শুধু অনুভবে হৃদয় চেনে গো হৃদয়ের বন্ধুরে!
১৫ জুলাই ২০২২ ২০:০৮
অনেকদিন বসে থেকেছি পথ চেয়ে একখানা চিঠির অপেক্ষায়। শেষে একখানা চিঠি এসেছিল, চিঠিতে বিরহের কথা লিখা ছিল, তো চিঠি পড়া শেষে বসে বসে ভাবছি, ‘তুমি না করেছ মোরে, বহু বছর পরে। আমি দুঃখ পাইনি বরং খুশি হয়েছি। কারণ আমি তোমার থেকে যে না উত্তরটা পেয়েছি এতেই আমি ধন্য।’ হঠাৎ কে যেন ঘরের দরজা নক করেছে। আমি দরজা খুলতেই দেখি বিনয়। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে বললো কি ব্যাপার তুমি খুশি হওনি আমাকে দেখে? আমার মুখ তখনও বন্ধ হয়ে আছে। ভাবনায় ঢুকেছে আমি কি তাহলে সত্যিই জিতেছি পরাজয়ের কাছে!
বিনয় আমার অতীতের ভালোবাসা। খুব ইচ্ছে ছিল দুজনে ভালোবেসে গড়ব সুখের ঘর, কিন্তু তা আর হলো না। পুলিশের চাকরি পেয়ে বিনয় শহর কেন্দ্রিক হলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিনয় অনেক বড় অফিসার হলো, অনেক কিছু পেলো শুধু হারালো আমাকে। বিনয়ের ধারনা ছিল তখন সবাই নাকি টাকার পাহাড়ে উঠতে চায়। সে ভেবেছিল আমাকে সে বিয়ে করে টাকার পাহাড়ে উড়াবে, কিন্তু আমি তো কখনও অসৎ পথে রোজকার করা টাকার পাহাড়ে উঠতে চাইনি!
যেদিন সে বিয়ের কথা বলেছিল, সেদিন তার ইনকাম ছিল বেতনের চেয়ে দশগুন। আমি বিনয়কে বলেছিলাম ওই টাকার পাহাড় তোমার না, ওটা দেশের জনগণের টাকা। বিনয় আমার কথা রাখেনি সেদিন। আমি বলেছিলাম যদি টাকার পাহাড়টা ভেঙ্গে চুরমার করতে পার তবে তুমি আমার বুকে এসো। সেদিন সে না করে দিয়েছিল আমাকে। তাই আমাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই বহুদিন ধরে।
হঠাৎ গণমাধ্যমে পড়েছে সাড়া, বিনয় হয়েছে দেশের সেরা পুলিশ সুপার। ফেলে এসেছে সেই পাহাড় ভরা টাকা। আজ তার সেই পূর্ণ পাহাড় হয়েছে শূণ্য শুধু আমাকে পাবার জন্য। বিনয় ঘরে ঢুকে বললো, ‘আমি শপথের বাণীতে কথা দিয়েছি দুর্নীতি করব না।’
তাহলে আমি কি এই ‘দুর্নীতি করব না’ কথাটির শোনার জন্য অপেক্ষা করে বসে ছিলাম বিনয়ের জন্য?
এতক্ষণ যার হৃদয়ের কথা শেয়ার করলাম তার নাম পুষ্পো। পুষ্পোর সঙ্গে প্লেনে দেখা, লন্ডন থেকে লস এঞ্জেলসের পথে, আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। হঠাৎ প্লেনে দেখা, সামান্য সময়ে এতসব কাহিনী গড় গড় করে বলতে লাগলো। বিষয়টি একটু অবাক করার মত! অবাক সেদিন আমিও যে হইনি তাও না। তবে আমি পুষ্পোকে চিনি সেই ১৯৮৪ সালে। এসএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেটের ইংরেজী কপি যশোর বোর্ড থেকে আনতে গিয়েছিলাম যশোরে। পুষ্পো সেদিন যশোর বোর্ডে ছিল, তার বাবার পাশে। মূলত তার বাবাই আমার কাগজগুলো সেদিন দ্রুততার সঙ্গে জোগাড় করে দেন। পুষ্পো তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। আমার বিদেশ যাত্রার গল্প তাকে নিশ্চিত আপ্লুত করেছিল। সেদিনের সেই ক্ষনিকের দেখা এবং পরিচয় মনের মধ্যে অমন করে আটকে থাকতে পারে কে জানতো তা!
আমি কাজের সুবাধে সুইডেন থেকে লন্ডন হয়ে লস এঞ্জেলসের পথে। আমার সিট বিসনেস ক্লাসে, পাশের ছিটে পুষ্পো বসে আছে। দশ ঘন্টার ফ্লাইট খুবই স্বাভাবিক যদি সুযোগ মেলে আড্ডা জমাবার তবে তাতে ক্ষতি কি? পুষ্পো চাকরি করে সিলিকন ভ্যালিতে কম্পিউটার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে, এসেছিল লন্ডনে বিসনেস পারপাজে। জিঙ্গেস করলাম, বিনয় এখন কোথায়? উত্তরে বললো সে বাংলাদেশ ছেড়ে কোন এক সময় অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দিয়েছে। বললাম, তাহলে তোমাদের দুজনার সম্পর্কের শেষ কীভাবে হলো? উত্তরে বললো, সম্পর্ক শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে যায়। বললাম মানে?
বিনয় দুর্নীতি ছাড়লেও দুর্নীতি তাকে ছাড়েনি। শেষে বিনয় রাতের অন্ধকারে দেশ ছেড়ে প্রথমে কলকাতা পরে সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমায়। আর আমি লেখাপড়া শেষে আমেরিকায় মামার কাছে চলে যাই। এখন আছি সানফ্রান্সিকোতে।
পুষ্পো লস এঞ্জেলস এয়ারপোর্টে বিদায় নেবার সময় হাতদুটি ধরে বলেছিল যেন বেড়াতে যাই তার ওখানে। যাবো যাবো করে আজও যাওয়া হয়নি। দূর থেকে তাই গানের লিপিকা গেয়ে যাই সুরে সুরে, আর ভাবি পুষ্পো কত দূরে!
বহু বছর পর হলেও আজ মনে পড়ে গেল সেদিনের সেই প্লেনে দেখার স্মৃতিটুকু হঠাৎ! মনে করিয়ে দিল অনেকটা প্রনব রায়ের কথাগুলো সুবল দাসগুপ্তের সুরে, ‘মনে পড়ে কবে অলখে আসিয়া, সহসা মোর চোখে, রাখিয়া কোমল করপল্লব শুধালে, শুধালে বল তো কে? আমি কহিলাম আজও কি জানো না, তুমি যে আমার সকল সাধনা, শুধু অনুভবে হৃদয় চেনে গো হৃদয়ের বন্ধুরে..!’
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মুক্তমত রহমান মৃধা শুধু অনুভবে হৃদয় চেনে গো হৃদয়ের বন্ধুরে!