Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দক্ষ জনশক্তি তৈরিতেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমাধান

অলোক আচার্য
১১ জুলাই ২০২২ ১৬:১১

অতিরিক্ত জনসংখ্যা পৃথিবীর জন্য সম্পদ না সমস্যা এটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এটা মূলত নির্ভর করছে সেই দেশ জনসংখ্যাকে কিভাবে গড়ে তুলছে। অর্থাৎ দেশের প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে কি না তার ওপর। অতিরিক্ত জনসংখ্যা যেমন একটি সমস্যা সেভাবেই জনসংখ্যা কমে যাওয়াটাও একটা সমস্যা। আসলে জনসংখ্যা কম নয় প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ করা। বৃদ্ধি হারকে শূণ্যের কোঠায় আনা নয় বরং কমিয়ে আনা। কারণ দেশের জন্য তরুণ জনগোষ্ঠী প্রয়োজন রয়েছে। এখন দেশ যদি তাদের দক্ষ বা যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারে তাহলেই জনসংখ্যা সম্পদে রুপান্তর করা সম্ভব হবে এবং তখন এটা কোনো সমস্যা না হয়ে সম্পদে পরিণত হবে।

বিজ্ঞাপন

জনসংখ্যা জনসম্পদে পরিণত করা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মানুষের জন্য উপযুক্ত কাজ নিশ্চিত করা, তাদের কাজে উৎসাহিত করা এবং এ লক্ষ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, প্রশিক্ষণ প্রদান, ঋণ বিতরণ ইত্যাদি কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রুপান্তরিত করতে সক্ষম হলে তা সম্পদ। আর এই সম্পদই হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় সম্পদ। অন্যান্য সম্পদ আমরা এখন যা ব্যবহার করছি তা কোনো না কোনো সময় শেষ হবে। কিন্তু মানুষ যদি চেষ্টা করে তবে এর বিকল্প মানুষই উদ্ভাবন করতে পারে।

বিজ্ঞাপন

এশিয়ার বৃহত্তম দেশ চীন বৃহৎ জনগোষ্ঠির দেশ। একসময় চীনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে এক শিশু নীতি চালু করে। এই জনগোষ্ঠীকে চীন জনসম্পদে পরিণত করার লক্ষ্যে ভালোভাবেই অগ্রসর হয়েছে। সেই সাথে টেনে ধরতে পেরেছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির লাগাম। একটি লক্ষ্য,পরিশ্রম এবং কর্মদক্ষতার কারণে চীন আজ বিশ্বে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এই যে নিম্ন জন্মহার- এর পেছনের কারণ হিসেবে দেখা যায় যখন একটি দেশ ক্রমাগত সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করে তখন প্রত্যেকেই নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ঝুঁকে যায়। ফলে বিয়ে এবং সন্তানধারণে ক্রমেই অনাগ্রহীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। পৃথিবী বিশাল জনসংখ্যা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এই জনসংখ্যা প্রতিটি মহাদেশে এবং প্রতিটি দেশে এক নয়। কোনো দেশ তার জনসংখ্যা বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে পেরেছে আবার কোনো দেশ চেষ্টা করছে। পৃথিবীতে শূন্য জনসংখ্যার দেশও রয়েছে। আবার অতিরিক্ত জনসংখ্যা নিয়ে হিমশিম খাওয়া দেশও রয়েছে।

সব দেশই তাদের জনসংখ্যাকে সম্পদে রুপান্তরের চেষ্টা করছে। কারণ দেশগুলো বুঝে গেছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করার পাশাপাশি জনসংখ্যাকে সম্পদে রুপান্তর করা। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বিষয়টি চ্যালেঞ্জের। এর কারণ হলো প্রতিটি দেশের সামর্থ সমান নয়। তাছাড়া যেসব দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি সেসব উন্নত দেশ নয়। ফলে দারিদ্রতা দূর করতেই দেশগুলো যখন হিমশিম খায় তখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির কাজটি বেশ কঠিন হয়ে যায়। কারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে অসচেনতা এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব থাকে যা জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। তাদের অনেকের মধ্যেই সব কিছু ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।

২০১৭ সালে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৯৮০ কোটি। একটা বিশাল জনসংখ্যা নিয়ে ধরণী এগিয়ে চলেছে। গত বছর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, আমাদের দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এমএসভিএবি (৩য়) প্রকল্পের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক ২০২০ প্রকাশনায় এ তথ্য জানানো হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালে দেশে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৮২ লাখ ২ হাজার জন। ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ ১ হাজার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩০। আমাদের জনসংখ্যার ক্রমাগত হারে বেড়েই চলেছে। জনসংখ্যা শব্দটির সাথে ‘বোঝা’ শব্দটি যোগ হয় তখন যখন প্রতিটি নাগরিককে কর্মদক্ষতার আওতায় আনা যায় না এবং এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্য দেশগুলোতে কম বেশী বিভিন্ন হারে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। এশিয়ার পরেই আফ্রিকা মহাদেশেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটছে।

পৃথিবীর অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় এশিয়া মহাদেশে জনসংখ্যার পরিমাণ বেশী। ভৌগলিক কারণও এর জন্য খানিকটা দায়ি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং চীনে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বসবাস করে। এক তথ্যে দেখা যায়, ২০২৭ সালেই ভারতের জনসংখ্যা খুব দ্রুতই চীনকে অতিক্রম করবে। বাংলাদেশও জনসংখ্যার অবস্থানগত দিক দিয়ে জনবহুল দেশের কাতারে অবস্থান করছে। এবং ঘনবসতীপূর্ণ রাজধানী হিসেবে আমাদের তিলোত্তমা নগরী ঢাকা নাম কয়েকটি শহরের পরেই শোনা যায়। বহু দিন ধরেই এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে যে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তবে উন্নয়ন কার্যক্রম কতটা ফলপ্রসু হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে উন্নয়নের একটি ঘনিষ্ট যোগসূত্র রয়েছে। উন্নয়নের স্বাদ প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত পৌছাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনার পাশাপাশি জন্ম ও মৃত্রুহারে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। জনসংখ্যা দারিদ্রতা সৃষ্টি করা কি না সেটা নির্ভর করে জনসংখ্যাকে কিভাবে তৈরি করা হয় তার ওপর। যেমন- প্রতিটি মানুষ যদি শিক্ষা লাভের আওতায় আসে, প্রযুক্তি জ্ঞানের অধিকারী হয় এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয় তাহলে সে নিজেকে সম্পদ হিসেবেই গড়ে তোলে। প্রতিটি মানুষই একজন সম্পদ। সেজন্য তাকে পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে। সব সময় রাষ্ট্রের এই সক্ষমতা পুরোপুরি থাকে না। ক্রমে তা অর্জন করতে হয়। বিশাল জনসংখ্যার চ্যালেঞ্জ নিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। তার সামর্থ্য আছে এবং সে দেশের জন্য কিছু করতে পারে। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সেই স্পৃহা আছে। যা অনেক ক্ষেত্রেই প্রকাশ পায় না। একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যখন তার সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে ব্যস্ত থাকে অর্থাৎ পরিশ্রমী থাকে তাহলে নিজ থেকেই তারা জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করবে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে যদি বাসস্থানের সুযোগ, কাজের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি, আবাদী জমি রক্ষা, পুকুর ডোবা ভরাট থেকে বিরত থাকা সহ নানা পদক্ষেপ নিতে না পারলে সমাজে নানা প্রতিবন্ধকতা আসবে। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য সবকিছুই প্রয়োজন যা একজন নাগরিক রাষ্ট্রের কাছে দাবি করতে পারে। ক্রমেই সেই চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। আজ যেমন পথশিশুরা অবহেলায় বা অনাদরে বড় হচ্ছে, যাদের এই সমাজে শিক্ষা থেকে সবকিছু পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা পাচ্ছে না। এ ধরনের অধিকার না পাওয়াদের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। যা আমাদের দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্থ করবে। সমাজে বিশৃঙ্খলার দেখা দিতে পারে, অস্থিরতা বাড়তে পারে, দ্বিধাগ্রস্থ যুবকের সংখ্যা বাড়তে পারে যারা আমাদের দেশের সম্পদ হতে পারে। কিন্ত তাদের সেই মেধা, সেই যোগ্যতা কাজে না লাগাতে পারলে জনসম্পদ রূপান্তর করা কঠিন হয়ে পরবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে সফল করতে হলে সবার মধ্যে চাই সচেতনতা। সচেতন না হলে কোন কার্যক্রমই ফলপ্রসু হবে না। ব্যার্থতার আবর্তেই সব ঘোরপাক খাবে। ১৬-১৭ কোটি মানুষের এই দেশে ইতিমধ্যেই জনসংখ্যার অতিরিক্ত বৃদ্ধিজনিত কারণে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাল্য বিবাহ রোধ করা জরুরী। যদিও অনেক গ্রামাঞ্চলে এই বিষয়টি আশংকাজনক হারেই হয়ে চলেছে। এই করোনা মহামারীর সময় এই সংখ্যা আরও আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিণত বয়স হওয়ার আগেই নাবালিকা গর্ভধারণ করছে। এতে সেই মায়ের ঝুঁকি বৃদ্ধির পাশাপাশি জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় এসব বিয়ে ঠেকানোর নানা খরব চোখে পরে। আবার চোখে পরে জেএসসি বা এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে অনেকেই অনুপস্থিত থাকে কেবল বাল্য বিয়ের কারণে। প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক ধারণা সুদুর গ্রাম পর্যায়ে পৌছাতে হবে। কারণ কুসংস্কার এবং অজ্ঞানতা থেকে বের করতে না পারলে সপ্ন অধরাই থেকে যাবে। আমাদের সম্পদ সিমিত। সীমিত সম্পদ দিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তার কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। এই সম্পদকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে। এ সম্পদকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের জন্য কর্তৃপক্ষ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়েই এ সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরী শিক্ষায় যথাযথ গুরুত্বারোপ করতে হবে। হাতে কলমে শেখার কোন বিকল্প নাই। জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করতে হলে অবশ্যই শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করতে হবে। তখন অতিরিক্ত জনসংখ্যা বোঝা না হয়ে বরং সম্পদে পরিণত হবে এবং দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

লেখক: শিক্ষক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অলোক আচার্য দক্ষ জনশক্তি তৈরিতেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমাধান বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর