মুদ্রাস্ফীতি — করণীয় ও বর্জনীয়
২৬ জুলাই ২০২২ ১৭:৩৮
কোভিড-১৯, গোটা বিশ্বকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। গত দুই বছরের বেশি সময় ভয়, আতঙ্ক এবং নানা রকম কষ্টের মধ্য দিয়ে মানবজাতি সময় পার করে চলতে পথে নতুন দুর্ভোগের মুখোমুখি। রাশিয়া আক্রমণ করেছে ইউক্রেনকে যা গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
সুইডেন একমাত্র দেশ যারা করোনা মহামারীতে লকডাউন দেয়নি। যার ফলে মাসুল দিতে হয়েছে ৬-৭ গুন মানুষের জীবন, প্রতিবেশি দেশগুলো ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক বা নরওয়ের তুলনায়। এখনও কোভিড-১৯ গোটা বিশ্বে বিরাজমান ঠিক এই রকম একটি দুঃসময়ে বেধেছে যুদ্ধ, যার প্রতিক্রিয়া পৃথিবীর সর্বত্র কোনো না কোনোভাবে শুরু হয়েছে। তবে সুইডেনে এর প্রভাব এতবেশি পড়েছে যা বর্ণনা করা সম্ভব নয়, তবুও বিষয়টির ওপর আলোকপাত করব এবং তুলে ধরবো এর ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া।
এ বছরের শুরুতেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে। জ্বালানি তেল, গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যোগাযোগের মাধ্যম তথা প্লেন, ট্রেন বাস সহ বোটের টিকিটের দাম বেড়েছে। বাড়েনি কারো আয়, তাহলে কি দাঁড়ালো? সহজ করে বলি যাতে বুঝতে সহজ হয়। পিঁয়াজের কেজি সাধারণত দশ টাকা, হঠাৎ হয়ে গেল পঞ্চাশ টাকা। কি দাঁড়ালো? দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি লাভ করলো এবং অর্থের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকলো। টাকার মূল্য হ্রাস পেতে থাকাকে বলা হয়ে থাকে মুদ্রাস্ফীতি বা ইনফ্লেশন।
মুদ্রাস্ফীতি বা ইনফ্লেশন নানাভাবে হতে পারে এবং এ বিষয়ে নানা জনের নানা রকম ব্যাখ্যা রয়েছে। যেমন- কারো মতে উৎপাদন প্রচেষ্টা অপেক্ষা মানুষের আয় যদি বেশি হয় তবে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। কারো মতে, ক্রয় ক্ষমতার অস্বাভাবিক পরিমাণ বৃদ্ধিই হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। কারো মতে, মুদ্রাস্ফীতি হল এরূপ একটি পরিস্থিতি যেখানে অত্যাধিক পরিমাণ অর্থ অতি সামান্য পরিমাণ দ্রব্য সামগ্রীর পশ্চাতে ধাবিত হয়। কারো মতে, মুদ্রাস্ফীতি এমন একটি অবস্থা যখন অর্থের মূল্য ক্রমেই হ্রাস পায় অর্থাৎ দ্রব্যমূল্য ক্রমে বৃদ্ধি পায়। আরো নানা ধরনের ব্যাখ্যা রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি বা ইনফ্লেশন নিয়ে তবে সকল সংজ্ঞার বিশ্লেষণ করলে মুদ্রাস্ফীতির ওপর নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।
সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, যখন একটি দেশে বা বিশ্বে পরিচালিত অর্থের পরিমাণ উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর তুলনায় অধিক হয় এবং এর ফলে দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্ত হলো তখন তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়। এটা মূলত নতুন কিছু নয়, তবে ভাবতে হবে কেন এমনটি হয় এবং কি কারণ এর পেছনে?
আমেরিকার বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি বা ইনফ্লেশন এত বেশি যা গত চল্লিশ বছরে দেখা যায়নি, কি করছে দেশটি এসময়? ব্যাংকের থেকে টাকা ধার নিতে গেলে বা যাদের ধার রয়েছে তার ওপর সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা করছে ইউরোপে এমনকি সুইডেনে। আমি সদ্য একটি ফ্লাট কিনেছি হঠাৎ সুদের পরিমান দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছে যার ফলে আমার বসবাসের খরচ অতীতের তুলনায় দুইগুন বেশি হয়েছে। এদিকে আমার বেতন বাড়েনি। অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম আগুনের মত গরম। ভাবুন তাহলে আমি সহ অন্যান্য জনগণের বর্তমান অবস্থা? হ্যাঁ, অবস্থা খুবই করুন!
ইউরোপের মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতি এবং তা মোকাবেলায় দেশগুলো বিভিন্নরকম পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন: বিশ্বের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো ইউরোপের ব্যাংকগুলোরও মূল লক্ষ্য হল মুদ্রাস্ফীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় অর্থনীতিতে বিদ্যমান মুদ্রাস্ফীতির প্রত্যাশার মানদণ্ড হিসাবে কাজ করা, এবং মুদ্রাস্ফীতি প্রতি বছর ২ শতাংশের কাছাকাছি রাখা। সুইডেনের বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি ৮ শতাংশের বেশি। সেক্ষেত্রে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার ০.৭৫ শতাংশ বাড়িয়েছে এবং বলছে বছরের শেষে আরো ১.২৫ শতাংশ বাড়াবে যদি তার আগে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসে।
রাজনীতিবিদসহ সারা বিশ্ব বিশ্লেষণ দিচ্ছে কোভিড-১৯ এবং ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ এর জন্য দায়ী। কোভিডে না হয় মানুষের তেমন করণীয় ছিল না, কাজ কর্ম ছাড়া ঘরে বসে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে সীমিত দ্রব্যমূল্য কিনতে বেশি অর্থের প্রয়োজন পড়েছে তখন। এখন সবকিছু দ্রুতগতিতে উৎপাদিত হবার কথা এবং তার জন্য দরকার যেমন জ্বালানি তেল ইত্যাদি ঠিক তেমনি একটি সংকটময় সময় যুদ্ধ?
সারাবিশ্বে যেমন কোভিড-১৯ এবং ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তেমনি বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। যেমন তেলের দাম বেড়েছে, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, যাতায়াত খরচ বেড়েছে। কিন্তু এখানেও একই অবস্থা। কারোই দৈনিক আয় কিন্তু বাড়েনি আর সেটা বাড়ানও খুব কঠিন। তবে অন্যান্য দেশে বা বলতে পারেন ইউরোপ আমেরিকায় যেমন মুদ্রাস্ফীতির মারাত্মক প্রভাব দেখা দিয়েছে তেমন প্রভাব কিন্তু বাংলাদেশে এখনও দেখা দেয়নি। দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ঠিকই কিন্তু ইউরোপ আমেরিকার মত কড়াকড়ি প্রভাব এখনও আমাদের দেশে পড়েনি।
ইউরোপ আমেরিকার মত যেমন এত কড়াকড়ি প্রভাব এখনও আমাদের দেশে পড়েনি তাই এটাই একটা সুযোগ আমাদের জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার। বাংলাদেশ ব্যাংকও এসব বিষয়ের উপর নজর রাখছে। তারাও যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কয়েক ধাপে সুদহার বাড়িয়েছে এবং ২০২২ সালের শেষ নাগাদ সুদহার আরো বাড়াবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
আর বলা হয়ে থাকে সুদহার বাড়ানোই হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অব্যর্থ ঔষধ। তবে আমি মনে করি এই ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরো কি কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে সেগুলো খুঁজে বের করা এবং দ্রুত সেগুলো আরোপ করার এখনই সময়!
মানবজাতির উপর দিয়ে একের পর এক মানবসৃষ্ট কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাচ্ছেই। থামাথামির যেনো কোনো কথাই নেই। যেমন: মহামারী, ইউক্রেন – রাশিয়া যুদ্ধ এবং এর নেতিবাচক প্রভাব, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ইত্যাদি। আর ইউক্রেন – রাশিয়া যুদ্ধ যেনো আংশিকভাবে হলেও বৈশ্বিক যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। এটা আরো ছড়িয়ে পড়লে না জানি কি হবে! আর এই সমস্ত প্রভাব পরে সাধারণ মানুষের উপর।
আধুনিক ঔপনিবেশিক শক্তি, পুঁজিবাদী শক্তি, দুর্নীতিবাজ, অত্যাচারী শাসক, একনায়কতন্ত্র বা এই ধরনের যত অপকর্মকারী রয়েছে এবং এরা যত রকমের অপকর্ম করে এর সব প্রভাব শেষে গিয়ে পরে সাধারণ জনগণের উপর এবং অনেক সময় এদের লালসার কারণেই চলে যায় হাজার হাজার সাধারণ মানুষের জীবন। বলা হয়ে থাকে জনগণেই সকল ক্ষমতার উৎস তাই জনগণকেই এসব অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে হবে। এদের পতন ঘটাতে পারলেই আসবে স্বস্তি!
বর্তমান বিশ্বে যে সমস্যাগুলো মানুষের সৃষ্টি তার সমাধান সমস্যার মধ্যদিয়ে শেষ হলেও এর ধারাবাহিকতা নতুন সমস্যার বীজ বপন করে চলেছে। যুদ্ধের অবসান এক প্রান্তে হলেও শুরু হচ্ছে অন্য প্রান্তে।
পৃথিবীর সবাই জানে আমাদের জীবনের সংকটময় সময়টি তারপরও জেনে শুনে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং এর জন্য শুধু রাশিয়াকে দায়ী করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে?
বরং সময় এসেছে ভাবার কারা মূলত এই সর্বনাশের জন্য দায়ী! মনে হচ্ছে গোটা বিশ্বের সর্বনাশের জন্য পুঁজিবাদীরাই মূলত দায়ী।
আমরা সাধারণ মানুষ অনেকটা তিমি মাছের ফাঁদে পড়েছি। তিমি মাছ খাদ্য সংগ্রহের সময় তার মুখে খুলে দেয়, অন্যান্য মাছ সেখানে এসে খেলা করে, সময় মত তিমি মাছ মুখ বন্ধ করে দেয়। পুঁজিবাদীদের আমরা তিমি মাছের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। পুঁজিবাদীরা ভালো মানুষের মুখোশ পরে আমাদেরকে বিভিন্নভাবে ফাঁদে ফেলে। এভাবেই চলছে যুগের পর যুগ ধরে।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো তাদের অতীতের অস্ত্রপাতি বর্তমান যুদ্ধে ব্যবহার করছে নতুন অস্ত্রপাতি তৈরি করার জন্য। একটি দেশকে ধ্বংস করা হচ্ছে আবার নতুন করে গড়বে বলে। পুঁজিবাদীরা এভাবেই বিনিয়োগ করে থাকে। একদিকে মানুষের জীবন বাঁচাতে বিনিয়োগ চলছে অন্যদিকে মানুষকে ধ্বংস করার জন্যেও পুঁজিবাদীর পুঁজিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। চমৎকার বিশ্বে আমাদের বসবাস!
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি