Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে জি-৭ সম্মেলন

অলোক আচার্য
১০ জুলাই ২০২২ ১২:১৯

জার্মানির মিউনিখে ২৬ জুন থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত তিন দিন ব্যাপী আয়োজিত ৪৮ তম জি-৭ সম্মেলন বিশ্বকে করোনা পরবর্তী সময়ে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলাসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানের সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়েই শেষ হয়েছে। এই সম্মেলন এমন এক মুহূর্তে অনুষ্ঠিত হয়েছে যখন বিশ্ব রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। পৃথিবী এখন বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে রয়েছে- অর্থনীতি, জ্বালানির তীব্র সংকট, খাদ্য সংকট, শরণার্থী সংকট এবং আবশ্যিকভাবেই পরিবেশ বিপর্যয়। পৃথিবী এখন অর্থনৈতিক দুর্দশায় এবং মূল্যস্ফীতির কবলে অর্থনীতি ভুগছে।

বিজ্ঞাপন

এবারের এজেন্ডা হিসেবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা সংকটের মতো বিষয় উল্লেখ ছিল। বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির সাতটি দেশ ও একটি সংস্থা নিয়ে গঠিত এই জোটের কাছে বিশ্বের প্রত্যাশাও থাকে বেশি। পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেওয়া এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এসব দেশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি বিভক্ত বিশ্বে নেতৃত্বের ভবিষ্যতে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে এবং কোন পন্থায় অগ্রসর হবে তার করণীয় নির্ধারণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে এমন একটি অবস্থা বিরাজ করছে যেখানে সর্বত্রই অস্থিরতা। দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রাণহানির সাথে সাথে অতীতের তুলনায় বিপুল সংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ইথিওপিয়া, ইয়েমেন করোনা মোকাবেলার সাথে সাথে ব্যাপক হারে খাদ্য সংকটের কবলে পরেছে। শ্রীলংকার অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও নেই ভলো অবস্থায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আগুনে পুড়তে হচ্ছে সেখানেও। পৃথিবীকে এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

গত বছরের মূল সমস্যা ছিল করোনা ভাইরাস। এখনও সেই সমস্যা রয়েছেই। এ বছরের বড় সমস্যা হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যা পৃথিবীকে প্রায় থমকে দিয়েছে। করোনা মহামারীতে পৃথিবী বিপর্যস্থ হওয়ার পর পরই এই যুদ্ধ। বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকট এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছে যে বিকল্প জ্বালানির খোঁজে হন্য হয়ে উঠেছে। টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থা নির্ধারণ করতে চাইছে দেশগুলো।

শিল্পোন্নত দেশগুলোর সংগঠন হলো জি সেভেন। এর মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স, কানাডা, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশের প্রত্যেকেই অর্থনৈতিক, সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী এবং একত্রিত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তা ফলপ্রসু হওয়ার কথা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে পশ্চিমা দেশগুলোর একের পর এক নিষেধাজ্ঞার জেরে টালমাটাল অর্থনীতি। সম্মেলন থেকে তাই প্রত্যাশা ছিল বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের। গতবারের মতো এবারেও জি-৭ সম্মেলনেও আলোচনায় ছিল চীন প্রসঙ্গ। পৃথিবী ক্ষমতার দ্বন্দ্বে স্পষ্ট দুইভাগে বিভক্ত হতে চলেছে। যেখানে রাশিয়া-চীন ও পশ্চিমা দেশগুলো রয়েছে। মতবিরোধ এবং বর্তমান অশান্ত পরিস্থিতি দূর করতে এই সম্মেলন অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ছিল।

বিশ্ব এখন নানা কারণে সংকটে রয়েছে। বিভিন্ন দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভূরাজনীতি ক্রমেই অস্থিতিশীল এবং পরিবর্তন হচ্ছে। এককভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হওয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে মোড়ল দেশগুলো নিজেদের বলয় তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে গড়ে উঠছে শক্তিশালী বলয়। সেখান থেকেই নিজেদের কতৃত্ব খাটানোর চেষ্টায় নিজ নিজ প্রভাব খাটানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এবারের সম্মেলনে প্রথম ঘোষণা আসে ৬০ হাজার কোটি ডলারের পরিকাঠামোর তহবিল ঘোষণা। বইজিংয়ের ট্রিলিয়ন ডলারের প্রকল্প বিআরআই’র (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনফ্রাষ্ট্রাকচার ইনিশিয়েটিভ) এর পাল্টা হিসেবেই এই বিশাল প্রকল্প উন্নয়নশীল দেশের জন্য আসছে বলেই মনে করা হয়। এই পরিকল্পনার আওতায় রাস্তাঘাট নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন এগিয়ে নিতে নিন্ম ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে তহবিল দেওয়া হবে। জি-৭ এর সম্মেলনে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেন, চীনের বেল্ট এ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের টেকসই বিকল্প গড়ে তোলার জন্য পাঁচ বছরের ওই একই সময়সীমায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার বা ৩০ হাজার কোটি ইউরো সংগ্রহ করবে ইউরোপ। জি-৭ তহবিল থেকে এ্যাঙ্গোলায় ২০০ কোটি ডলার দিয়ে সোলার ফার্ম গড়ে তোলা, ৩২ ডলার দিয়ে আইভরি কোস্টে হাসপাতাল গড়ে তোলা হবে। এছাড়াও দক্ষিণ- চার কোটি মার্কিন ডলারে আঞ্চলিক স্তরে বিকল্প শক্তি বাণিজ্যকে উৎসাহ দেওয়া হবে। এখানে উল্লেখ্যা যে, চীন ২০১৩ সালে এই বিআরআই প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ১০০টির বেশি দেশ যুক্ত হয়েছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বরাবরই প্রতিযোগীতামূলক। চীন উঠতি পরাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্রমেই চীন তার প্রভাব বলয়ের বিস্তৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্য সংকটও গুরুত্ব পেয়েছে জোরেসোরেই। কারণ খাদ্যই মানুষের প্রথম ও সর্বপ্রধান মৌলিক চাহিদা। জি-৭ আলোচনায় নেতারা রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট খাদ্য সংকট থেকে বাঁচতে বড় আকারে খাদ্য মজুত রয়েছে এমন দেশ ও কোম্পানিগুলোকে মজুত ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। নেতারা বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবেলায় অতিরিক্ত সাড়ে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিশ্ব মোড়ল হওয়ার দৌড়ে যখন পরাশক্তিগুলো ছুটতে থাকে তখন প্রতিযোগীতামূলক পরিস্থিতি নতুন কিছু নয়। বলয় শক্তিশালী করার দৌড়ে চীন এখন অনেক এগিয়ে যাচ্ছে।

জি-৭ নেতাদের পরিকল্পনায় জলবায়ু ইস্যু এবং জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার বিষয়টিও আলোচনা করা হয়েছে। বৈশ্বিক তাপ মোকাবিলায় ইচ্ছুক দেশগুলো নিয়ে বছরের শেষ নাগাদ একটি ক্লাইমেট ক্লাব চালুর পরিকল্পনা প্রকাশ পেয়েছে। ক্লাবটি প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দেশগুলো নিয়ে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা এবং ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন করা। করোনা মহামারী পৃথিবীর সাময়িক সংকট। যা অন্য মহামারীগুলোর মতোই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে একসময়। কিন্তু জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে আমরা যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি এবং হতে যাচ্ছি যার ফলে আমাদের অস্তিত্ত্বই হুমকির মুখে তা বুঝতে পারছি। ফলে এটি ছিল অন্যতম প্রধান আলোচ্য ইস্যু। সব সদস্য দেশই তাদের কার্বন নিঃস্বরণ নীতিগতভাবে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রায় অর্ধেক কমিয়ে আনতে সম্মত হয়েছেন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উন্নত এবং উন্নত হওয়ার পথে অতিক্রমকারী প্রতিটি দেশকেই এই কার্বন নিঃস্বরণ মাত্রা কমিয়ে আনতে একসাথে কাজ করতে হবে। আবার তাদের কার্বন নিঃস্বরণের মাত্রার ফলে যে জলবায়ু প্রতিক্রিয়ার তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে তার ক্ষয়ক্ষতি বহন করতে হচ্ছে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র রাষ্টগুলোকে। তাদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলায় আর্থিক ক্ষতিপূরণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার পরিকল্পনা জি-৭ এর মতো উন্নত দেশগুলোর করা উচিত এবং বাস্তবায়ন করা উচিত। সেক্ষেত্রে সবাই একসাথে কাজ না করলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে সময় প্রয়োজন হবে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আরও ইতিবাচক ভূমিকাই প্রত্যাশা করে। জি-৭ এর শিল্পোন্নত দেশগুলোও চায় এই অবস্থার অবসান হোক। এজন্য এখন পৃথিবীতে যুদ্ধ, খাদ্য সংকট ইত্যাদি চেপে বসেছে। যুদ্ধ থামাতে হবে। যদিও তা থামার কোনোও লক্ষণই নেই। জি-৭ দেশগুলো এই যুদ্ধে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক খরচ চালিয়ে যেতে চায়। এমনকি রুশ সোনার ওপর আমদানি নিষেধাজ্ঞা আরোপেও একমত হয়েছে গোষ্ঠিটি। কিন্তু পৃথিবী এই সমস্যা থেকে মুক্তি চায়। খাদ্য ও জ্বালানির মতো সংকট থেকে রেহাই চায়। মোট কথা এ দেশসমূহকে পৃথিবীর স্বার্থে কাজ করতে হবে। জি-৭ এর দেশগুলোর ওপর পৃথিবীর আস্থার বাস্তবায়ন সময়ের দাবী।

লেখক: শিক্ষক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অলোক আচার্য মুক্তমত সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে জি-৭ সম্মেলন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর