Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যৌন নিপীড়ন বন্ধ হবে কবে?

জাফর হোসেন জাকির
২৩ জুলাই ২০২২ ১৬:০৩

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থী রাতে হলে ফেরার পথে যৌন নিপীড়নে শিকার হয়। তাকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে আটকে রেখে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারন করা হয়। এমনকি তাকে ধর্ষণের চেষ্টাও চালানো হয়। এই যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণ চেষ্টার কাজে প্রত্যক্ষভাবে পাঁচজন জড়িত। ভিক্টিম দেড় ঘণ্টা পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে ফোন করে এবং তার আগে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনকে ফোন করে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর লাইভ টকশোতে অভিযোগ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন হলেন ছাত্র-ছাত্রীদের অবিভাবক। প্রশ্ন হচ্ছে একজন যৌন নিপীড়নে শিকার হওয়া ভিক্টিম ক্যাম্পাসের অবিভাবকের ওপর কতটা আস্থা থাকলে প্রথম অবিভাবককে না জানিয়ে রাজনৈতিক সংগঠনকে জানায়? এই অনাস্থা কি একদিনে তৈরি হয়েছে? না। একদিনে তৈরি হয়নি। হয়েছে দীর্ঘদিন অভিযোগ করে আসা বিষয়গুলোকে যথারীতি এবং সঠিক সময়ে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে। দুইটা মোটরসাইকেলে পাঁচজন এসে ভিক্টিমকে ঝোপঝাড়ে নিয়ে যখন যৌন নিপীড়ন করা হচ্ছিলো তখন বাজে রাত সাড়ে ৯টা। দায়িত্বে থাকা ক্যাম্পাস প্রশাসন কি সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন? না কি যৌন নিপীড়নকারীদের ক্যাম্পাসের প্রশাসন ভয় পায়? না কি যৌন নিপীড়নকারীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন? এসব প্রশ্ন তোলা অস্বাভাবিক নয় নিশ্চয়ই?

বিজ্ঞাপন

বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্ত চিন্তা চর্চার জায়গা, মুক্ত হওয়ার জায়গা, মুক্ত হয়ে চলার জায়গা। তাহলে সেখানে যাতায়াতের জন্য সময় বাঁধা থাকবে কেন? ক্যাম্পাস প্রশাসন নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ আর তার জন্য শিক্ষার্থীদের সময় মেপে চলতে হবে কেন? ক্যাম্পাস হলো সীমামুক্ত এলাকা। সেখানে যদি নারীরা নিরাপদে চলাফেরা করতে না পারে তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত ৫০% নারী রাতে ফেরার সময় কিভাবে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে? নারীরা আাজ কোথাও নিরাপদ না। নিজ বাড়ি থেকে শুরু করে মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, রাস্তা-ঘাট, গণপরিবহন কোথাও নারী নিরাপদ না, নিরাপত্তা পাচ্ছে না। যেখানে ছয় বছর থেকে শুরু করে বৃদ্ধা নারী পর্যন্ত যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষেণর শিকার হচ্ছে সেখানে বাকি বয়সের নারীদের নিরাপত্তার কথা কল্পনাও চিন্তা করা যায় না। কেন শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধা নারী যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ এবং শেষে হত্যার শিকার হচ্ছে? উত্তর খুবই সহজ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি সাথে নারী বিদ্বেষমূলক বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সমস্ত জায়গায় পরিপূর্ণ।

বিজ্ঞাপন

পুঁজিবাদ ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একসাথে গলা মিলিয়ে চলমান। পুঁজিবাদ সমাজের টার্গেট হলো যে-ভাবেই হোক পুঁজির বিকাশ করা; পুরুষতান্ত্রিক সমাজের টার্গেট পুরুষকে পুরুষ ভাবা আর নারীকে যৌনদাসী করে ঘরে বন্দী রাখা। পুঁজিবাদ যখন পুঁজির বিকাশে পাগল হয়ে পুঁজি বৃদ্ধির জায়গা খোঁজে তখন দৃষ্টি পরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বন্দী রাখা যৌনদাসীর ওপর। ফলে পুঁজিবাদ আর পুরুষতান্ত্রিকতা এক হয়ে নারীদের সমাজের চোখে যৌনদাসী বানায়, বানানোর চেষ্টা চালায়। নারী বিদ্বেষী বক্তব্যগুলো শুনলে সেটা স্পর্ষ্টভাবে বোধগম্য হয়। ফলে দিনে দিনে নারীদের মানুষ না ভেবে যৌনদাসী, ভোগ্যপণ্য ভাবতে শুরু করায় যৌন নিপীড়ন থেকে শুরু করে ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধ বেড়েই চলেছে। আর বাড়বেই না বা কেন? পোষাকের দোহাই দিয়ে এ-যাবৎ যতগুলো যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ হয়েছে সেগুলোর বিচার কি চোখে পড়ার মতো হয়েছে? হয়নি।

মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর হিসাবে ২০০১-২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে ১০ হাজার ৮৩২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালে গৃহীত এক হিসাবে পাওয়া গেছে যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পূর্ববর্তী ৫ বছরে ৩০ হাজার ২৭২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২ জন। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় গত বছর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৮১৮ জন নারী৷ ধর্ষণের ৩ শতাংশ মামলার বিচার হয়েছে। বাকি ৯৭ শতাংশ মামলার আসামি বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে, নয়তো পরে খালাস পেয়েছে। এই তথ্য মতে যৌন নিপীড়নকারী ধর্ষকেরা সাধু সেজে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার কথা? উত্তর না বলেই যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধ কয়েকগুনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফল চবিতে যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের চেষ্টা। চবিতে যৌন নিপীড়ন ঘটনার মামলা হয়েছে। আন্দোলন দমানোর জন্য হয়তো আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু ফলাফল? ফলাফল হয়তো ৯৭ শতাংশের দিকেই গড়াবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যে চারটি দাবি তুলেছে তা শুধু তাদের ক্যাম্পাসের দাবি না। এই দাবিগুলো সকল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং সারাদেশের সকল মানুষের। সারাদেশের মানুষ সমস্ত জায়গায় নারী সহ সকল মানুষের ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা নিশ্চিত যায়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অকার্যকর যৌন নিপীড়ন সেল সংস্কার করে কার্যকর করতে হবে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্তপ্রাণের জায়গা সেখানে হলে প্রবেশের জন্য দিন কিংবা রাত কোনো সময় নির্ধারন করে দেওয়া চলবে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি পরিহার করে যৌন নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ ও হত্যাসহ সমস্ত জঘন্যতম অপরাধে যুক্ত এবং ইন্ধনদাতাদের দ্রুত বিচার করতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

জাফর হোসেন জাকির মুক্তমত যৌন নিপীড়ন বন্ধ হবে কবে?

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর