Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সমৃদ্ধির পথে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সেতু চাকমা
১৭ জুলাই ২০২২ ১৯:১৭

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য; প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত। ইতোপূর্বে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার বিস্তার, কারিগরি শিক্ষা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা ব্যবস্থা জোরদার এবং তা আধুনিকায়নের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে দক্ষ মানব সম্পদের চাহিদা পূরণে ২০০১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সরকার ১১টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করে ও তা জাতীয় সংসদে পাস করে। রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সেগুলোর একটি; এটি জুলাই ১৫, ২০০১ সালের ৩৯ নম্বর আইন। উক্ত ১১টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে কিন্তু অক্টোবর ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠা ও আইন কার্যকরে স্থবিরতা দেখা দেয়। তবে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩০ টি আসনে জয়ী হয়ে আবার সরকার গঠন করলে উক্ত ধারাবাহিকতায় ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সালে একনেক (ECNEC) সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তার অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কার্যক্রম পুনরায় শুরুর লক্ষ্যে ১১৬.৪৭ কোটি টাকার স্থাপন-প্রকল্প অনুমোদন করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ডিজাইন ও কাঠামো হবে পৃথক; পাহাড় না-কেটে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণপূর্বক পাহাড়ের গা-ঘেষে একাডেমিক-প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ এবং প্রয়োজনে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জনসংযোগ ব্যবস্থার নির্দেশনাও প্রদান করেন।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সালে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। সেই ধারাবাহিকতায় ২৪-জুলাই ২০১৩ সালে প্রকল্প পরিচালক এবং ২৩ জানুয়ারি, ২০১৪ সালে ভাইস-চ্যান্সেলর পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রফেসর ড. প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমাকে নিয়োগ প্রদান করেন। তৎকালীন মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমার পৃষ্ঠপোষকতায় এবং রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি জনাব দীপংকর তালুকদার (বর্তমানে রাঙ্গামাটি জেলার ২৯৯ নং আসনের সংসদ সদস্য ও সংসদীয় খাদ্য কমিটির চেয়ারম্যান), চেয়ারম্যান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রফেসর আবদুল মান্নান, জেলা প্রশাসক মোঃ সামসুল আরেফিন (বর্তমানে সচিব, সমন্বয় ও সংস্কার, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ) এবং পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান (০৩/১২/২০২০ খ্রি: তারিখে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেছেন) এর সহযোগিতায় নভেম্বর ৪, ২০১৭ সালে প্রাথমিকভাবে ৬৩.৭২৫০ একর জায়গা রাঙ্গামাটি সদর পৌরসভার মধ্যে অধিগ্রহণ করা হয়, যা রাঙ্গামাটি শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণে রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই লিংক রোডের পাশে ঝগড়াবিল নামক মৌজায় অবস্থিত।

বিজ্ঞাপন

নবীন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে এবং জেলার সুশীল সমাজ, প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় নভেম্বর ০১, ২০১৫-এ একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ২টি অনুষদের অধীনে সিএসই, ম্যানেজমেন্ট এই ২টি বিভাগে ৮৫ জন শিক্ষার্থী, ৬ জন কর্মচারী নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে।

বর্তমানে ৭১৭ জন শিক্ষার্থী ২৮ জন শিক্ষক, ২৬ জন কর্মকর্তা এবং ৫৯ জন কর্মচারী আছেন। ৭ বছর বয়সী প্রতিষ্ঠানটি তরুণ শিক্ষক তাদের শিক্ষা, গবেষণা, প্রজ্ঞা, পাঠদান পদ্ধতি এবং দক্ষ প্রশাসনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির রুপকল্প, আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর উচ্চশিক্ষা প্রসার, সম্প্রীতি নিশ্চিতকরণ এবং উন্নতি সাধনের লক্ষে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে ৩টি অনুষদের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫টি বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধীনে ‘সিএসই’ বিভাগ, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অধীনে ‘ম্যানেজমেন্ট’ এবং ‘ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’ বিভাগ, জীববিজ্ঞান অনুষদের অধীনে ‘ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স’ বিভাগ ও ‘ফিশারীজ এন্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজী’ বিভাগ চলমান রয়েছে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা আলপার ডজার (এডি) সায়েন্টিফিক ইনডেক্স র‌্যাংকিং ২০২২ এ বিশ্বসেরা গবেষকের তালিকায় স্থান পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন শিক্ষক। বর্তমানে বিশ্ববিদালয়ের ২ জন পিএইচডি এবং ২ জন এমফিল ডিগ্রী প্রাপ্ত শিক্ষক রয়েছেন। এছাড়াও ৩ জন শিক্ষক পিএইচডি-তে বাংলাদেশের সনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ জন কর্মকর্তা শিক্ষা ছুটিতে অস্ট্রেলিয়া অ্যাওয়ার্ড স্কলারশিপ নিয়ে মাষ্টার্সে অধ্যয়নরত আছেন এবং ২ জন শিক্ষক সংশ্লিস্ট দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি-তে জাপান ও আমেরিকা যাবেন।

এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ২টি ব্যাচ স্নাতক পর্যায়ে এবং ১টি ব্যাচ মাষ্টার্স পর্যায় সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে স্থায়ী ক্যাম্পাসে ২টি একাডেমিক ভবন, ২টি প্রশাসনিক ভবন, ১টি সেন্ট্রাল লাইব্রেরী, ১টি ক্যাফেটিরিয়া ও বঙ্গবন্ধু ম্যুারাল স্থাপনা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ছাত্র-ছাত্রীদের যানবাহন সুবিধা পর্যাপ্ত না থাকলেও বর্তমানে ৩টি বাস এবং ভাড়ার বাস দিয়ে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে।

কোভিড পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশোধিত ডিপিপি-তে ১৪৫ কোটি ৫৮ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকার কাজের কার্যক্রম ব্যহত হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১টি ৩তলা বিশিষ্ট একাডেমিক ভবন, ১টি করে তিন তলা বিশিষ্ট ছাত্র-ছাত্রী হল ও ১টি প্রশাসনিক ভবনের কার্যক্রম ছিল। এই প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল সার্ভে ও মাস্টার প্ল্যান কাজের লক্ষ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থ বছরের জন্য ইউজিসি কর্তৃক ১২৩৭ লক্ষ টাকা রাজস্ব বাজেট বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে রাঙ্গামাটি তথা পার্বত্য অঞ্চলের শিক্ষা ও অর্থনীতিতে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। যার ফলে পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষার মান উন্নত হচ্ছে এবং অত্র অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও পার্বত্য অঞ্চলের বসবাসকারী বাঙ্গালিদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের প্রতি আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার অধিবাসীদের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নতি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও আবাসন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি সাধন করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে সুনাম অর্জন করেছে। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক ও ক্রিয়া প্রতিযোগিতায় রাবিপ্রবি সক্রিয় অংশগ্রহণ করে থাকে। এছাড়াও ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের আওতাধীন ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২২তম স্থান এবং ১০ টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৬তম স্থান অর্জন করে।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পদ শূন্য থাকায় প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. কাঞ্চন চাকমা রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এবং মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি এ বছরের ০১ ফেব্রুয়ারিতে যোগদান করেন। তার দিক নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যাক্রমের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দক্ষ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ, লাইব্রেরীতে সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, ক্যাফেটেরিয়া চালুকরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তারই নেতৃত্ব্বে প্রথম ১৫ জুলাই ২০২২ তারিখে ‘রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও উপস্থিতিতে উদযাপন করা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের শুভেচ্ছা এবং শিক্ষা, গবেষণা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও বন্ধুত্ব ও সম্প্রতির মাধ্যমে রাবিপ্রবি উন্নতি সাধন করুক; শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিক এই কামনা করছি।

লেখক: সহকারী রেজিস্ট্রার, রাবিপ্রবি

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

মুক্তমত সমৃদ্ধির পথে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সেতু চাকমা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর