ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে, ট্রেনের বাড়ি কই?
২৩ জুলাই ২০২২ ১৭:২৮
একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। গত মার্চের ২২ তারিখের ঘটনা। যশোর রেলস্টেশনে এসেছিলাম টিকিট কাটতে। দূরযাত্রায় বাসে ভোগান্তির কারণে ট্রেন বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো তার দুদিন পরে অনুষ্ঠিত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কর্তৃক আয়োজিত একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া। প্রায় সবারই জানবার কথা, ঐসময়ে রেলের টিকিট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পাওয়া নতুন কোম্পানি ‘সহজ ডট কম’কে কাজ হস্তান্তর করার কারণে ২১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অনলাইনে টিকিট ক্রয় করা বন্ধ ছিলো। বাধ্য হয়েই ২৩ তারিখে ঢাকায় যাওয়ার টিকিট কাটবো বলে ২২ তারিখে গিয়েছিলাম রেলস্টেশনে; টিকিট একদিন আগেই ছেড়েছিল। ঐদিন টিকিট কাউন্টারে সকাল থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর তারা হটাৎ আমাকে হতাশ করে দিয়ে বলে টিকিট নাই, ফুরিয়ে গেছে। আমি রীতিমতো হতবাক! একটু আগেই তারা টিকিট বিক্রি করলো, এমনকি আমি লাইন থেকে সরে আসার পরও এক ব্যক্তির কাছে কাউন্টারের অন্যপাশ থেকে আনুমানিক ৬/৭টা টিকিট হাতে গুঁজে দিলো। কিছুটা রাগান্বিত স্বরে আমি প্রতিবাদ করলাম, আমাকে কেন টিকিট দেওয়া হলো না জানতে চাইলাম! অথচ তারা আমার কথা কানেই নিলোনা- নিজের কাছেই কেন জানি মনে হলো আমি মরুভূমিতে চিল্লাচ্ছি! আমি বুঝে গেলাম দালাল ছাড়া টিকিট পাবো না। প্রতিবাদটা খুব বেশিদূর এগোবেনা জেনে আমি হতাশ হয়ে ফিরে আসি।
এটা গেল আমার সাথে ঘটে যাওয়া সামান্য একটা ছোট্ট ঘটনা। সম্প্রতি মহিউদ্দীন রনি নামের ঢাবির যে শিক্ষার্থী রেলের অনিয়ম-দুর্নীতি আর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে নিজের প্রতিবাদী সত্তার অবয়ব কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারি। আমি শুরুতেই তার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে চাই।
এই যে রেলখাতে এত দুর্নীতি, এত অনিয়ম, শত-শত অভিযোগ, এসবকিছুর পরও কেন কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনা- এটার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। যা লিখতে গেলে অনেক পৃষ্ঠা অপচয় হবে, এমনো হতে পারে তা সাহস নিয়ে লেখার মতো অবস্থানে আমি পৌঁছাতে পারিনি! কারণ রেলের সিন্ডিকেটগুলো অনেক বেশিই ক্ষমতাশালী।
এতসব সিন্ডিকেটের মধ্যে সম্প্রতি একটা সিন্ডিকেট খুব বেশিই আলোচনায় চলে আসছে। ‘ভাবি সিন্ডিকেট’। এই ‘ভাবি সিন্ডিকেট’ এতটাই শক্তিশালী যে, তারা রেলের টিটি’কেই বরখাস্ত থেকে শুরু করে বড়ো বড়ো কর্মকর্তাদের রাত্রিনিদ্রাও উধাও করার ক্ষমতা রাখে। আপাতত কিছুটা সংকট নিরসনের জন্য হলেও ঘুণেধরা বাংলাদেশ রেলওয়ের ভিতরে নতুন করে জেঁকে বসা ‘ভাবি সিন্ডিকেট’ ভেঙে দেওয়ার বিকল্প দেখছিনা।
ভোরের কাগজসহ বেশকিছু পত্রপত্রিকার বদৌলতে জানতে পেরেছি, কেবল বিনা টিকিটে ভ্রমণই নয়- প্রভাব খাটিয়ে ট্রেনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরা নেওয়া, জমির ইজারা, ঠিকাদারি কাজ, পদোন্নতি, বদলি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ সব কাজেই ভাবি সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। এর মধ্যে রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আকতার মনি, লাবণ্য, মিলন, রেজা, জোবায়েরসহ ১০ সদস্যের ‘ভাবি সিন্ডিকেট’ সবার পরিচিত। এই ভাবি সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালকদের কাছে কাজ চাওয়া, কেনাকাটা, ঠিকাদারিসহ প্রায় সব কাজেই নিচ্ছে উৎকোচ। মনঃপূত না হলে বিভিন্নরকমের সাজা প্রদানের অভিযোগও এসেছে। এইতো কিছুদিন আগে বিনা টিকিটে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর কোন আত্মীয় ভ্রমণ করার ঘটনায় টিটিই’কে বরখাস্ত করার ঘটনা থেকেও অনেক কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।
‘সহজ ডট কম’র টিকিট কালোবাজারি আর অনিয়মের প্রসঙ্গক্রমে এবার প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মালিহা মালেক কাদীর ও রেলমন্ত্রীর সহধর্মিণী শাম্মী আক্তার মনি’র সম্পর্কের ব্যাপারটাও বেশ আলোচনায় এসেছে। কানাঘুষা চলছে, রেলের টিকিট ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা আলোচিত-সমালোচিত সিএনএসবিডি’কে হটিয়ে বান্ধবী মালিহা কাদীরের ‘সহজ ডট কম’কে কাজ পাইয়ে দেওয়ার পেছনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন শাম্মী আকতার মনি।
‘সহজ’ রেলের টিকিট ব্যবস্থাপনার বদলে অব্যবস্থাপনা করে গোটা প্রক্রিয়াকে কঠিন করে ফেলেছে। টিকিট ক্রয়ে ভোগান্তি, টাকা কেটে নেওয়া স্বত্ত্বেও টিকিট না পাওয়া, সার্ভার জটিলতা, এসবকিছু মিলিয়ে সহজ প্রক্রিটাকে কঠিন করে ফেলেছে। সহজ ডট কমের টিকিট অনিয়মের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী মহিউদ্দীন রনির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভোক্তা অধিদপ্তরের করা দুই লক্ষ টাকা জরিমানা প্রমাণ করে ‘সহজ’ রেলের কাজগুলো সহজ উপায়ে করছেনা।
বড়ো প্রশ্ন হচ্ছে, রেল খাতের মতো একটি সরকারি খাতের টিকিট ব্যবস্থাপনার গুরুদায়িত্ব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর কেন অর্পণ করা হবে? বারবার বিতর্কিত হওয়া স্বত্ত্বেও একইধরনের উদ্যোগ কেন নেওয়া হয়! রেলের স্বতন্ত্র ও নিজস্ব একটি টিকেটিং সিস্টেম থাকাটা অবশ্যই বাধ্যতামূলক।
আরো একটা প্রসঙ্গ না আনলেই নয়। গত ২০১৯ সালে ভারতগামী যাত্রীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বেনাপোল এক্সপ্রেস’ ট্রেনের উদ্বোধন করেন। যা বেনাপোল-ঢাকা রুটে চলাচল করতো। ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা উন্নত সুযোগসুবিধা সম্মত রেলকোচ দিয়ে এই সেবা চালু ছিলো। কিন্তু হটাৎ করেই বেনাপোল এক্সপ্রেসের উন্নতমানের কোচ সরিয়ে তার যায়গায় রেলমন্ত্রীর নিজ এলাকা উত্তরাঞ্চলের ‘বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস’র পুরনো ভারতীয় কোচ সংযুক্ত করা হয়েছে। বেনাপোল একটি আন্তর্জাতিক স্থলবন্দর। এই রুটে ভারত থেকে আগত সিংহভাগ পর্যটক/যাত্রীরা যাতায়াত করেন। দেশের অন্যতম লাভজনক রুট এটি। বেনাপোল এক্সপ্রেসের উন্নত কোচ সরিয়ে রেলমন্ত্রণালয় বা রেলের হর্তাকর্তারা অবিবেচকের মতো কাজ করেছে। পরবর্তীকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জেনেছি বেনাপোল এক্সপ্রেসের ঐ নতুন কোচ সংযুক্ত করা হয়েছে উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী-পঞ্চগড় রুটে। যার কারণে যশোর-বেনাপোলবাসীরা ক্ষোভও প্রকাশ করেছে।
পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ কতটা নেতিবাচক আকার ধারণ করতে পারে তা আমরা রেলখাতে ঘটে যাওয়া এসব কাণ্ড দেখে উপলব্ধি করতে পারি। মাননীয় রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনকে আমি ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দিক থেকে সম্মান করি। তার একটি বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার রয়েছে। সিন্ডিকেট আর দুর্নীতিবাজদের রুখে দেওয়ার মতো যথেষ্ট সুযোগ তার হাতে এখনো রয়েছে । তিনি চাইলেই পারবেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে তিনি একা লড়াই করতে পারবেন না, তবে তিনি চাইলেই অনেককিছু সম্ভব। অন্তত শুরুটা তো কেউ করুক। পরোক্ষভাবে রেলের নিয়ন্ত্রক যারা, তাদের দৌরাত্ম্য এভাবে বাড়তে থাকলে রেলখাতের গন্তব্য অত্যন্ত খারাপের দিকে এগোবে- যদিও এখনো ভালো বলা চলেনা।
ক্রমাগত রেলসেবার প্রতি জন-অসন্তোষ বাড়ছে। ভোগান্তি দূর, দালাল ও কালোবাজারি রোধ করতে হবে। স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে এবং সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। একইসাথে নীতি ও দায়িত্ববান কর্মকর্তাদের কাজের উন্মুক্ত ও রাজনৈতিক লেজুড় মুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। এগুলো করা বাধ্যতামূলক। নয়তো অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করবে। এভাবে একনাগাড়ে চলতে থাকলে রেলখাতে ধ্বস নামা ছাড়া উপায়ন্তর দেখছিনা।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি