বিএ পয়েন্ট ফাইভ অবনতির শঙ্কা ও জরুরী সচেতনতা
১৯ জুলাই ২০২২ ১৫:১৬
নতুন করে করোনা ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের খবর গণমাধ্যমে আসছে। এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোয় ব্যাপকভাবে বাড়ছে করোনা আক্রান্ত্রের সংখ্যা। বিশেষ করে নিউজিল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও চীনে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন দেশগুলোর সরকার। আগামী কয়েক সপ্তাহে এসব দেশের পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশেও বাড়ছে এই সংক্রমণ। দেশে গত ১৮ জুলাই ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাসে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ২৯ হাজার ২৪১ জনে। একই সময়ে নতুন করে ১ হাজার ৭২ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৯৭ হাজার ৪১২ জনে। মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসার পর যেখানে কোনো দিন ৬০ জেলায়, কোনো দিন ৬২ জেলায় করোনার রোগী পাওয়া যাচ্ছিল না, সেখানে চতুর্থ ঢেউয়ে মাত্র ২৪ ঘণ্টায় রোগী মিলেছে ৪৮ জেলায়। চলতি বছরের শুরু থেকে বিশ্বজুড়ে তান্ডব চালানো করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টকে ‘সুপারস্প্রেডার’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে ওমিক্রনেরই সাব-ভ্যারিয়েন্ট বিএ পয়েন্ট ফাইভ (বিএ.৫) আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। মহামারি করোনাভাইরাসের নতুন বিএ পয়েন্ট ফাইভ (বিএ.৫) সাব-ভ্যারিয়েন্ট বা উপ-ধরনটি আগের ডেল্টা বা ওমিক্রন ধরনের তুলনায় অনেক বেশি বিপদজনক বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) শীর্ষ বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথান। একইসঙ্গে তিনি সতর্ক করেছেন, করোনার নতুন বৈশ্বিক ঢেউ আসার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে ডব্লিউএইচওর সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে রাখারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের একটি সাব-ভ্যারিয়েন্ট বা উপ-ধরন হচ্ছে বিএ.৫। এ উপ-ধরনটির মারণ-সক্ষমতা অন্য পরিবর্তিত ধরনগুলোর তুলনায় বেশি। আর নতুন এ উপ-ধরনটিই বৈশ্বিক ঢেউ আসার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, মনে করছেন সৌম্য স্বামীনাথান।
গত বৃহস্পতিবার এক টুইটবার্তায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ শীর্ষ বিজ্ঞানী বলেন, গত কয়েক মাস সংক্রমণ ও মৃত্যু শিথিল থাকার পর বিশ্বব্যাপী আবারও করোনার ভয়াবহতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। সম্ভাব্য নতুন ঢেউয়ের কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএ পয়েন্ট ফাইভ নামের উপ-ধরনটির প্রভাব, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের উদাসীনতা এবং বিশ্বজুড়ে করোনাপ্রতিরোধী ভ্যাকসিন বণ্টনে চরম অসমতা এ উত্থানের কারণ হতে পারে। ওই টুইটবার্তায় সৌম্য স্বামীনাথান সতর্ক করে বলেন, বর্তমানে যেভাবে দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে তাতে এটা নিশ্চিত যে, শিগগির করোনার একটি বৈশ্বিক ঢেউ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সম্ভাব্য এ পরিস্থিতিতে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে জাতিসংঘভিত্তিক এই স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংস্থাটি সব সদস্য রাষ্ট্রকে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ওই বছরের মার্চে প্রকোপ দেখা দেয় করোনা ‘ডেল্টা ধরন’। এই ধরন নিয়ে দেখা দেয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এই ঢেউ মোকাবিলায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। পরে তা ধীরে ধীরে শিথিল করা হয়। ধীরে ধীরে দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পর চলতি বছরের শুরুতে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে আসে তৃতীয় ঢেউ। এ অবস্থায় গত ২৮ জানুয়ারি দেশে করোনা শনাক্তের হার ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশে দাঁড়ায়। দেশে করোনা আসার পর থেকে এটিই সবচেয়ে বেশি শনাক্তের হার। তবে তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে কঠোর লকডাউনের পথে হাটেনি সরকার। এ পর্যায়ে অর্ধেক জনবল নিয়ে অফিস করার নির্দেশনার পাশাপাশি ভ্যাকসিনেশনের ওপর জোর দেয় সরকার। সরকারের এই পদক্ষেপে সফলতাও আসে।
প্রথম দুই ঢেউয়ের তুলনায় অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ। হাসপাতালগুলোতেও করোনা রোগীর ভিড় ছিল অনেকটা কম। টিকা কার্যক্রমে গতিশীলতা ও সরকারের অন্যান্য পদক্ষেপে দ্রুত তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসে। চলতি বছরের ১১ মার্চ দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।
তবে যেভাবে সংক্রমণের হার বাড়ছে, তাতে আর কয়েক দিনেই দেশে করোনার চতুর্থ ঢেউ শুরু হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ প্রেক্ষাপটে সরকার আবারো ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নীতি নিয়ে কিছু দিন আগে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে ছয় দফা আদেশ বাস্তবায়নের চিঠি দিয়েছে। নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা জরুরি। পাশাপাশি এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন হতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশে করোনার মতো দীর্ঘস্থায়ী মহামারি মোকাবিলা করা সহজ কাজ নয়। একদিকে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত, অন্যদিকে জীবিকা রক্ষার চেষ্টা করা- সব মিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে জেঁকে বসা আর্থিক সংকটের মধ্যে নতুন করে করোনা সংক্রমণ সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এর আগে আমরা বড় ট্র্যাজেডি এড়াতে পেরেছি। কারণ, অনেক দেশে আক্রান্ত্র ও মৃত্যুর সংখ্যা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। আমরা এ পর্যন্ত সংক্রমণ মোকাবিলায় অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো করেছি। এটা সরকারের সাফল্য। নতুন করে করোনার ঊর্ধ্বমুখীতে উদ্বেগ বাড়ছে- এটাই স্বাভাবিক।
তবে টিকাদান কর্মসূচি জোরালো হলে এ হার আরো কম হতো বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১২ কোটি ৯ লাখের বেশি মানুষ করোনা টিকার এক ডোজ পেয়েছেন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৭৫.৭৫ শতাংশ। আর টিকার দুই ডোজ পাওয়া নাগরিকের সংখ্যা ১১ কোটি ৯৩ লাখের বেশি, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৭০.০৫ শতাংশ। বুস্টার ডোজ দেয়া হয়েছে ২ কোটি ৮৯ লাখ ২৩ হাজার ১৬২টি, যা মোট জনগোষ্ঠীর ২৪.২৪ শতাংশ। সে হিসাবে এখনো বুস্টার ডোজ পাননি ৪৬ শতাংশ মানুষ। বুস্টার (তৃতীয়) ডোজ প্রয়োগে দেশ এখনো অনেকটাই পিছিয়ে। হাতে পর্যাপ্ত টিকা থাকলেও দ্রুত সময়ে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বুস্টার ডোজ দেয়ার ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা বাড়াতে হবে। ১৯ জুলাই সরকার বুস্টার ডোজ দিবস ঘোষণা করেছে। এটা জরুরি ছিল।
করোনা ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি দ্রুত সময়ে ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে বুস্টার ডোজের আওতায় আনতে হবে। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, ভিড় এড়িয়ে চলার পাশাপাশি টিকা নেয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। করোনার সংক্রমণ কমার পর আমাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানতে যে উদাসীনতা তৈরি হয়েছে তা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা, মাস্ক না পরার প্রবণতা এবং মানুষের জটলা ও ভিড়ের কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে কোরবানির পশুর হাট ও ঈদযাত্রা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
করোনার প্রতিটি ঢেউ ছড়িয়ে পড়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে মাস্ক পরায় জোর দিয়ে প্রশাসনিক অভিযান চলেছে। তবে এবার ভ্রাম্যমাণ আদালত এখন পর্যন্ত নামানো হয়নি। যদিও এরই মধ্যে সরকার ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ নীতি পুনঃপ্রবর্তন করেছে। সেই সঙ্গে নিজের কর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে বলা হয়েছে। কিন্তু দুই নির্দেশনার কোনোটির প্রয়োগ নেই বললেই চলে। সাধারণের মতোই সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যেও মাস্ক পরার প্রবণতা কম।
এ অবস্থায় করোনা সংক্রমণ রোধে ছয়টি নির্দেশনা বাস্তবায়নে সচিব ও বিভাগীয় কমিশনারদের অনুরোধ জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। নির্দেশনার মধ্যে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মাস্ক পরায়। সবক্ষেত্রে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা, ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ নীতি প্রয়োগ করা এবং দোকান, শপিংমল, বাজার, ক্রেতা-বিক্রেতা, হোটেল-রেস্টুরেন্টে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরিধান করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর ব্যত্যয় হলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে বলেও নির্দেশনায় জানানো হয়েছে।
শুধু অফিস-আদালত নয়, গণপরিবহনে যাত্রী-স্টাফ ও রিকশাচালক কিংবা দিনমজুরদের মধ্যেও সচেতনতা জরুরী। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে তাদের মধ্যে একেবারেই অনাগ্রহ দেখা যায়। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়েও খুব কম মানুষকেই মাস্ক পরতে দেখা যায়।
বিশ্বের প্রথম করোনা নামক ভাইরাসে ভয়াবহ মৃত্যু ঘটলেও বর্তমানে করোনা পরিচিত নাম। করোনা কি করতে পারে কি হতে পারে তা কিন্তু আমরা অবগত। ফলে অবহেলার সুযোগ নেই। বিএ পয়েন্ট ফাইভ অবনতির শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে সুতরাং সচেতনতা জরুরী হয়ে পরেছে। প্রয়োজন সচেতনতা ও ভাল থাকার মানসিকতা। প্রয়োজন আইন মানা ও মানতে বাধ্য করা। আসুন আরেকটি বার সচেতন হই সুস্থ থাকি।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
গোপাল অধিকারী বিএ পয়েন্ট ফাইভ অবনতির শঙ্কা ও জরুরী সচেতনতা মুক্তমত