হিমছড়ির ভয়াবহ অবস্থা দেখে আমি বিস্মিত
১৯ জুলাই ২০২২ ১৬:০৭
শুনেছি সরকার দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বলা বাহুল্য, ট্যুরিস্ট পুলিশদের সার্বিক সহযোগিতায় আগের তুলনায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে অপরাধের অভিযোগ অনেকাংশে কমেছে এবং রাতের সমুদ্র সৈকত এখন আগের তুলনায় বেশ নিরাপদ।
বাংলাদেশের সৌন্দর্য্যে যুগে যুগে ভ্রমণকারীরা মুগ্ধ হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই এ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন সম্ভাবনা অপরিসীম।
আমাদের রয়েছে সুবিশাল সমুদ্রসৈকত, পাহাড়, জলপ্রপাত, ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মণ্ডিত স্থান; যা পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণ সমৃদ্ধ অনন্য পর্যটন গন্তব্যে, বাংলাদেশকে গড়ে তুলছে পর্যটকদের জন্য তীর্থস্থান হিসেবে।
সময়োপযোগী ও পরিকল্পনা মাফিক পদক্ষেপ গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে এসব পর্যটন স্পট যদি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে নবদিগন্তের সূচনা হবে। তাছাড়াও পর্যটনে ঘোরাফেরার ধারণা পরিবর্তন করে একে বহুমুখী করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে।
পর্যটনের বহু শাখা-প্রশাখার মধ্যে বিনোদন পর্যটন, শ্রান্তি বিনোদন পর্যটন, সাংস্কৃতিক পর্যটন, ইভেন্ট পর্যটন, সাংস্কৃতিক ভিত্তিক পর্যটন, ক্রিয়া পর্যটন, নৌ-পর্যটন, হাওর পর্যটন, ধর্মভিত্তিক পর্যটন শিল্পকে গুরুত্ব দিতে হবে। এত সম্ভাবনা থাকার পরও আমরা পর্যটক আকর্ষণের মতো কোনো পন্থাই এখনো নির্ধারণ করে উঠতে পারছি না।
আমরা একটু সচেতন হলেই নিজেদের পর্যটন ক্ষমতা বাড়িয়ে বিপুল সংখ্যক বিদেশী দর্শনার্থীকে নিজের দেশে আনতে পারি। আধুনিক জীবনের চাওয়া মাথায় রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আমাদের পর্যটন শিল্পের বিকাশে সচেষ্ট হতে পারি।
হিমছড়ি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত একটি পর্যটন স্থল। কক্সবাজার থেকে এটি ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। হিমছড়ির একপাশে রয়েছে সুবিস্তৃত সমুদ্র সৈকত আর অন্যপাশে রয়েছে সবুজ পাহাড়ের সারি।
হিমছড়িতে একটি জলপ্রপাত রয়েছে যা এখানকার প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। যদিও বর্ষার সময় ছাড়া অন্যান্য অনেক সময়ই ঝরণায় পানি থাকে না বা শুষ্ক থাকে। তবুও প্রাকৃতিক পরিবেশ হিসেবে হিমছড়ি পর্যটকদের অনন্য এক আকর্ষণ। কক্সবাজার জেলায় পিকনিক করতে আসলে হিমছড়ি ঝর্ণা পর্যটকরা একবার হলেও দেখে যায়।
১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে হিমছড়িসহ আশে পাশে অনেক পর্যটন স্পট দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুনেছি তারপর হিমছড়ি এলাকাটি অনেক সংস্কার করা হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে উঁচু পাহাড়ে উঠে সাগর, পাহাড় ও কক্সবাজারের নৈসর্গিক সৌর্ন্দয অতিসহজে উপভোগ করা যায়।
হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে – গবেষণা ও শিক্ষণ, পর্যটন ও বিনোদন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ। হিমছড়ির একপাশে রয়েছে সুবিস্তৃত সমুদ্র সৈকত আর অন্যপাশে রয়েছে সবুজ পাহাড়ের সারি। উদ্যানে অনেকগুলো জলপ্রপাত বা ঝর্ণা রয়েছে, যার মধ্যে হিমছড়ি জলপ্রপাতটি সবচেয়ে বিখ্যাত।
হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান একটি চিরসবুজ বৃক্ষের বনাঞ্চল। হিমছড়ি বনাঞ্চলে হাতি সহ মায়া হরিণ, বন্য শুকর ও বানর দেখা যায়। এ বনে বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ ও উভচর প্রাণী পাওয়া যায়। হিমছড়ি বনাঞ্চল উল্লুকের আবাসস্থল। পাখি প্রেমীদের জন্য হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান একটি আদর্শ স্থান। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে ময়না, ফিঙ্গে ও তাল বাতাসি উল্লেখযোগ্য।
আমার সদ্য ইউটিউবে দেয়া পরবাসী জীবন ‘কক্সবাজারের হিমছড়ি পাহাড় অপূর্ব সৃষ্টি’ আমাকে যেমন মুগ্ধ করেছে একই সঙ্গে করেছে হতাশ। প্রায় ৪০০ ফুট উঁচু পাহাড়ে উঠতে রয়েছে একটি সিঁড়ি, সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠার পর মনে হতেই পারে অনুভূতিতে হিমালয়ের সর্বাচ্চ চুড়ায় পা পড়েছে। এমন একটি অনুভূতির পরিবর্তে যেদিকে চোক যায় শুধু নোংরা আবর্জনা আর বড় বড় মশার উপদ্রোপ। নেই ডাস্টবিন, নেই পাবলিক টয়লেট, নেই পানির ব্যবস্থা, আছে শুধু আহাকার আর আর্তনাদ এবং নোংরা পরিবেশ।
ছোট্ট একটি শিশু পার্ক, সুন্দর একটি ফুলের বাগান পার্কের পাশে বসার ব্যবস্থা সহ সুন্দর স্বচ্চল একটি বিনোদন ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন কেন আজ অবধি গড়ে উঠেনি? রয়েছে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন রয়েছে মিলিটারি প্রশাসন, রয়েছে পর্যটন প্রশাসন, রয়েছে জনগণের প্রতিনিধি। অথচ কারো নজরে একবারও পড়ছে না অপরিস্কার অপরিচ্ছন্ন এমন একটি স্থান?
তাহলে কি জাতি হিসাবে আমরা নোংরা এবং এ কারনেই কি আমাদের নৈতিকতায় দুর্নীতির এবং অনীতির সংস্পর্শ?
এসব শুধু আমার প্রশ্ন নয় এটা এখন অনেকেরই মনের কথা? স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও কেন এমন মনোমুগ্ধকর একটি পর্যটক স্থান অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে? কীভাবেই বা এতগুলো দায়ীত্বশীল প্রশাসন মাসের পর মাস বছরের পর বছর বেতন নিচ্ছে, এটাই এখন আমার প্রশ্ন! তাহলে সবকিছু থাকতেও এ ব্যাপার কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে? আমি সবিনয়ে আশা করব অনতিবিলম্বে হিমছড়ি সহ দেশের সকল পর্যটক স্থানগুলোর সার্বিক পরিকাঠামোর দিকে কতৃপক্ষ গুরুত্ব আরোপ করবে। বিশেষ করে পরিস্কার পরিছন্নতা সহ নিরাপদ পর্যটক পরিবেশ গড়ে তুলবে।
এই তো সেদিন আমি দেখে এলাম সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ি এলাকা, কি চমৎকার ন্যাচারাল পরিস্কার পরিছন্ন পরিবেশে সংরক্ষিত করে রেখেছে দেশটির দায়ীত্বশীল কতৃপক্ষ যেখানে বিশ্বের মানুষ আসছে এবং উপভোগ করছে দেশটির সৌন্দর্যকে! আমি বাংলাদেশের হিমছড়িকেও সুইজারল্যাল্ডের কোলেস্টারসের (Klosters) মত দেখতে চাই।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি