গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া: বিপন্ন পৃথিবী
২৬ জুলাই ২০২২ ১৬:১২
গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া নিয়ে আজকে গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা সতর্ক হয়ে উঠছেন। তারা এ প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে মানবজাতিকে কীভাবে রক্ষা করা যায় সে ব্যাপারেও তৎপর হচ্ছেন। গ্রিন হাউজ হচ্ছে কাচের তৈরি একটি ঘর, যার ভেতরে গাছপালা লাগানো হয়। শীতপ্রধান দেশে তীব্র ঠাণ্ডায় অনেক গাছপালা মরে যায়। এ ঠাণ্ডার হাত থেকে প্রয়োজনীয় গাছপালাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই গ্রিন হাউজ করা হয়ে থাকে। গ্রিন হাউজের দেয়াল এবং ছাদ কাচের তৈরি হওয়াতে সূর্যের আলো খুব সহজেই কাচের ভেতর দিয়ে হাউজে প্রবেশ করতে পারে এবং স্বচ্ছন্দে গাছপালা জন্মাতে পারে। অন্যদিকে, বাইরের ঠাণ্ডা ঘরের ভেতর আসতে পারে না এবং ঘরের ভেতরের উত্তাপও বাইরে যেতে পারে না। ফলে গ্রিন হাউজের ভেতরটা বেশ গরম থাকে। ঠিক এভাবেই মহাশূন্য পার হয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে এসে সূর্যের আলো পৃথিবী পৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে। এ উত্তাপের অনেকটাই আবার বিকিরিত হয়ে মহাশূন্যে ফিরে যায়। এর ফলে পৃথিবী খুব বেশি উত্তপ্ত হতে পারে না। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেশি থাকলে এ অবস্থা বিপরীত হয়। পৃথিবীর তাপমাত্রা তখন প্রচুর বৃদ্ধি পায়। গ্রিন হাউজের ভেতরের তাপ কাচের ভেতর দিয়ে বাইরে যেতে না পারায় ঘর গরম থাকে। পৃথিবীর তাপও একইভাবে বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইডের ভেতর দিয়ে মহাশূন্যে যেতে না পারায় পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। গ্রিন হাউজের সঙ্গে মিল রেখেই বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির এ ঘটনার নাম দিয়েছেন গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি পেলে গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া ঘটে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বন নিধন, ব্যাপক শিল্পায়নসহ অন্যান্য দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্টকরণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, মিথেন ও ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি) গ্যাসের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত গ্রিনপিসের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ৩ লাখ ৫০ হাজার বছরে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড যে পরিমাণ বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে গত ৩ শ’ ২৫ বছরে। বর্তমানে কয়লা, খনিজ তেল এবং কাঠ পোড়ানো বেড়েছে ব্যাপক মাত্রায়। গাড়ি ও কলকারখানা বৃদ্ধিতে এর ব্যবহার আরও বেড়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে এবং গাড়ি ও কলকারখানার কালো ধোঁয়ার ফলে উৎপাদিত হয় কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং জলীয় বাষ্প। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের স্প্রে, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার প্রভৃতি যন্ত্র থেকে সিএফসি গ্যাস নির্গত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিজ্ঞানীদের মতে, সিএফসি গ্যাসের একটি অণুর তাপধারণ ক্ষমতা ১৫ হাজার কার্বন ডাই-অক্সাইডের অণুর সমান। এসব গ্যাসের প্রভাবে অতিমাত্রায় সূর্যতাপ পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলে আটকা পড়ে মারাত্মক গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। পৃথিবীব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে এ গ্যাস দিন দিন বাড়ছে। গ্রিন হাউজের প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশ এবং জনজীবন তথা সমগ্র পৃথিবী আজ হুমকির সম্মুখীন।
বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন, গত এক শ’ বছরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণতা বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বিভিন্নভাবে পৃথিবীর আবহাওয়া ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। বায়ুমণ্ডলে সিএফসি, কার্বন ডাই- অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, মিথেন, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ আরও কিছু ক্ষুদ্র গ্যাসকে বলা হয় গ্রিন হাউস গ্যাস। এ গ্যাসের পরিমাণ গত একশ’ বছরের মধ্যে অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, উন্নত বিশ্বের শিল্পায়নের ফলেই মূলত গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ বেড়ে চলেছে। শিল্প কারখানা ও যানবাহন হতে প্রতিনিয়ত নির্গত গ্রিন হাউস গ্যাস বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রাও ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় মেরু অঞ্চলে জমে থাকা বরফ আরও গলতে শুরু করেছে। এর ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা অনেক ওপরে ওঠে আসবে এবং ভূপৃষ্ঠের অসংখ্য নিচু এলাকা এর ফলে ডুবে যাবে। ডুবে যাবে সমুদ্র উপকূলের অনেক দ্বীপ, দেশ ও শহর। গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার ভয়াবহতা নিয়ে আজ তাই বিশ্ববাসী ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন।
বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় জানা যায়, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতি ঘটবে বর্তমানের তুলনায় ৩২ সেন্টিমিটার, যা ২১০০ সাল নাগাদ আরও বেড়ে দাঁড়াবে ৮৮ সেন্টিমিটারে। এর ফলে উপকূলীয় লবণ আক্রান্ত এলাকা দ্রুত সম্প্রসারিত হতে থাকবে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু কিছু উপকূলীয় বাঁধের ভেতরে লবণপানির জলাবদ্ধতা দেখা দিবে। গবেষণায় বাংলাদেশের উপকূলে এ উচ্চতা বৃদ্ধির হার বছরে ৪ থেকে ৮ মিলিমিটার বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা বিশ্বের সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা বৃদ্ধির হারের চেয়ে অনেক বেশি। বিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে বলেছেন, গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ায় সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি লোক এমন জায়গায় বাস করে, যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র ১০ ফুটের মধ্যে। তাই বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের একটা বিরাট অংশ আগামী শতকে সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ আশি দশকের আগে থেকে গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার শিকার হলেও আশির দশকে এর প্রকোপ বাড়তে শুরু করে এবং এখনো সেই প্রতিক্রিয়ায় দেশে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় দেশই গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে বিজ্ঞানীরা ভয়াবহ মন্তব্য করেছেন।
প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং অপব্যবহারের নির্মম পরিণতিই হচ্ছে গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া। আর তাই আমাদের সবাইকে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। গ্রিন হাউজের মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করছেন। কেউ কেউ বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফেয়ারে সালফার ডাই-অক্সাইড ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু এতে আবহাওয়ামণ্ডলের ওপর সালফিউরিক অ্যাসিড কণার যে স্তর তৈরি হবে, তা পৃথিবীকে শীতল করলেও ক্ষতিকর অ্যাসিড বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, আমাদের সুন্দর পৃথিবীকে রক্ষা করতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তিকে কাজে লাগালে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমানো যাবে। তাই সৌর ও অন্যান্য শক্তি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। ধানক্ষেতে সেচের ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে, যাতে মিথেন গ্যাস কম নির্গত হয়। কলকারখানায় জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গৃহস্থালী ও শিল্প-কারখানার আবর্জনা প্রক্রিয়াজাত করতে হবে। গ্রিন হাউজের প্রতিক্রিয়া একমাত্র রোধ করতে পারে অধিক বনাঞ্চল। বনাঞ্চল হচ্ছে বাতাসে কার্বনের পরিমাণ কমানোর সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ও সহজ পদ্ধতি। তাই আমাদের সবাইকে পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে এবং গ্রিন হাউজের প্রতিক্রিয়ার প্রভাব থেকে রেহাই পেতে বনায়নের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। পাশাপশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমাতে হবে। তবেই না আমরা ভয়াবহ হুমকি থেকে বাঁচাতে পারব দেশ, বাঁচাতে পারব সমগ্র পৃথিবী।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি