ময়মনসিংহের কী কোনো অভিভাবক নেই?
১৮ জুলাই ২০২২ ১৫:২৭
ইতিহাস ঐতিহ্যের শহর ময়মনসিংহ। বর্তমানে প্রাচীন এই নগরী বিভাগীয় শহর হিসেবে পরিচিত। যদিও অবকাঠামোগত দিক বিবেচনায় বিভাগীয় শহর বা সিটি করপোরেশনের মর্যাদা দেয়ার মতো অবস্থা নেই। সময়ের কারণে কাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়াই বড় রকমের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন জাগবে মর্যাদা দেয়ার পরেই তো উন্নয়ন হয়। পরিকল্পিতভাবে সবকিছু গড়ে ওঠে। একথাও মেনে নিলাম। মর্যাদা লাভের পর তা কী হয়েছে? ঢাকার মতোই নাগরিক নানা ভোগান্তির শহর ময়মনসিংহ। দেখলে মনে হবে এই শহরে কোন অভিভাবক নেই। মেয়র নেই। প্রশাসন নেই। চারদিকে নেই আর অভাবের ধ্বণি।
পরিকল্পিত শহর গড়ে তোলার কোন চিন্তা নেই। শহরজুড়ে এক ধরণের অরাজগতা, সংকট দিন দিন মাত্রা ছাড়াচ্ছে। কোন কোন সমস্যা নাগরিকদের জন্য মহা অশান্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তাহলে কী নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়? এ প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এই শহরকে সিটি করপোরেশন ঘোষণা দেয়া হয় ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর। ২০১৯ সালের পাঁচ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রথম সিটি মেয়র হিসেবে জয়লাভ করেন তরুণ রাজনীতিক মো: ইকরামুল হক টিটু। মাত্র তিন বছর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অল্প সময়ে পরিকল্পিত নগরী কতোটুকুই বা উপহার দিতে পারবেন? আকাশ কুসুম কল্পনা করে লাভ নেই।
কথা হলো এর আগে বহু বছর ‘ময়মনসিংহ’ পৌরসভা ছিল। পৌরসভা বা সমমর্যাদার প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস একশত ৭০ বছরের বেশি। অথচ একটি পরিকল্পিত শহর গড়ে তোলার ভাবনা দীর্ঘ সময়েও কারো মাথায় আসেনি। নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে ময়মনসিংহ বস্তির নগরীতে রুপ নিয়েছে! আজ এখানে পরিকল্পিত শহর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। তবুও হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না।
চিকিৎসা আর শিক্ষার নামে অবাধ বাণিজ্যের শহরে রুপ নিয়েছে ‘ময়মনসিংহ’। এই শহরে বেশিরভাগ অস্থায়ী বাসিন্দা। এরমধ্যে একটি অংশ রয়েছে উন্নত শিক্ষার জন্য এসেছেন। শহরের মধ্যেই রয়েছে নামকরা একটি কৃষি বিশ^বিদ্যালয়। যেখানে সারাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে আসেন। অপরিকল্পিত নগরায়ন আর নানা ভোগান্তির কারণে তাদের মধ্যেও তো এই শহর সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা থেকে যাবে।
একটি শহর যখন নামের দিক থেকে বেশি পরিচিতি পায়, তখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের নাগরিকরা নানা সুবিধার প্রয়োজনে এসে উন্নত নাগরিক জীবনের আশায় ভীড় করবে এটাই স্বাভাবিক। গ্রাম থেকে আসা নাগরিকরা কিন্তু জানেন না কিভাবে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হয়। পরিকল্পিতভাবে বাড়ি বানাতে হয়, কিভাবে পরিবেশ সুরক্ষায় নিজেকে কাজে লাগানো যায়। সর্বোপরি নাগরিক দায়িত্ববোধ আসলে কী হতে পারে?
এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন আর জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসনকেই মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হয় এটাই নিয়ম। দুনিয়ার সব শহরেই একই নিয়ম। পাশের দেশ ভারতের যেসব শহর দূষণ আর বসবাসের অযোগ্য ছিল, সেখানেও কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাক করা গেছে অল্প সময়ের মধ্যেই। দূষণ কমিয়ে নাব্যতা ফিরিয়ে এনে নদীর পানি পর্যন্ত ব্যবহারের উপযোগি করা হয়েছে।
তবে আমারা কেন পারব না? পৌরসভা, তারপর বিভাগীয় শহর থেকে সিটি করপোরেশন। এতোসব মর্যাদা লাভের পর একেবারে পরিবেশবান্ধব, পরিকল্পিত নগরী গড়ে তুলতে না পারার ব্যর্থতা কোন ভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়। অথচ সুযোগ ছিল যথেষ্ট।
যে যত উন্নয়নের কথাই বলুক না কেন শহরের চেহারা কিন্তু এর সাক্ষী দেয়া না। উন্নয়ন আর পরিকল্পিতভাবে নগরীকে রুপ দেয়া কিন্তু এক নয়। এক কথ্য়া বললে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে গড়ে ওঠা শহর সাক্ষী দিচ্ছে সে ভালো নেই।
অথচ বলা হয় নদীর পাড়ের বসতি বা শহর হলো প্রকৃতির আশির্বাদ। ভাগ্যবান মানুষরাই নদী ঘেরা শহর পায়। উন্নত দেশে কৃত্রিম লেক বানিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরী করে শহরকে গোছানোর নজির অনেক। কিন্তু ময়মনসিংহ শহরের প্রায় বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া ‘ব্রক্ষèপুত্র’ এখন ধুকে ধুকে মৃত্যুর মুখে। নামকরা নদীটিকেও শহরের সৌন্দর্য বর্ধনে কাজে লাগানো যায়নি।
ইতিহাস বলছে, ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ অবধি ‘ময়মনসিংহ’ ছিল দেশের বৃহত্তম জেলা। অন্যদিকে ময়মনসিংহ শহরটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যেও অন্যতম। বাংলা সাহিত্যের অনেক প্রাচীন পুস্তকেও এই শহরের নামোল্লেখ দেখা যায়। ময়মনসিংহের ঐতিহ্যের প্রধান অঙ্গ হচ্ছে মৈমনসিংহ গীতিকা যা প্রাচীন পুঁথি ও লোকগাঁথার সংকলন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।
১৭৮৭ সালের ১ মে জেলা প্রতিষ্ঠার পর জেলা শহর হিসাবে বর্তমান ময়মনসিংহ শহরের গোড়াপত্তন হয়। ‘নাসিরাবাদ’ নাম দিয়ে জেলা শহরের পত্তন হয় ১৭৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ‘শহর স্থাপনের পর মিউনিসিপালিটির নামও হয় নাসিরাবাদ মিউনিসিপ্যালিটি (জুলাই/১৮৫৮)। তৎকালীন স্থাপিত এটি প্রথম এবং উপমহাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় পৌরসভা।’ তবে পৌরসভার কাগজপত্র অনুসারে পৌরসভা স্থাপনের তারিখ ৮ই এপ্রিল ১৮৬৯। এরপর ১৯০৫ সালে নাসিরাবাদ পৌরসভার নাম পরিবর্তিত হয়ে ময়মনসিংহ পৌরসভা হয়।
ঐতিহ্যবাহি এই শহরে বর্তমানে নাগরিক সংকটের শেষ নেই। বস্তির নগরী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া শহরে জনসংখ্যা এখন সোয়া আট লাখ, আয়তন ৭৯ কিলোমিটার আর ৩৩ ওয়ার্ড মিলিয়ে ‘ময়মনসিংহ’ সিটি করপোরেশন। শহরের প্রধান সমস্যা কোন রাস্তা নেই। ছোট ছোট সরু সড়ক, ঘিঞ্জি বস্তি আর দমবন্ধ করা বাজার গলিই সবচেয়ে বেশি। মানুষের হেঁটে চলার জন্য ফুটপাত বলতে কিছু নেই। ড্রেনেজ সমস্যা, জলাবদ্ধতা, পানি সংকট তো আছেই।
অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠছে বাড়ি ঘর। নতুন নতুন ওয়ার্ড গুলোও পরিকল্পনা ছাড়াই শহরে রুপ নিচ্ছে। সিটি করপোরেশনের আওতায় এখন ধানের জমি রয়েছে অনেক। শহরের গন্ধে সেসব জমি বিক্রি হচ্ছে উচ্চ মূল্যে, নিজেদের ইচ্ছামত বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এক সময় নতুন শহরগুলোও মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
ইচ্ছেমত মার্কেট হচ্ছে, প্রয়োজনীয় রাস্তায় জমি না রাখা বা এক ভবন থেকে অন্য ভবনের দূরত্ব না রেখেই ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এখনও সিটি সার্ভিস চালু হয়নি। এক কথায় যদি বলি এটি অটো আর ব্যাটারিচালিত রিক্সার শহর। যানজটের মহাভোগান্তির শহর। মশার উপদ্রব তো বলার মতো নয়।
দিন দুপুরে যে শহরে ময়লা আবর্জনা পরিবহন করা হয় সেই শহর তো সিটি করপোরেশনের মর্যাদাকে নষ্ট করবে এটাই স্বাভাবিক। নগরে কয়টি পাবলিক টয়লেট আছে? কয়টি পার্ক আছে। যেগুলো আছে সেখানে অপরাধীদের অভয়ারণ্য।
বেশিরভাগ এলাকায় দেখা যায় ড্রেনের ওপর অবাধে নাগরিকরা মল মূত্র ত্যাগ করছে! একটি ভালো বাস টার্মিনাল পর্যন্ত নেই। যেখানে সেখানে গাড়ি রাখার স্থান করা হয়েছে। নগরজুড়ে একটি সুস্থ্য ধারার বিনোদন কেন্দ্র থাকবে না? এটি হতে পারে। মূল কথা হলো সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ি যেসব নাগরিক সেবা পাওয়ার কথা মানুষ কি তা পায়। এর বাইরে যদি বলি যেভাবে একটি পরিকল্পিত বা বাসযোগ্য শহর গড়ে তোলা প্রয়োজন এর ছিটেফুটা কি আদতে আছে এই নগরীতে?
একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করতে চাই তা হলো ময়মনসিংহ শহরের যানজট নিরসনে সাম্প্রতিক সময়ে একটি বাইপাস সড়ক নির্মান হয়েছে। যে সড়ক দিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহের অন্য জেলাগুলোর যানবাহন চলাচল করে। এক সময় এসব যান চলতো শহরের উপর দিয়ে।
এবারের ঈদকে কেন্দ্র করে বাইপাসের অন্তত দুই কিলোমিটার আগে থেকে শম্ভুগঞ্জ বাজার চৌরাস্তা পর্যন্ত যানজট। কোন কারণ ছাড়াই এই পরিস্থিতি। ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়িতে বসে থেকে মানুষের ভোগান্তির যেন শেষ নেই। অথচ সড়কে ট্রাফিক পুলিশের তেমন কোন তৎপরতা দেখা যায়নি।
শেষ পর্যন্ত আবিস্কার করা হলো যানজটের তেমন কোন কারণ নেই। শম্ভুগঞ্জ সেতুর আগে ও বাজারে গাড়ি এলোমেলো করে রাখা, ইচ্ছেমত যাত্রী তোলা, অটোরিক্সা চালকদের দৌরাত্মের কারণে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি। অথচ কারো যেন কোন বিকার নেই।
ইদের পরদিন সাধারণত সড়ক ফাঁকা থাকার কথা। শম্ভুগঞ্জ ছাড়িয়ে টোলপ্লাজা অতিক্রম করে শহরে প্রবেশ করার আগেই মহাসড়কের পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে ‘ময়লাকান্দা’। অর্থাৎ সড়কের পাশে বছরের পর বছর শহরের ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। তাই এই জায়গাটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ময়লাকান্দা’। অথচ চারটি জেলার মানুষকে এই সড়কটি ব্যবহার করে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে হয়। করপোরেশনের ভোটাররাও এই এলাকায় থাকছেন ভয়াবহ দুর্গন্ধের মধ্যে। তাহলে এখানে একটি ময়লার ভাগাড় কিভাবে করা হলো?
এরপর ইদের প্রায় ৪৮ ঘন্টা পর শহরের সরকারি মেডিকেল কলেজ রোড থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দেখা গেছে কুরবানির বর্জ্য। দুর্গন্ধের মদ্যে নাকে রুমাল দিয়ে মানুষকে চলতে দেখা গেছে। ছোট ছোট বিনে ময়লার স্তুপ। নগরীতে কয়টি ভাল ডাস্টবিন আছে? এর উত্তর হয়ত কারো কাছে নেই। ময়লার দুর্গন্ধ এই নগরীর মানুষের সারা বছর সহ্য করতে হয়। অপরিচ্ছন্ন স্থান গুলো পরিস্কার করে বসবাসের উপযোগি করার নাম নেই। এসব দৃশ্য দেখার পর এটা বলা কী স্বাভাবিক নয়, এই শহরে কী কোন অভিভাবক নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি