Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এমন দিন অনেকদিন ছিল না

মোঃ আসাদ উল্লাহ তুষার
২৩ জুলাই ২০২২ ২০:৩২

সময় বদলায়, ইতিহাসের চাকা ঘোরে। সত্য ইতিহাস একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিছু কিছু বিষয়ে দাগ থেকে যায়। যে দাগ অনেকদিন পীড়া দেয়। কিছু কিছু দাগ কোনদিন ভোলা যায় না। এই যে মুক্ত গণমাধ্যম বা উম্মুক্ত দুনিয়ার এই যে সব সুযোগ সুবিধা তা একদিন ছিলো না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও রাজনৈতিক আবহ একদিন এমন ছিল না। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের পর কি অবস্থা ছিল এই বাংলাদেশের! আত্মস্বীকৃত খুনিদের আস্ফালনে ক্ষতবিক্ষত ছিলো প্রিয় স্বদেশ। অল্প কিছুদিন আগে মুক্তিযুদ্ধে নির্লজ্জ নিদারুণ পরাজয়ে মানুষের মাঝে মুখ দেখানোই ছিল যাদের পাপ, তারাও গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিল। চারিদিকে ছিল একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনিদের নির্দয় নির্লজ্জ আস্ফালন। তাদের সাথে ছিল রাষ্ট্রীয় শক্তির কুৎসিত পৃষ্ঠপোষকতা। একবার চিন্তা করুন, দেশের সবখানে ছিল একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনিদের স্বগর্ভ পদচারণা। আপনি বিদেশি দূতাবাসের কোন অনুষ্ঠানে যাবেন সেখানে দেখবেন জাতির পিতার কোন খুনি স্যুট টাই পরে কোন অতিথির সাথে খোশগল্পে মশগুল। সেখানে কি কোন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ যেতে পারতো বা যাওয়ার পরিবেশ ছিল? রাষ্ট্রীয় কোন দিবসে বঙ্গভবনে বা অন্যকোন জাতীয় অনুষ্ঠানে সামনের চেয়ারে বসে আছে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক বা রশীদ। সেখানে কি কোন বঙ্গবন্ধু প্রেমিক যেতে পারতো! এমন অনেক জায়গায় যেতে এই খুনিদের প্রলুব্ধ করা হত যেন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সেখানে যেতে না পারে। খোদ ক্ষমতার মসনদেই অবৈধভাবে বসেছিল উর্দি পড়া জেনারেল। রাষ্ট্রযন্ত্র সরাসরি ছিল আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ। একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনিরা ছিল শাসকগোষ্ঠীর বন্ধুস্থানীয়। ঢাকার রাজপথে বা কোন ময়দানে আওয়ামী লীগের কোন জনসভা থাকলে তাকে প্রতিহত করতে খুনি খন্দকার মোস্তাকের তথাকথিত ডেমোক্রেটিক লীগ বা খুনি ফারুক, রশীদ, ডালিম, হুদাদের ফ্রিডম পার্টি দিয়ে সরকারী মদদে পাল্টা জনসভা ডাকিয়ে ভুন্ডল করিয়ে দেয়া হত জনগণের দাবি আদায়ের সেই জনসভাকে। জেলায় জেলায় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অবৈধ অস্ত্র আর গোলাবারুদ দিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে,বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রচারণায় পাঠানো হত পঁচাত্তরের আত্মস্বীকৃত খুনিদের। দেশে ছিল তখন সামরিক কারফিউ তন্ত্র!

বিজ্ঞাপন

শুধু কি তাই এই পঁচাত্তরের খুনিদের বিদেশের দূতাবাসে উচ্চপদে চাকরি দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। সেইসব দেশে কি অবস্থা ছিল প্রিয় বাংলাদেশের? স্বদেশের জাতির পিতার খুনিরা কিনা ছিল সেই দেশের দূতাবাসের হর্তাকর্তা! ঐসব দেশের কাছে দেশের মানুষের কাছে কি অপমানিতই না হয়েছে ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দু লক্ষ মা বোনের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের বাংলাদেশ। যাঁর নেতৃত্বে বছর চারেক আগে যে দেশটি স্বাধীন হয়েছে সেই নেতার, সেই জাতির পিতার বা রাষ্ট্রপতির খুনিরাই নাকি সেইসব দেশের দূতাবাসের কর্তা ব্যক্তি! এমনই ছিল অনেকদিন প্রিয় স্বদেশের করুন অবস্থা। শুধু কি তাই, সর্বত্রই নিষিদ্ধ ছিল বঙ্গবন্ধু। যার চব্বিশ বছরের নিরীবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম জেলজুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন, নিশ্চিত ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে ফিরে আসা এবং অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করে নিয়ে আসা তাঁরই স্বপ্নের বাংলাদেশে তিনি নিষিদ্ধ। যার ভাষণে ঊদীপ্ত হয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন দেশের আপামর মানুষ সেই ভাষণ নিষিদ্ধ, যে স্লোগানে শক্তি খুঁজে পেত বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেই জয় বাংলা বলা ছিল নিষিদ্ধ। অবহেলায় পরে থাকা জাতির পিতার শেষ ঠিকানা সেই পবিত্র জন্মভুমি টুঙ্গিপাড়ার কবর জিয়ারত করা ছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ। ঐতিহাসিক ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়ি, যে বাড়ি থেকে পরিচালিত হয়েছিল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং যে বাড়িতে জাতির পিতা স্বপরিবারে শহীদ হয়েছিলেন সেই বাড়িতে ঢুকে দোয়া পরা নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি জাতির পিতার কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার হত্যার ছয় বছর পরে শোকার্ত হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে দেশে ফিরে ঐ রক্তাক্ত বাড়িতে প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। শহীদ পিতা মাতাসহ আত্মীয় পরিজনদের রুহের মাগফেরাত কামনার জন্য দোয়া পড়তে হয়েছিল বত্রিশের রাস্তায়। এমনও অনেক দুঃসহ দিন ছিল সোনার বাংলাদেশের।

বিজ্ঞাপন

জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার চাওয়াও ছিল অপরাধ! খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল তথাকথিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামক কালো আইন দ্বারা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খুনিদের লালন করা হত। খুনিদের জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে জিতিয়ে এনে কলঙ্কিত করা হয়েছিল পবিত্র সংসদকে। এমনকি পঁচাত্তরের আত্মস্বীকৃত খুনিদের মূল হোতাদের অন্যতম খুনি রশীদকে সংসদে এনে বিরোধীদলীয় নেতার চেয়ারে বসানো হয়েছিল। এই জঘণ্য কাজটি যিনি করেছিলেন তার স্বামীই ছিল এই খুনিদের মূল পৃষ্ঠপোষক। যিনি ছিলেন সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত এক সেনা শাসক। একই কাজ করেছিলেন তার আরেক উত্তরসূরি সেনাশাসকও। তিনি খুনিদের দিয়ে রাজনৈতিক দলের নামে এক কসাই দল ফ্রিডম পার্টি গঠন করিয়েছিলেন। তাদেরই ঘৃণ্য পদচারণা ছিল সর্বত্র। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের পর থেকে টানা একুশ বছর ছিল এই হায়েনাদের পদচারণা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল ভুলণ্ঠিত, প্রকৃত দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা ছিল ঘাটে ঘাটে অপমানিত, অস্পৃশ্য। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছিল অন্তর্দহনে ক্লিষ্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনিদের বিচারের দাবিতে, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলনরত হয়ে শাসকগোষ্ঠীর বন্দুকের নলের মুখে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ততদিনে দেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার মুর্তপ্রতিক হয়ে উঠেছেন। পিতা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার কাঁধে এসেছে খুনিদের বিচারের ভার, গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে দুঃখী মানুষের মুখে হাঁসি ফোটানোর এক দীপ্ত প্রত্যয়। এতদিনের সেই পথও ছিল কাঁটা বিছানো। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বত্র ঘাতকের বুলেট তাকে তাড়া করিয়ে বেরিয়েছে। অন্ততঃ উনিশবার ঘাতকের বুলেট তাকে নিশানা করেছিলো। শেষবার তাকে আবার ওই আগস্টেই পঁচাত্তরের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে খালেদা নিজামীর দুঃশাসনের সময়ে তাদেরই মদদে ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট দলের শীর্ষ নেতাদের সাথে হত্যা করতে বর্বর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। বরাবরের মতোই মহান আল্লাহর কৃপায় বেঁচে গেলেও কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ চব্বিশজন নেতাকর্মী সেদিন শহীদ হয়েছিলেন। অসংখ্য নেতাকর্মীকে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছিল। এমনই দিন সেসময় ছিল। সে এক বিভীষিকাময় অন্ধকার দিন।

ইতিহাস তার জায়গায় স্বমহিমায় ফিরে আসে। অনেক দিন পরে হলেও পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের খুনিদের বিচারের মাধ্যমে রায় কার্যকর হয়েছে। একইভাবে একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়ে বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীর বিচার হয়ে কেউ ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেছে কেউবা যাবজ্জীবন কারাবাস করছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কয়েকজনের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বিচার হলেও কয়েকজন খুনি এখনো দন্ড নিয়ে পালিয়ে দেশের বাইরে আছে। এই ক্ষত এখনো দেশকে দেশের মানুষকে পীড়া দিচ্ছে। তারাও হয়তো একদিন ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলবে। কিন্তু এখন আর জাতিকে এই কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে হচ্ছে না। কোন বিদেশি দূতাবাসে বা কোন রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে আর খুনিদের পদচারণা নাই। ক্যান্টনমেন্টে আর গভীর রাতে কোন অবৈধ শাসকের নির্দেশে বিনাবিচারে কোন দেশপ্রেমিক সৈনিককে অন্যায়ভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার উম্মত্বতা আর হয় না। কোন টিভি টকশোর আলোচনা খুনিদের কারণে কারও যেতে ঘৃণা লাগে না বা যাওয়ার পরিবেশ নেই তা হয় না। রাষ্ট্র এখন কলঙ্ক মুক্ত। যা এমন অনেকদিন ছিল না। আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের আর পত্রিকায় বা মাঠেঘটে বা অফিস আদালতে সেইসব খুনিদের পদচারণা সহ্য করতে হয় না। টুঙ্গিপাড়ায় শায়িত ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতার কবর আজ বিশ্বের মানুষের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন দেশ বিদেশের মানুষ সেখানে গিয়ে তার পবিত্র রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন। বত্রিশের ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন আজ পৃথিবীর মানুষের জন্য উন্মুক্ত। যেখানে এসে মানুষ স্বচক্ষে দেখে যায় কি সাদাসিধে জীবনযাপন ছিল রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের। আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করে পনেরই আগস্টের নির্মমতার।

আজ আর জঙ্গিদের অভয়ারণ্য নয় এই দেশ। আর সরকারি মদদে গ্রেনেডের ভয়াবহতায় কেঁপে উঠে না কোন সমাবেশ। রক্তে রঞ্জিত হয় না রাজপথ। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে স্বমহিমায় স্বদেশের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে, বিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সেই সম্মানের বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। দূতাবাসে আর কোন আত্মস্বীকৃত খুনিদের প্রতিনিধিত্বের বদনাম সহ্য করতে হয় না। দূতাবাসগুলো আজ এক শক্তিশালী আত্নপ্রত্যায়ী উদীয়মান উন্নত দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ আজ বুক টান করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার হার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। শিক্ষাঙ্গনে নেই অস্ত্রের সেই ঝনঝিনানি। বাংলাদেশ আজ তার আসল জায়গায় ফিরেছে। যে দেশের জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর সে দেশেরই সরকার পরিচালনা করছে তারই সুযোগ্য সন্তান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিছু অসংগতি যে নাই তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এমন বাংলাদেশ অনেকদিন ছিল না।

দেশের অভূতপূর্ব এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন। বিদ্যুৎ ও খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। যমুনা ও পদ্মা নদীর উপর নির্মিত সেতু বাংলাদেশকে এক সুতায় গেথেছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিতে এই অবিশ্বাস্য এগিয়ে যাওয়া, মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন। শেখ হাসিনার সুদৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই অদম্য এগিয়ে চলা আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিপূর্ণভাবে ফিরে আসা এসবই একসময় অনেকদিন ছিল না। যা ছিল তা যেন আর কোনদিন ফিরে না আসে। লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ যেন আর কোনদিন সেই অন্ধকার সময়ে ফিরে না যায় তাই হবে শহীদদের আত্মদানের স্বার্থকতা।

লেখক: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

এমন দিন অনেকদিন ছিল না মুক্তমত মোঃ আসাদ উল্লাহ তুষার

বিজ্ঞাপন

মানুষের হিংস্রতা কেন বাড়ছে?
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৪১

আরো

সম্পর্কিত খবর