জোরদারের ধান কেটে দিনমজুরের শ্রেণি সংগ্রাম
১৭ জুলাই ২০২২ ১৫:০১
ইতিহাস মোটাদাগে দুইভাবে রচিত হয়ে থাকে। ইতিহাসের দিকে তাকালেই সেটা আরো স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এক. শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের এক কথায় গরিব শ্রেণির ইতিহাস ; দুই. শোষকের অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণির ইতিহাস। কলম, কাগজ, গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সমস্তকিছু বুর্জোয়াদের দখলে ফলে ইতিহাস তারা তাদের মতো করে ছাপিয়েছে এবং ছাপাচ্ছে। শ্রেণি সংগ্রামের পক্ষে যেসব কবি, লেখক ইতিহাস কবিতায়, প্রবন্ধে, উপন্যাসের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন কিংবা ধরার চেষ্টা করেছেন সেসব পড়ে আমরা জানতে পারি। কিংবা আমাদের পাঠ্যবইয়ে যতটুকু প্রলেতারিয়েতের ইতিহাস পড়ানো হয় এর বাইরে বেশি কিছু জানতে পারি না, জানতে চাই না। মোটাদাগে যেসব ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে কিংবা বিভিন্ন লেখনীর মাধ্যমে পাওয়া যায় সেসব ইতিহাস বেশিরভাগ হয়ে থাকে জাতীয় পর্যায়ের অর্থাৎ সারাদেশের মানুষের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। এসবের বাইরেও কিছু কিছু অঞ্চলে মানুষ বাঁচার জন্য লড়াই সংগ্রাম করে জীবন দিয়ে ইতিহাস রচনা করে। এসব ইতিহাস ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায় না। ফলে জানতে পারি না আমৃত্যু লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন দানের ইতিহাস, লড়াই সংগ্রামের সময় জোরদার কিংবা লেলিয়ে দেওয়া প্রশাসন দিয়ে বিপ্লবীদের নির্যাতন আর নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের ইতিহাস। জানতে পারি না এতো নির্যাতনের পরেও দেশের বঞ্চিত, শোষিত মানুষের জন্য লড়াই সংগ্রাম করে যাওয়া বিপ্লবীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ইতিহাস। ইতিহাসের বড় বড় বইয়ের পাতায় জায়গা হয়নি কিন্তু এখনো মানুষের মুখে শোনা যায় তৎকালীন জোরদারের ধান কেটে গোলা দখল করে শ্রেণি সংগ্রামের কথা, সর্বস্ব হারানো দিনমজুর কৃষক আন্দোলনের কথা, খেটে খাওয়া মানুষের সংগ্রামের কথা; সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া যেসব মানুষ এখনো বেঁচে আছেন আর সেসময়কার সংগ্রামের কথা জিজ্ঞেস করলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভারিকণ্ঠে বলতে থাকেন।
সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে জমিজমা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের হাতে চলে যায়। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে জমিদারেরা কৃষকদের জমি হাতিয়ে নেয়। চাহিদার তুলনায় জমি কম এবং যতটুকু জমি আছে তাতে যে পরিমাণ ফসল উৎপাদন তা দিয়ে সংসার চালানো একেবারে অসম্ভব। ফলে কৃষকেরা আস্তে আস্তে বর্গাচাষী হয়ে যায়। জমিতে যে ফসল আসতো তা বর্গা দিতেই শেষ হতো। ফলে কৃষকেরা দিনে দিনে নিঃস্ব হয়ে দিনমজুর হয়ে যায়। একদিকে কৃষক সবকিছু হারিয়ে বেঁচে থাকার জন্য পরিবারে খাদ্যের জোগান দিতে না পারায় দীর্ঘদিন না খেয়ে অনাহারে থাকতে থাকতে গায়ের চামড়া হাড্ডির সাথে মিশে কঙ্কালে পরিনত হয়েছে অপরদিকে কৃষকের জমি কৌশলে হাতিয়ে নেওয়া জমিদারের বিঘা বিঘা ফসল দিয়ে বাড়ির বড় বড় গোলা (ফসল রাখার স্থান) ভর্তি হয়ে অতিরিক্ত ফসল এঘর থেকে সেঘর গুরুত্বহীনভাবে পরে বেড়ায়। একদিকে বেশিরভাগ মানুষ না খেয়ে মরছে আরেকদিকে কিছুসংখ্যক মানুষ খাবার খেতে না পেয়ে ফেলে দিচ্ছে, নষ্ট করে ফেলছে। কিছুসংখ্যক মানুষ সমাজে সংকট তৈরি করে যখন নিজের সম্পত্তি বাড়াতে চায় তখন তাঁদের সেই কৌশল দীর্ঘদিন বা জুগ জুগ ধরে বিরাজমান থাকে না। মানুষ প্রতিবাদ শুরু করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অনিয়মের শৃঙ্খল ভাঙতে আন্দোলন করে, লড়াই করে। এমনটাই ঘটেছিলো দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৫-৭৬ সালে দেশের উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর রংপুর জেলার চারটি উপজেলায়। অবিভক্ত রংপুর জেলার ডিমলা, মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ, কালীগঞ্জ এই চারটি উপজেলায় জোরদারের ধান কাটা গোলা দখল আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিলো। স্বাধীন দেশে যেই কৃষকেরা সবকিছু হারিয়ে দিনমজুরে পরিনত হয়েছে তাঁরা নতুন করে সংগঠিত হয়েছিলো, জমিদার আর জোরদারের বিরুদ্ধে স্বশরীরে আন্দোলনে নেমেছিলো। সবার মাথায় লাল টুপি; এক হাতে মাথা সমান বাশের লাঠি আর লাঠির মাথায় লাল পতাকা বাঁধা, আরেক হাতে ফসল কাটা কাঁচতে। সেদিন বৃহত্তর রংপুর জেলার গোটা অঞ্চলের লক্ষাধিক (আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের মতে শুধু ডিমলা থানায় পনেরো থেকে বিশ হাজার) দিনমজুর কৃষক এক হয়ে স্লোগান তুলেছিলো, দুনিয়ার মজদুর এক হও!, লাঙল যার জমি তার, জয় সর্বহারা ইত্যাদি। সেই সময়ে ধান কাটা আন্দোলন দেখা মানুষ গুলো এখনো সাক্ষী দেয় চার থানার জোরদারের ধান ক্ষেত লাল টুপি ওয়ালা মানুষের দখলে। তারা একই স্লোগান ধরে ধান কাটতে নামে। তাদের আন্দোলন মূলত ছিলো জমিদার জোরদারের বিরুদ্ধে। যেদিন ধান কাটতে নামে তার আগের দিন সন্ধ্যায় এলাকার সমস্ত বাজারে ঘোষনা দিয়ে সকল মানুষকে আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। জমিদার জোরদারদের ধান কেটে অনাহারে থাকা মানুষের মাঝে বন্টণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি। লক্ষাধিক মানুষের হাতে লাল পতাকা জোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়লে বিপ্লবীরা এক অভিনব পদ্ধতির মাধ্যমে লাল পতাকা তৈরি করেন। বিভিন্ন জনের বাড়ি থেকে সাদা কাপড় সংগ্রহ করে পতাকার আকারে কাপড় কাটেন । হলুদ আর চুন একত্রে মিশিয়ে লাল রঙ তৈরি করে তাতে সাদা কাপড়ের টুকরোগুলি চুবিয়ে লাল পতাকা তৈরি করেন। ডিমলা থানায় এই সব প্রস্তুতি চলেছিলো কমরেড শহিদুলের বাড়িতে; অন্যান্য অঞ্চলে কোথায় প্রস্তুতি চলেছিলো সময়ের স্রোতে মানুষ ভুলে বসেছে। পরের দিন সকাল হতে না হতেই সমস্ত দিনমজুর কৃষক লাল পতাকা বাঁধা লাঠি আরেক হাতে কাঁচতে এবং মাথায় লাল টুপি পড়ে ধনী অর্থাৎ জোরদারের ধান কাটতে নামে। বাঁধাহীনভাবে মানুষ ধান কেটে যায়। একে একে এলাকার সমস্ত জোরদারের ধান মানুষ কেটে নিয়ে যায়। কারণ মানুষের ঘরে খাবার মতো তেমন কিছুই নাই। লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখে জোরদাররা ভয়ে সেদিন বাড়ির বাইরে বেড় হয়নি। তাৎক্ষণিক কিছু না বললেও পরবর্তীতে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বিপ্লবীদের নামে মামলা দেয়। ফলে বাড়ি ছাড়া হয়ে পরলে তাদের পরিবারে নেমে আসে কঠিন দিন। কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার পেছনে প্রথম ভুমিকা পালন করেন রংপুরের কমরেড বুলু। পরবর্তীতে নেতৃত্ব দেন কমরেড মনীর উদ্দিন ভাসানী, শহিদুল, তবিবুল, হামির পালোয়ান, খোজা, জব্বার, খয়রদ্দিন, আমনুর, জছিয়ার, খতিবর রহমান, দুলাল প্রমুখ। নেতৃত্ব দেওয়া বিপ্লবীদের মধ্যে শতশত নেতাকর্মীদের নামে মামলা দায়ের করে। তার মধ্যে ডিমলা থানায় ছাব্বিশ জন। শুধু মামলা দিয়ে হয়রানি করেই থেমে থাকেননি নেতাদের ঘরসহ ঘরে থাকা আসবাবপত্র সমস্তকিছু জোরদার আর প্রশাসন মিলে লুট করে নিয়ে যায়। ফলে তাঁদের পরিবার একেবারে সর্বহারা হয়ে পড়ে। পুলিশের হাতে ধরা দিবে না এককথায় আত্মসমর্পণ করবে না বলে বিপ্লবীরা দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় পুলিশের সামনে পড়লে আত্মসমর্পণ না করে কখনো নদীতে লাফ দিয়ে সাঁতার কেটে জীবন বাঁচাতো, কখনো ফসলের জমিতে ঢুকে আত্মগোপন করতো, কখনো কাঁটাযুক্ত জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে জীবন রক্ষা করতো, কখনো কখনো কারো হাতে-পায়ে গুলি লাগতো। আহত সহযোদ্ধাদের নিয়ে ৫০ কিলো হেটে নিরাপদ স্থানে যেত বিপ্লবীরা। যেদিন বিপ্লবী খয়রদ্দিনের হাতে গুলি লেগে এপার থেকে ওপার ছিদ্র হয়ে যায় সেদিন প্রথম গ্রেফতার হয়েছিলেন উমর আলী ও মমদালী। এখন তাঁরা বেঁচে আছেন। একে একে প্রায় সবাইকে গ্রেফতারের পর কারাগারে নির্মমভাবে নির্যাতন চালায়। গ্রেফতারের পর তাদের কিরকম অত্যাচার নির্যাতন করা হয়েছিলো তার বনর্না দিতে গিয়ে বেঁচে থাকা বিপ্লবীদের চোখে পানি আসে।
যেসব জোরদারদের ধান কাটা হয়েছিলো তাদের মধ্যে হলেন হেপাজ চৌধুরী, আইজার চৌধুরী, আকশা হাজী, মতিরা সুরি, উমর আলী সুরি প্রমুখ। বিপ্লবীদের বিপ্লবী কর্মকান্ড দমানোর জন্য জোরদারদের শোষণমূলক কাজ চলমান রাখার জন্য বিপ্লবীদের নামে মিথ্যা অস্ত্রের মামলা ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। শোষিত, বঞ্চিত, দিনমজুর সর্বহারা কৃষকদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে বিপ্লবীদের মামলা খাইতে হয়েছিলো যা দীর্ঘ দশ বছর ধরে চলতে থাকে। মামলা চলাকালিন বুর্জোয়ারা দিনমজুর নেতাদের দল পরিবর্তন করা সহ নানা রকম লোভ দেখিয়ে বিপ্লবী চেতনা থেকে সরে আসতে বলে। কিন্তু বিপ্লবীরা তা করেননি। বুর্জোয়াদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলো। মামলার রায়ে বিপ্লবীদের জয় হয়, হেরে যায় জোরদার বুর্জোয়ারা। পরবর্তী জীবনে বিপ্লবীরা আজীবন বিপ্লবী কাজের সাথে যুক্ত থাকেন এবং যারা বেঁচে আছেন তারা এখনও বিপ্লবী চিন্তা ধারা লালন করেন। শ্রেণি সংগ্রামের অংশ হিসেবে জোরদারের ধান কাটা আন্দোলনের সকল যোদ্ধাদের লাল সালাম।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
জাফর হোসেন জাকির জোরদারের ধান কেটে দিনমজুরের শ্রেণি সংগ্রাম মুক্তমত