Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রতিবন্ধীদের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব

কবিতা রাণী মৃধা
১৮ জুলাই ২০২২ ১৪:৩৩

বৈচিত্র্যময় উপাদান নিয়ে মানব সমাজ গঠিত। সমাজের সদস্যদের মধ্যে বৈচিত্র্য আরো বেশি। সমাজে বসবাসরত মানুষদের মধ্যে পৃথক পৃথক সত্ত্বা বিদ্যমান। অভ্যন্তরীণ গুণাগুণ, দোষ-ত্রুটি ছাড়া বাহ্যিকভাবেও রয়েছে অনেক পার্থক্য। মানুষের মধ্যে কেউ লম্বা, কেউ খাটো, কেউ ফর্সা, কেউ কালো আবার অনেকেই আছে এমন যাদের মধ্যে কারো হাত নেই কারো পা নেই, কারও বা দৃষ্টি শক্তি নেই। আবার অনেকে কানে শোনে না কথাও বলতে পারে না। সমাজে এসব মানুষ হলো ব্যতিক্রম। এদেরকে সাধারণভাবে প্রতিবন্ধী বলা হয়।

বিজ্ঞাপন

স্বাভাবিক মানুষের বাইরে যেসব মানুষের শারীরিক ও মানসিক ত্রুটির কারণে জীবনের স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত তাদের বলা হয় প্রতিবন্ধী। অন্যভাবে বলা যায় জীবনে চলার পথে স্বাভাবিক কাজকর্ম ও চিন্তা করতে যাদের প্রতিবন্ধকতা আছে তাদেরকেই প্রতিবন্ধী বলা হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)-এর মতে ‘একজন প্রতিবন্ধী হচ্ছেন তিনি, যার স্বীকৃত শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিগ্রস্ততার দরুন যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানের প্রত্যাশা কমে যায়।’ জাতিসংঘের প্রদত্ত সংজ্ঞানুযায়ী প্রতিবন্ধীতা হলো এমন কোনো বাঁধা বা সীমাবদ্ধতা (শারীরিক বা মানসিক ক্ষতিগ্রস্ততার কারণে উদ্ভুত), যা একজন মানুষের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে পুর্ণভাবে ব্যাহত করে। আবার অন্যভাবে বলা যায়, কতিপয় প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যক্তি যদি সামাজিক নেতিবাচক মনোভাব ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার দরুন স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাঁধার সম্মুখীন হয় তাহলে তাকে প্রতিবন্ধী বলা হয়। মোট কথা, বয়স, লিঙ্গ, জাতি, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী আর দশজন যে কাজগুলো করতে পারে অসামর্থ্যরে কারণে সে কাজগুলো প্রাত্যহিক জীবনে করতে না পারার অবস্থাই হলো প্রতিবন্ধীতা।

বিজ্ঞাপন

সমাজে প্রতিবন্ধীদের অবস্থান অত্যন্ত অবহেলিত। পরিবার থেকে শুরু করে সব স্থানেই প্রতিবন্ধীদেরকে খাটো করে দেখা হয়। আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতো প্রতিবন্ধীদের সামাজিক সব অধিকার ভোগ করার কথা থাকলেও বরাবরই তারা তা থেকে বঞ্চিত। আত্মীয়-স্বজন সামাজিক মান মর্যাদার ভয়ে তাদের দূরে সরিয়ে রাখেন। সমাজে তাদের অবাধ চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। শিক্ষা, চাকরি, কর্মসংস্থান, বিয়ে, স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার হয়। বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যের শিকার হয়ে তারা সমাজে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে পারে না।

যেকোনো মানুষের সামাজিক অবস্থান তৈরি হয় পরিবার থেকেই। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে একথা আরো বেশি প্রযোজ্য। আমাদের দেশের প্রতিবন্ধীরা কোনো না কোনোভাবে পরিবারে অবহেলার শিকার। তবে কোনো পরিবারে বেশি, কোনো পরিবারে কম। অবহেলার কারণে প্রতিবন্ধীতাকে অভিশাপ মেনে নিয়ে তারা অবহেলিত বঞ্চিত জীবনযাপনে বাধ্য হয়। দরিদ্র পরিবারগুলোতে প্রতিবন্ধীদের অবস্থা আরো করুণ। অনেক সময় তাদের অনাহার অর্ধাহারে থেকে দিন পার করতে হয়। অধিকাংশ পরিবারেই প্রতিবন্ধীদের বোঝা হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদেরকে অবহেলায় পিছনে ফেলে রেখে সমাজ এগিয়ে যাবে তা কখনই সম্ভব নয়। সমাজের অংশ হিসেবে তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। এ দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করলে প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয় বরং সম্পদে পরিণত হবে। প্রতিবন্ধীদের প্রতি আমাদের যে দায়িত্বগুলো আছে তার আলোচনা করা হলো- দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: প্রতিবন্ধীদের প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রথম করণীয় হলো তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। অনেক বাবা মা আছেন যারা তাদের প্রতিবন্ধী শিশুদের বাইরে আনতে এবং অন্য শিশুদের সাথে মিশতে দিতে লজ্জা পান। কিন্তু আমাদেরকে এ ধরণের মন মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতিবন্ধীদেরকে সামাজিক স্বীকৃতিদান: প্রতিবন্ধীদেরকে সমাজের অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে। সামগ্রিক সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিবন্ধীদের স্বীকৃতি দিতে হবে। সমাজের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে তাদেরকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তাদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার ব্যবস্থা: বাংলাদেশে ৯৭% শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও মোট প্রতিবন্ধী শিশুদের মাত্র ১১% স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায়। যা সময়ের প্রেক্ষাপটে খুবই নগণ্য। এ জন্য প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধীতার ভিত্তিতে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।চিকিৎসা ক্ষেত্রে দায়িত্ব: বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিবন্ধীদের জন্য হুইল চেয়ার প্রবেশ করার মতো ঢালু পথ নেই। যা খুবই দুঃখজনক। প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা দেশের সর্বত্র বিনামূল্যে করা, চিকিৎসকদের চেম্বারে দেখানোর ক্ষেত্রে, তাদেরকে আগে সুযোগ করে দেয়া আমাদের সকলের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা: ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য মাসিক ২০০ টাকা হারে বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করে। কিন্তু এ ভাতা বর্তমান সময়ের তুলনায় অনেক কম। তাই এ ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করে প্রতিবন্ধীদেরকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতার পরিধি বাড়াতে হবে।আর বর্তমান সময়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাসিক ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মাসিক ৭৫০ টাকা হারে ভাতা পান। এই ভাতা ১০০ টাকা বাড়িয়ে মাসিক ৮৫০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিবন্ধী ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

চলার পথে সহায়তা করা:
আমাদের চলার পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধী দেখতে পাই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদেরকে রাস্তা পারাপারে, শারীরিক প্রতিবন্ধীদেরকে হাত ধরে বা অন্যভাবে সহযোগিতা করা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব। এছাড়া আরো কিছু দায়িত্ব হলো-
• সামাজিক গণসচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে।
• প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানে আলাদা শিল্প কারখানা স্থাপন করা উচিত।
• শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
• প্রতিবন্ধীদের বিনোদনের জন্য তাদের উপযোগী খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে।
• চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী কোটা বৃদ্ধি করা উচিত।
• প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষায় বিশেষ আইন প্রণয়ন করে তার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজে অবহেলিত ও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বঞ্চিত। অনেকের পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। জীবনযাত্রার মান অনেক নিম্ন। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে এতো বিপুল সংখ্যক প্রতিবন্ধীকে পুনর্বাসন করা অত্যন্ত দূরহ। তাই সমাজের সচেতন সকল স্তরের বিশেষ করে বিত্তবান মানুষদের প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে এগিয়ে আসা উচিত।

লেখক: শিক্ষার্থী

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

কবিতা রাণী মৃধা প্রতিবন্ধীদের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর