কেমন হবে পথশিশুদের ইদ আনন্দ
৯ জুলাই ২০২২ ২১:০১
ক্ষুধার জ্বালায় পরিবার ছেড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পারি জমায় ফুটপাত, পার্ক, ট্রেন ও বাসস্টেশন, লঞ্চঘাট, সরকারি ভবনের নিচে। অজানার পথে পা বাড়ায় তখনই তাদের পরিচয় হয় পথশিশু। এসব পথশিশুকে দেখার কেউ নেই। শিশুরা জন্মের পর তারা পথশিশু থাকে না। দরিদ্রতা অভাব অনটন তাদের পথশিশু হতে বাধ্য করে। কিছু দিন পর মুসলিম ধর্মালম্বী বড় উৎসব ইদুল আযহা। সবাই আনন্দ করবে, ভাল খাবার খাবে, নতুন জামা পড়বে প্রভৃতি আয়োজনের মধ্যে উৎসব পালন করবে। ইদ মানেই আনন্দ, ইদ মানে খুশি। কিন্তু পথ শিশুদের এই ইদ অন্য সাধারণ দিনের মতই একটি দিন। ইদের উৎসব মুসলিমরা আনন্দ ভাগাভাগি করে নিলেও। উৎসবের কোন ছোঁয়া পায় না পথ শিশুরা। যাদের ঘর নেই, বাড়ি নেই, থাকার কোনো জায়গা নেই, ফুটপাতই যাদের একমাত্র ঠিকানা। তাদের আবার ইদ উৎসব। তাদের বেলায় ইদ হয়তো আসে আবার যায়, কিন্তু সেই ইদ কখনই উৎসব হয়ে আসে না।
উৎসব হয় মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ যেমন— ইদের দিন তারা নতুন জামা পরবে, হাতে মেহেদি লাগাবে, বাবা-মায়ের কাছ থেকে নতুন টাকার সেলামি নেবে, বাসায় ভালো খাবার-দাবারের ব্যবস্থা থাকবে। তবেই না সেটা উৎসবে পরিণত হবে।
পথশিশুরা এই উৎসবে অন্তর্ভুক্ত নয় কারণ তাদের না আছে নতুন জামা, না আছে ভালো খাবারের ব্যবস্থা। আর হাতে মেহেদি লাগানো এবং নতুন টাকার সেলামি পাওয়া তো স্বপ্নের ব্যাপার। তাদের কাছে ইদের দিন অন্যান্য দিনগুলোর মতই সাদামাটা। সারাদিন খাটা-খাটুনি করে একবেলা খাবার জোগাড় করা, এটাতো আর ইদ উৎসব হতে পারে না।
বিআইডিএস ও ইউনিসেফের এক গবেষণার তথ্যমতে বাংলাদেশে ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ জন পথশিশু রয়েছে। কেবল ঢাকা শহরে রয়েছে সাত লাখ পথশিশু। চলতি বছর শেষে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৫৪ জনে। আর ২০২৪ সাল নাগাদ সংখ্যাটা হবে ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৩০ জন।
পথশিশুরা পরিবার থেকে অনেক দুরে। কেউবা মার কোলে ঠাই মিললেও। তবে পেটের আহার যে তাদের মেটে না। বাবা নেই নিজের চালাতে হয় মাকে। স্বাস্থ্য সচেতনাও নাই তাদের মধ্যে। আর শাসন কি সেটাই তো জানে নানা তারা। নিজের ভালও টাও ভুলে যায় ক্ষুদার জ্বালায়। পেটের ক্ষুধা মেটাতে অনেক কিছু করতে হয় তাদের। বাস্তবতার কাছে হেরে যায় এক মুঠো ভাতের কাছে। বড় বড় অপরাদে জরিয়ে পরে। একটা সময় হয়ে যায় মাদকাসক্ত। যা থেকে আর বের হতে পারে না। ধিরে ধিরে নেশা গ্রস্ত হয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে ভোগে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদকে আসক্ত। সংগঠনটির তথ্যানুযায়ী ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে, যেখানে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে। পথশিশুরা সাধারণত গাঁজা, ড্যান্ডি, পলিথিনের মধ্যে গামবেল্ডিং দিয়ে ও পেট্রল শুঁকে নেশা করে।
শুধু আহারের খোঁজে তারা রাস্তা ঘাটে ঘুরে ফিরে । বড় বড় অপরাধে জরিয়ে পরে। আজ তারা যদি সঠিক ভাবে গড়ে উঠতে পারতো। তাহলে অন্য দশ জন শিশুর মত তাদেরও জীবন হত ।
পথশিশুদের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ২০১৬ সালে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু প্রতিদিন গোসলহীন থাকে, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই ও ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থতায় ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না।
আমাদের দেশে এদের দেখার কেউ নেই৷ কিছু সংস্থা বা ব্যক্তিগত উদ্যোগ শিক্ষা দেয়া বা স্বাস্থ্যগত কিছু পরামর্শ দিলেও তাদের জন্য নেই কোন বাসস্থান। উন্নত দেশগুলোয় দেখা যায়, প্রত্যেক শিশুর দায়িত্ব রাষ্ট্র কোনো না কোনোভাবে পালন করে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো এটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
আন্তর্জাতিক শিশু সনদ, শিশু আইনসহ দেশের প্রচলিত আইনে প্রতিটি শিশু তাদের সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশ লাভের জন্য শিক্ষা, খেলাধুলা, খাদ্য ও পুষ্টি, বিনোদন পাওয়ার অধিকার রাখে। শিশুদের সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে এসব সনদ ও আইনে। কিন্তু আমাদের দেশের পথশিশুরা এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত।
এদের জন্য রাষ্ট্রের কিছু করা উচিত। কয়েদিন পর ইদুল আযহা সবাই আনন্দ করবে৷ মাংস খাবে কত মজা করবে। কিন্তু তাদের কি হবে এই পবিত্র দিনে। তারাও তো আমাদের মতই মানুষ। তাদের মুখে কি জুটবে ভাল খাবার। আমাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত পথ শিশুদের পাশে। তারা যেন অন্য দশজন শিশুর মতই ইদে আনন্দ করতে পারে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি