিষবিধ্বংসী ওষুধ ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য বিদেশে রপ্তানিও সম্ভবপর। পাট থেকে ভিসকস সুতা তৈরি সম্ভব। সেই সুতায় তৈরি পোশাক অনেক আরামদায়ক এবং দামও বেশি। দেশে প্রতি বছর বস্ত্র কারখানাগুলোতে ৭০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন ভিসকস সুতা আমদানি করা হয়, সঠিকভাবে নজরদারি ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমদানিরই হয়তো প্রয়োজন হতো না, পাট-শিল্পই যোগান দিতে পারতো।
আমাদের দেশেই পাট থেকে সোনালি ব্যাগ তৈরির যে প্রযুক্তি দেশে উদ্ভাবিত হয়েছে, কাজে লাগাতে হবে এই বিপুল সম্ভাবনাময় সুযোগটি। পৃথিবীতে প্রতি বছর ৫০০ বিলিয়ন শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদার একটি ক্ষুদ্র অংশ আমরা বাংলাদেশের তৈরি সোনালি ব্যাগ দ্বারা পূরণ করা সম্ভব হলে পাট খাতে কি নীরব বিপ্লব সাধিত হবে, ভাবতে পারেন! শুধু বিদেশে নয়; দেশের বাজারেও এর রয়েছে অমিত সম্ভবনা। এতে পাটকল ও পাটচাষি উভয়েই লাভবান হবেন। পাট কাটিংস ও নিম্মমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারেকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত পরিবেশবান্ধব ও ব্যয়সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড়ধস রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। জিওটেক্সটাইলের অভ্যন্তরীণ বাজার এখন ৭০০ কোটি টাকার ওপর। এসব ছাড়াও পাট দিয়ে শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বাহারি ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, আলপনা, দৃশ্যাবলি, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা ,স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, গহনা ও গহনার বক্সসহ ২৭৫ ধরনের পণ্য দেশে-বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। এ শিল্পের সঠিক বিকাশ ও সম্প্রসারণে রয়েছে বিশাল কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগও।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, পাটের গবেষণার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ এবং পাট উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে পাট সম্পদ সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর ৬ ও ১১ দফা আন্দোলনের একটি প্রধান অংশ জুড়েই ছিল পাটের কথা। পাট খাতকে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য নয় বরং জাতির সম্পদ বিকাশের লক্ষ্যে পুনর্গঠিত করতে চেয়েছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ সচেতনতার কারণে বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা ও দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পাট শিল্পের পুর্নজাগরনের পথ অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছে। পাট শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও আধুনিকায়নের ধারা বেগবান করা, পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন বাস্তবায়ন, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়াতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। এই সাথে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সর্বাঙ্গীণ সহযোগিতা ও এ খাতকে ঢেলে সাজালে পাটকে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে বর্তমান সময়োপযোগী পাটপণ্য উৎপাদন করার ক্ষেত্রে প্রাচ্যের দ্বিতীয় ডান্ডি খ্যাত ‘সরিষাবাড়ি’ অতীতের মতো আবারও এই শিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদূরপ্রসারী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের মাধ্যমে আজ বাংলাদেশ আর্থসামাজিক বিভিন্ন সূচকে যেমন সফলতা অর্জন করেছে, একইভাবে সরিষাবাড়ির পাট-শিল্পের সকল সমস্যা-সংকট কাটিয়ে পাটের ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনে এ শিল্পের পুর্নজাগরণেও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখবে- এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মুক্তমত মোঃ আশিকুর রহমান সৈকত সরিষাবাড়িতে হোক পাট-শিল্পের পুর্নজাগরণ