Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আর কত নারী যৌতুকের বলি হবে?

রশীদ এনাম
২১ জুলাই ২০২২ ১৫:৪৫

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহরের নাম চট্টগ্রাম। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো গ্রাম চট্টগ্রাম। সৃষ্টিকর্তা তুলির স্পর্শে অপরূপ করে ঢেলে সাজিয়েছেন মনোহর রূপমাধুরী চট্টগ্রামকে। পাহাড়, নদী, দরিয়া, নগরবেষ্টিত চট্টগ্রাম। শহরটির আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমিয়ে পড়ে। সবুজ অরণ্যানীতে নানান পশুপাখির অভয়ারণ্য। দেশের প্রবেশদ্বার ব্যবসায়ের প্রাণকেন্দ্র বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১’র স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ, স্বৈরাচার আন্দোলন- প্রত্যেকটির সূচনা কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে। মা, মাটি ও মাতৃভূমির জন্য মাস্টারদা সূর্যসেন ও প্রীতিলতার মতো আরও অনেক বীরপ্রসবিনী চট্টগ্রামের কৃতী সন্তানদের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। আমাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি এবং মানবিকতার উজ্জল দৃষ্টান্ত। মেজবান, শুঁটকি, বেলা বিস্কুটের কথা বললে বুঝে নিতে হবে চাটগাঁইয়া। এজন্য বোধহয় মহাত্মা গান্ধি বাংলাদেশ সফর করতে এসে চট্টগ্রামকে নিয়ে প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন, Chittagong to the fore-চট্টগ্রাম সর্বাগ্রে। শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়েও চট্টগ্রাম এগিয়ে।

বিজ্ঞাপন

ইদানিং আমাদের হেভেন সিটি চট্টগ্রামে যৌতুক প্রথা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। যৌতুক নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভয়াবহ ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যান্য জেলার তুলনায় চট্টগ্রাম জেলার যৌতুক নামক অপসংস্কৃতি ও নেতিবাচক দিকটা একটু বেশি। যৌতুক বলতে আমরা বুঝে থাকি, বর পক্ষ কনে পক্ষের কাছ থেকে বিয়ের আগে ও পরে মূল্যবান আসবাবপত্র, গাড়ি বাড়ি, জামানত দাবী করেন এবং কনে পক্ষও মূল্যবান আসবাবপত্র হস্তান্তর করে বা করতে সম্মত হয় সেটাই যৌতুক।

বিজ্ঞাপন

যৌতুক প্রথা শুরু হয় সনাতনকাল থেকে, নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষদের কাছ থেকে সম্পত্তি লাভ করতে পারত না। সে সময় থেকে হিন্দু আইনে যৌতুক নারীর সম্পত্তির উৎস হিসেবে বিয়ে-শাদিতে যৌতুককে পণপ্রথা হিসেবে প্রচলণ করেন। বিশেষ করে বিয়ে-শাদিতে কনে পক্ষও বরপক্ষের কাছ থেকে অতিরিক্ত দেনমোহর দাবী করেন। যা ইসলামে শরীয়াহ বিরোধী এই সুযোগে বরপক্ষও কনে পক্ষের কাছ থেকে বিয়ের যৌতুকসহ খাবারের মেনুও দাবি করেন। ওমুক ক্লাবে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে হবে, চিংড়ি, রূপ চাঁদা, রুই কাতল মাছ, খাসি, গরু, মুরগি থাকতে হবে। অনেকটা ঢাকঢোল পিঠিয়ে হাতি পাদানো আর ঘোড়া লাদানোর মতো। দুই পক্ষের খাবার নিয়ে শুরু হয় ঝগড়াঝাঁটি; এরপর কত বিয়ে যে, খাবারের মেনু নিয়ে ভেঙে গেছে হিসেব নেই। এমনকি চট্টগ্রামে এক বিয়েবাড়িতে চিংড়ি মাছ দেয়নি বলে, বর স্টেজ থেকে নেমে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে, বরযাত্রিদের নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। বরপক্ষ সবসময় যৌতুক নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন। পথের ভিক্ষুকরা বোধহয় পয়সার জন্য এমনটা করেন না। আর বিয়ের আগে দরকষাকষি ও যৌতুক নিয়ে বাড়াবাড়ির যেন শেষ নেই।

কনে পক্ষের দোষ ও আছে, আজকাল মধ্যবিত্ত পরিবারের কনেপক্ষ, বরপক্ষের কাছ থেকে দেনমোহর দাবি করেন প্রয়োজনতিরিক্তি ১০ থেকে ১৫ লক্ষ, উচ্চবিত্ত পরিবারে ২০ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা। যা পরিশোধ করাও কষ্টসাধ্য। অনেকটা কনে পক্ষ যেন কোরবানি হাটে পশু ক্রয় করছেন। বরপক্ষও তখন কনেপক্ষকে ছাড় দেন না। অনুষ্ঠান হতে হবে আলিশান ক্লাবে, কয়েক হাজার বরযাত্রী খাওয়াতে হবে, অনেক বিত্তশালী পরিবার যৌতুককে নতুন নামকরণ করেছে ‘বরপক্ষকে কনে পক্ষ হতে গিফট’ বা উপহার প্রদান করা হয় যাতে মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে দুধে ভাতে থাকেন। আজকাল বিয়েতে দেখা যায়, ট্রাকভর্তি করে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন টয়লেটের বদনা, চপ্পল, সাবান, শ্যাম্পু, প্রসাধনী, টিস্যু, ন্যাপকিন থেকে শুরু করে ঘরের খাট-পালং, সোফা, কাঁথাবালিশ, হাঁড়িপাতিল, আসবাবপত্র এবং হেঁশেল ঘরের সকল তৈজসপত্রসহ আরও অনেককিছু।

উচ্চবিত্তদের অনেকে গাড়ি বাড়ি ফ্ল্যাট পর্যন্ত গিফট দিয়ে থাকেন। নিম্নশ্রেণির মেয়ের বিয়েতে দুই থেকে চার লক্ষ টাকা চাঁদা তুলে কন্যা পাত্রস্থ করেন অসহায় বাবা। আর আঁরার চাটগাঁইয়া অপসংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে; এজন্য আমাদের কিছু লোভী ও মোড়ল শ্রেনীর অভদ্র লোক দায়ী।

একটা মেয়েকে তার বাবা কত কষ্ট করে লালনপালন করে পড়ালেখা শেষ করে সারাজীবনের কষ্টার্র্জিত সঞ্চয় খরচ করে বিয়ে দেন। একটা মেয়ে যখন বিয়ের পর তার বাবা-মা, ভাইবোন ও নিজভূমটা ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে যায়, সে তখন অনেকটা এতিমের মতো হয়ে যায়। সে ভাবে আমি যেখান থেকে পালকিতে চড়ে শ্বশুরবাড়িতে নেমেছি ঠিক সেখানে থেকে জীবনের শেষযাত্রায় খাটিয়াতে উঠব। শ্বশুরবাড়িতে এসে সে কত চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে ঐ বাড়িকে আপন করে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। একটা সময় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। বিয়েরপর বরপক্ষের আত্মীয়স্বজন কনে পক্ষ থেকে কি দিয়েছে, নানারকম অযাচিত প্রশ্ন করে বিশেষ করে খাবার নিয়ে, এটা কেন দেয়নি, ওটা কেন পাঠায়নি, নতুন বউকে ছোট বিষয় নিয়ে খোঁটা দেন। বিয়ের প্রথমদিকে বেশির ভাগ নারীরা মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

ইদুলফিতরে শ্বশুরবাড়িতে গিফট দিতে হবে, বাড়ির দাড়োয়ান, কাজের বুয়া থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজনের জন্য নতুন জামাকাপড় দিতে হয়, কোরবানির ইদে বড়ো গরু-ছাগল, ফলের মৌসুমে ফল, শীত পিঠা, ধর্মীয় উৎসবে খানাপিনা। তাও আবার শ্বশুর-শাশুড়ির পছন্দমতো হতে হবে। একটু উনিশ বিশ হলে, শ্বশুর- শাশুড়ির বিষ বাক্য হজম করতে হয়। নির্যাতন করে চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ফেলে। আর কত অসহায় হয়ে পড়ে মায়ের জাতি নারী। কারও বা আদরের কন্যা, কারও বা বোন! সে কাউকে কিছু বুঝাতে পারে না। এমনকি তার জীবনসঙ্গীটাও বেঁকে বসে। তার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়।

একটু এদিক-ওদিক হলে শ্বশুরবাড়ি থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। যৌতুকের টাকা দিতে না পারলে সে বাড়িতে প্রবেশ নিষেধ। শত অত্যাচার, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সহ্য করেও একটা মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে চায়। কত জন শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। হায় রে যৌতুক! জানি না আর কত বোন, কত নারী যৌতুকের বলি হলে থামবে মৃত্যুর মিছিল। সম্প্রতি চট্টগ্রামের রাউজানে কোরবানি ইদে ছাগল দিতে না পারায় জীবন দিতে হলো গৃহবধুকে। ফুলের মতো মিতুল নামের একটি মেয়েকে তার বাবা টাকাপয়সা খরচ করে বিয়ে দেন, বিয়ের পর বরপক্ষ থেকে যা যা দাবি করেছে, সবকিছু দিয়েছেন, কোরবানির ইদে গরু, ইদুলফিতরে পোশাক, ধর্মীয় উৎসবগুলোতে চট্টগ্রামের রীতিনীতি অনুযায়ী মিতুলের বাবার সাধ্যমতো সবকিছু দিয়েছেন। মিতুলের মেয়ের আকিকায় গরু, স্বর্ণের চেইন কত কিছুই না দেওয়া হয়েছে। তারপরও যৌতুকের বলী হলো মিতুল। শাশুড়ি ও স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে আড়াই বছরের মাসুম শিশু আরিবাকে রেখে আত্মাহুতি দিলেন মিতুল। মিতুল ছিলেন একটি সংস্কৃতিমনা ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তাদের পরিবারের সামাজিক অবদানও রয়েছে।

প্রতিনিয়ত যৌতুকের বলী হচ্ছে নারীরা। অনেক মেয়ে বিয়ের মেহেদির রং মোছার আগে জীবনের রং মুছে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, যৌতুককে কেন্দ্র করে গত ২০১৬ সালে ১৭৩ জন নারী খুন হয়েছেন। নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৬২টি। গত পাঁচ বছরে এ সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে। হত্যার শিকার হয়েছে ১ হাজার ১৫১ জন নারী। মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীরা বলেছেন, পারিবারিক সহিংসতার কারণ হলো যৌতুক।

মেয়ে হচ্ছে বাবাদের প্রাণ। পৃথিবীর কোনো বাবাই চান না তার মেয়ের অকাল মৃত্যু। যৌতুকের বলী হওয়া কন্যাসন্তানের অসহায় পিতা মাতারা ঢুকরে ঢুকরে কাঁদেন। তাদের ক্রন্দন ধ্বনি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রামে কিন্তু অভদ্র যৌতুক লোভীদের কানে কখনও পৌঁছে না। চট্টগ্রামে ইদানীং যৌতুক নামক ভাইরাসটি মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। চাটগাঁবাসী চায় এই যৌতুক ভাইরাসকে মানুষের মস্তিস্ক ও মন থেকে চীরতরে উপড়ে ফেলার সময় এসেছে। এজন্য চাই পরিবর্তন, সামাজিক সচেতনতা, সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে তরুণ প্রজন্মকে। জনপ্রতিনিধিদের, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, সব জায়গায় ব্যাপকভাবে যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে হবে। যৌতুকের কুফল তুলে ধরতে হবে।

দেশের প্রচলিত আইনও যৌতুককে অপরাধ হিসেবে গন্য করে ১৯৮০ সালে প্রথম যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয় যা সময়ের চাহিদার প্রতিফলনে ২০১৮ সালে নতুনভাবে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনে ২ ধারায় যৌতুকের সংজ্ঞা প্রদান করে ৩ ধারায় যৌতুকের শাস্তির বিধান করা হয়েছে। যদি বিয়ের কোন পক্ষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিবাহের অন্য কোন পক্ষের নিকট কোন যৌতুক দাবি করেন, তাহলে তা হবে আইনের অধীন একটি অপরাধ এবং সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর কারাদন্ড, সর্বনিম্ন এক বছর কারাদন্ড ও পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এই আইনটির পাশাপাশি অপরাধটির গুরুত্ব বিবেচনায় নারী ও শিশুদের সুরক্ষায় প্রণিত ২০০৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (নির্যাতনমূলক শাস্তি) আইন ২০০০ এর ১১ নং ধারায় যৌতুকের অপরাধের শাস্থির বিধান যুক্ত করা হয়। ২০০৩ সালে এই আইনটি সংশোধন করে যৌতুকের জন্য হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড, হত্যার চেষ্টা চালানোর জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মারাত্মক জখম করার দায়ে ১ থেকে ৩ বছরে কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনটিতে যৌতুকের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হলেও যথাযথ প্রয়োগ নেই। ফলে যৌতুক নামক এই অপসংস্কৃতি প্রতিনিয়ত বলীর শিকার হচ্ছে নারীরা। যা প্রতিরোধের জন্য আইনের বাস্তবায়নসহ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।

বর্তমান প্রজন্মদের কিশোর বয়স থেকে শপথ নেওয়া উচিত-আমরা যৌতুক দিব না, যৌতুক নিবও না। আসুন যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ি তুলি। যৌতুককে না বলি। যারা যৌতুক দাবি করে তারা এই সমাজের ভয়ানক ভাইরাস , যৌতুক গ্রহিতারা সমাজের সবচেয়ে লোভী ভিক্ষুক, মিসকিন, আসুন ওদেরকে সমাজে চিহ্নিত করে বয়কট করি।

লেখক: প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

আর কত নারী যৌতুকের বলি হবে? মুক্তমত রশীদ এনাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর