Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তারে আমি চোখে দেখিনি

রহমান মৃধা
৯ জুলাই ২০২২ ১০:৪৮

রোজার ইদ চলে গেল বাড়ি যাওয়া হয়নি, এদিকে কোরবানির ঈদের আছে বাকি তিন দিন। কোরবানির ইদেও যে বাড়ি যাবো মনে হয়না। এমন একটি টেকস্ট করেছে সাইমুম।

আমি তাকে লিখলাম বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না?

উত্তরে সে জানালো, করে! কিন্তু, ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে তাই ভাবছি সময় নষ্ট না করে বরং, প্রস্তুতির উপরই থাকি।

আমি বললাম, প্রতিযোগিতার যুগে টিকে থাকতে অনেক সময় অনেক কিছু কোরবানি করতে হয়। তবে, একই সাথে এটাও মনে রাখা দরকার যে এখনকার এ সময়গুলো জীবনে ফিরে আসবে না।

কথা শেষ করে টেলিফোন রেখে দিলাম। সন্ধায় তাকে একটি লিখা পাঠিয়েছিলাম চেক করার জন্য, সে জানিয়েছে, বাইরে টিকিট কাটতে এসেছি, কাজ শেষে লিখাটি দেখব।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সে লিখার উপর ফিডব্যাক দিয়েছে। আমি একটু রসিকতা করে লিখলাম বাড়িতে নাকি ম্যাসে এখন?

সে উত্তরে লিখলো, আসলে নাইট কোচের টিকেট পাইনি। তাই বাইপাইলে এক ভাইয়ের বাসায় এসেছি। ভাই গার্মেন্টসে কাজ করেন। সবাই মিলে একটা বাস ভাড়া করে ঈদে বাড়ি যাবেন। এনাদের সাথে আমিও যেতে পারব ভাই বলেছেন। কি বলি স্যার? এনাদের জীবনের কথা। কি কষ্ট! কি কঠোর পরিশ্রম! অনেক কিছু শিখলাম এখানে এসেও। এলাকার অনেকেই এখানে খুব কষ্টের মধ্যে হলেই জীবিকার কারণে ঢাকা শহরের আশেপাশে আছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাথে ২৪ ঘণ্টা, যেনো একটা উপন্যাস। যাইহোক চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা হলো, আগে নিজে কোথাও একটু দাড়াই। ইনশাআল্লাহ, পরে এসব বিষয়ের উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।

সাইমুম একজন এইচএসসি জিপিএ গোল্ড পাওয়া ছাত্র নিজেই ম্যাসে থেকে সংগ্রাম করছে যেন ভালো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

কোরবানির ইদ, শুরু হয়েছে মানুষের ঘরে ফেরার পালা। তবে এ ফেরার যাত্রা সব সময় আনন্দের হয় না। কেননা, দুর্ঘটনার তো রয়েছেই। তারপর রাস্তার যানজট যাত্রাকে বিষিয়ে তোলে। এ থেকে মুক্তি দরকার। যাতায়াত সুবিধার জন্য সরকার নানা পদ্ধতি গ্রহণ করেছে বটে। কিন্তু তাতেও পুরোপুরি ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ইদ ছাড়াও সব সময়ই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় রাস্তায় চলে যাচ্ছে মানুষের।

সমস্যা হচ্ছে আমরা অতি সহজেই ভুলে যায়, যত সমস্যায় হোক না কেন কিছুদিনের মধ্যেই তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে নতুন সমস্যা এসে হাজির হয় ফলে পুরনো সমস্যা বিলীন হলেও তা আবার সময় মত ফিরে আসে। যেমন ট্রাফিক সমস্যা, যানযট সমস্যা, ইদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়া এবং ছুটি শেষে কাজে ফিরে আসার সমস্যা উল্লেখযোগ্য।

ইদে বাড়ি যাবার সু-ব্যবস্থা রাষ্ট্র আজ অবধি করতে পারেনি, অথচ আমরা দেশের অর্থ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিদেশে চালান দিয়ে বেগম পাড়া শেখ পাড়া সহ কত কিছু করছি!

যাক সে কথা এখন। আসি এখন কমপক্ষে পনেরো কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে। অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে জীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে। ভালো থাকা এবং পরিবার, বাবা-মা, ভাইবোনদের ভালো রাখার আশায়। সকাল থেকে সন্ধা শুধু কাজ আর কাজ, হোক না সে কাজ রিক্সা চালানো, গাড়ি ঠেলা, সুইপারের কাজ করা, হকারের কাজ করা, ফেরিওয়ালা হয়ে কেনা-বেচা করা বা গার্মেন্টস এ কাজ করা। বস্তিতে থাকা, একটা টয়লেট যেখানে চব্বিশ ঘন্টা লাইন, গোসলের কথা না হয় নাই বলি। এ জীবন জানিনা গ্রামের চেয়ে মধুর কিনা তবে প্রতিমাসে হাতে কিছু টাকা পাওয়া এবং সেই টাকা দিয়ে পুরো পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘুরানো যে শক্তি এরা পায় তার কাছে বস্তির জীবনের চেয়ে স্বস্তি আর কি হতে পারে!

বিজ্ঞাপন

সাইমুম তার নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে এসেছে সুদূর রংপুর থেকে ঢাকাতে সেই জানুয়ারী মাসে। সংগ্রাম করে চলছে বাবা-মা এবং ছোট ভাইবোন সহ নিজের জীবনের পরিবর্তন আনতে। হতাশা তাকে মাঝে মধ্যে ঘিরে ধরছে তারপরও সে সংগ্রাম করে চলছে। তবে কোরবানির ঈদে ঢাকা থেকে বাড়ি যাবার একটি বাসের টিকিট জোটেনি তার ভাগ্যে, ঠিক তেমন একটি হতাশা মনে নিয়ে ম্যাসে ফিরতে পথে দেখা মেলে গার্মেন্টসে কর্মরত তার এক ভাইয়ের সঙ্গে। সেই ভাইয়ের সঙ্গে এক মধুময় হৃদ্যতা ভরা সময় এবং এ সময়ে সাইমুমের জীবনে যে ঘটনাগুলো দেখার সুযোগ এসেছে তা সে এমনটি করে ব্যক্ত করেছে আমাকে। — গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাথে ২৪ ঘণ্টা, যেনো একটা উপন্যাস। উপন্যাস কিনা জানিনা তবে বাস্তবতার এক ঘটনা প্রবাহ বললে ভুল হবে না। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, তৈরি পোশাক কারখানা (গার্মেন্টস) বা এরকম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত বন্ধ করে দেওয়ার সুযোগ কম। তাদের শেষ বেলা অবধি কাজ চলতে থাকে। মালিকানা পক্ষ থেকে ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই তাদের ধাপে ধাপে ছুটি দেওয়া যেতে পারে বা কোম্পানিগুলো মিলে দূরের কর্মীদের বাড়ি পাঠাতে পারে।

হয়ত, সাইমুমের জীবনে এ ঘটনা দাগ হয়ে রবে আজীবন, হয়ত সাইমুম নতুন জীবন খুঁজে পাবে এ ঘটনার পর, হয়ত সাইমুম জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এই সমাজ, এই দেশ আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ এবং সে দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করবে যা আমরা পারিনি! — ওগো অভাগা দেশ, করিও ক্ষমা তোমাকে আমার মনের মত করে গড়তে পারলাম না আজও, তার জন্য। তবে নতুন প্রজন্ম পারবে সে বিশ্বাস আমি করি। যাইহোক সাইমুমের জীবনে ইদ বহুবার আসবে তবে স্মৃতির জানালা খুলে যখন জীবনের কোন এক সময় সে স্মৃতিচারণ করবে আমার বিশ্বাস, এবারের ইদ হবে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ইদ উদযাপন যেখানে থাকবে দুঃখ, কষ্ট, হাসি-কান্না, স্নেহ এবং গার্মেন্টস শ্রমিক ভাইদের প্রাণ ভরা ভালোবাসা।

সাইমুমকে আমি চোখে দেখিনি তবে তার সঙ্গে কথা বলেছি। সে সত্যিই ভাগ্যবান কারণ যে জার্নী সে করার সুযোগ পেয়েছে সবার ভাগ্যে এমন সুযোগ আসে না। কোরবানির ঈদ এমন একটি স্মৃতিভরা হোক সবার জীবনে যে স্মৃতির মধ্যে থাকবে শুধু ভালোবাসা এবং প্রীতি। সবাইকে ইদ মোবারক।

লেখক সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

তারে আমি চোখে দেখিনি মুক্তমত রহমান মৃধা

বিজ্ঞাপন

মানুষের হিংস্রতা কেন বাড়ছে?
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৪১

আরো

সম্পর্কিত খবর