মেঘের আড়ালেও সূর্য জ্বলে
২৫ জুলাই ২০২২ ১৭:৩৯
মানবজাতির সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে যে মৌলিক চাহিদাগুলোর বেশি দরকার তার মধ্যে থাকা দরকার যেমন- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, জীবনের নিরাপত্তা, বিনোদন, বাক স্বাধীনতা ইত্যাদি। এখন এই মৌলিক চাহিদাগুলো ছাড়াও যে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো আমরা না চাইতেই পেয়ে থাকি যেমন- আলো, বাতাস, পানি এবং মাটি।
যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুরই পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন হচ্ছে। মানুষ তার জ্ঞান এবং চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ধাপে ধাপে সামনের দিকে সফলতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে। জ্ঞানের সীমানা বৃদ্ধি করতে চিকিৎসা, অর্থনীতি, সাহিত্য, শান্তি, পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নের উপর প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে, এবং এই চলমান উদ্ভাবনী প্রক্রিয়াকে আকর্ষণীয় করার জন্য প্রতিবছর নোবেল পুরস্কারে ভুষিত করা হয় মানবজাতির মধ্যে যারা নতুন এবং সৃজনশীল কিছু আবিষ্কার করেন।
কখনও খারাপ কিছু করার জন্য কিন্তু কোথাও কোন প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে কোন রকমের অনুপ্রেরণা বা উদ্দীপনার ব্যবস্থা নেই, তারপরও সেগুলোরই প্রভাব বেশি বিশ্বে, তথা মানুষের মাঝে! ধর্ম থেকে শুরু করে সকল প্রকার কর্মের কোথাও বলা হয় নি অন্যায় কাজ করার কথা। আমরা সেটাই করছি। উপরে যে বিষয়গুলোর উপর নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয় তার মধ্যে খারাপ কিছু শেখার কোন সুযোগ নেই সত্ত্বেও খারাপ কাজগুলোই ডোমিনেট করছে মানবজাতিকে। এটা আমাকে, আমার চিন্তাকেও ডোমিনেট করছে। যার ফলে আমি বিষয়টির উপর গবেষণা করেছি। ভাবনায় আসতে পারে এটা একটা কথা হলো, শেষে গবেষণা — কেন মানুষ খারাপ আচরণে বা অন্যায় কাজে বেশি আসক্ত? কীভাবে কোন রকম প্রশিক্ষণ বা গবেষণা ছাড়াই এর প্রভাব বেশি বিশ্বে, সমাজে তথা আমাদের মাঝে!
গণিত শিক্ষায় শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন দুই আর দুই কত? শিক্ষার্থী উত্তর দিল প্রথমে পাঁচ, পরে তিন, কখনও বা ছয়, শেষে সঠিক উত্তর বললো বা জানলো, দুই আর দুই যোগ করলে হয় চার, বিয়োগ করলে হয় জিরো, ভাগ করলে হয় এক এবং গুন করলে হয় চার। গনিতের সামান্য এই শিক্ষাটি গ্রহণ করতে জন্ম নিয়েছে আমাদের ব্রেনে কনফিউশন, রিয়াকশন, আবেগ, সলিউশন। এবং যে ভুল তথ্যগুলোর আবির্ভাব হয়েছে তার সবকিছুই কিন্তু মস্তিস্কে আর্কাইভ তথা জমা হয়ে আছে। যার ফলে প্রতিনিয়ত এ ধরনের শিক্ষার কারণে আমরা যত ভুল করি, সঠিক কিছু পাবার জন্য বা গবেষণা করতে করতে শেষে উপনীত হই সঠিক সমাধানের। কিন্তু সঠিক তথ্য পেতে যে পরিমাণ ভুল তথ্য বা গার্বেজ আমাদের মস্তিস্কে জমা হয় তার পরিমাণ অনেক বেশি, যার ফলে ভুলের মধ্য দিয়ে সঠিক তথ্যের সাথে খারাপ বা ভুল করার প্রবণতায় আসক্ত হয়ে থাকি। আরো একটু বিশ্লেষণ করি খেলাধুলোর বিষয়টি নিয়ে, প্রবাদ রয়েছে কমপক্ষে দশ হাজার বার গোলে বল লাথি মারতে হবে তারপরও নিশ্চিত বলা যাবে না যে বল সময় মত গোলে যাবে। মানে সঠিক কিছু পেতে আমরা যত ভুল করব ততই ভুলের উপরও প্রাক্টিস হবে এবং শেষে সেটাও ডোমিনেট করবে। মানে কি দাঁড়ালো? যে যত শিক্ষিত সে ততো অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার দুর্নীতি, অনীতিতে পারোদর্শী। এর মানে এই নয় যে সব শিক্ষিত মানুষই খারাপ। আমি বলতে চাচ্ছি যেহেতু সমাজের বড় বড় দায়ীত্বগুলো শিক্ষিত মানুষেরাই পেয়ে থাকেন তাদের যোগ্যতার কারণে। সেক্ষেত্রে তারা জানেন কীভাবে ভালো কিছু করার পাশাপাশি মন্দ কিছু করা সম্ভব।
তাহলে পরিষ্কার যে শিক্ষার পাশাপাশি আমরা দুটো জিনিস শিখছি। তবে আমরা সঠিক তথ্য পাওয়া না পর্যন্ত যে ভুল তথ্যগুলো জানছি সেগুলোর পরিমাণ এতো বেশি যে মূলত সেটাও শেষ পর্যন্ত আমাদের মন-মানসিকতা তথা বিবেককে গ্রাস করে ফেলছে।
প্রশ্ন হতে পারে তাহলে আমরা কী শিক্ষা ছেড়ে দিব? আমার উত্তর না। তবে আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির ধরণের পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন শিশু শিক্ষার শুরুতেই শিশুকে এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যাতে করে তারা সঠিক এবং বেঠিক দুটোই ডকুমেন্ট ওয়েতে শেখে। যেমন- ছোটবেলা থেকেই আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কখনও মিথ্যা কথা বলবে না, মিথ্যা বলা মহাপাপ। এখন পাপটা কি, তাকে দেখতে কেমন এবং করলে কি হতে পারে ইত্যাদি সম্পর্কে যদিও কখনও বিশ্লষণ করা হয়নি তবুও এসব চিন্তা সবার মনে জেগেছে। আমি মনে করি জীবনে যত ভুল ততো সমস্যার সৃষ্টি, এখন ভুল ছাড়া তো নতুন কিছু শেখাও সম্ভব নয়? তাহলে কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে হবে? উত্তর জটিল হলে সমাধান অনেক আগেই হয়ে যেত। যেহেতু এর উত্তর খুবই সহজ যার ফলে আমাদের চরিত্রে সহজ কিছু করার মন-মানসিকতার অভাব রয়েছে। এর থেকে রেহাই পেতে যে জিনিসটির বেশি প্রয়োজন সেটা হলো স্বীকার করতে শেখা এবং ভুল করা, অন্যায় করা, পরাজিত হওয়া বা ফেল করা। এগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া শিখতে হবে। ছোট করে দেখা, সমাজে হেও প্রতিপূর্ন করা বন্ধ করতে হবে। পরাজয়কে চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখতে হবে। দরকারে নোবেল পুরষ্কারের মত ব্যবস্থা করতে হবে তাহলে সম্ভব হবে সমস্যার সমাধান। মনে রাখতে হবে সব জয়ের পেছেন রয়েছে পরাজয়। কথায় বলে — হাটিতে পারে না শিশু না খেয়ে আছাড়। তাহলে সমস্যা কোথায় পরাজয়কে সহজভাবে মেনে নেওয়ায়? — মনে পড়ে গেল সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার লাইনটি, ‘মেঘ দেখে কেউ করিশনে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে’।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি