পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ প্রেমী কথাসাহিত্যিক লেখক আহমদ ছফা
২৮ জুলাই ২০২২ ১৬:০৯
আমার কথা কইবে পাখি করুণ করুণ ভাষে
আমার দুঃখ রইবে লেখা শিশির ভেজা ঘাসে
আমার গান গাইবে দুঃখে পথ হারানো হাওয়া
আমার নাম বলবে মুখে মেঘের আসা যাওয়া
ইন্দ্রধনু লিখবে লিখন কেমন ভালোবাসে
দীঘল নদী করবে রোদন সমাধিটির পাশে
—আহমদ ছফা
কথাশিল্পী আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০শে জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দক্ষিণ গাছবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী সম্পন্ন করে গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বোয়ালখালী কানুনগো পাড়া স্যার আশুতোষ কলেজেও স্নাতকে কিছুদিন পড়াশুনা করেন । পরীক্ষা বর্জন করে শেষে ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অনার্স অধ্যয়ন ও পরীক্ষা বর্জন। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করে পরবর্তীতে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্যারের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি গবেষণা (অসম্পূর্ণ) জার্মান ভাষা ডিপ্লোমা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্পকালের জন্য অধ্যাপনাও করেন। ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখি শুরু। ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষকসমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। কৃষক আন্দোলন সংগঠনে থাকাকালীন সময়ে কারাবরণও করেছিলেন। দৈনিক গণকণ্ঠ ও সাপ্তাহিক উত্তরণ, উত্থান পর্বে নিয়মিত লিখতেন। উত্থান পর্বের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন লেখক নিজেই। উত্তরণের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। লেখালেখি ও সম্পাদনায় স্বচ্ছতা ও সাহসী ও স্পষ্টবাদিতায় সাংবাদিক মহলে বাংলাদেশের উজ্জ্বল এক দীপ্তিমান মেধাবী লেখক আহমদ ছফা। তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলা জার্মান সম্প্রীতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। লেখক একের পর এক অনবদ্য রচনা করে গেছেন। যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায়, তথাপি তাহার নাম নিত্যান্দ রায়- লেখক আহমদ ছফা জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি অধ্যয়ন শুরু করেন। গুরু ও রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে তাঁর পাঠক নন্দিত বই –‘যদ্যপি আমার গুরু’ অনেক জনপ্রিয় একটি বই, এছাড়াও অর্ধশতাধিক বই রচনা করেছেন লেখক আহমদ ছফা, উল্লেখযোগ্য তার জীবনের প্রথম গ্রন্থ বরুমতির আঁকেবাঁকে।
প্রবন্ধসমূহের মধ্যে আছে জাগ্রত বাংলাদেশ, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, বাংলা ভাষা, রাজনীতির আলোকে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা, বাঙ্গালি মুসলমানের মন, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ, রাজনীতির লেখা, নিকট দূরের প্রসঙ্গ, সংকটের নানা চেহারা, সাম্প্রতিক বিবেচনা, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ, বাঙ্গালি জাতি এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্র, আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, সেই সব লেখা ইত্যাদি, উপন্যাস লিখেছেন অনেক ‘সূর্য তুমি সাথী’, ‘উদ্ধার’, ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’, ‘অলাতচক্র’, ওঙ্কার, গাভীবিত্তান্ত, অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী, পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ, নিহত নক্ষত্র, কবিতার বইও লিখেছেন, জল্লাদ সময় ও দুঃখের দিনের দোহা, একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা, লেনিন ঘুমাবে এবার, আহিতাগ্নি, এছাড়াও কিশোর গল্প ও শিশুতোষ ছড়া, ভ্রমণকাহিনি লোকজন ভাষার ব্যবহার, পুঁথিপুরাণের শব্দ প্রয়োগ ও বাক্যরীতির সঠিক চয়নে, অনুবাদ করেছেন জার্মান কবি গ্যাটের গুতের ফাউস্ট ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য রচনা। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস অলাতচক্র অবলম্বনে হাবিবুর রহমান পরিচালিত “অলাতচক্র” নামে একটি ত্রিডি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে।
লেখক আহমেদ ছফাকে আমরা দেখতে পাই একজন প্রকৃতি ও শিশুপ্রেমী হিসেবে। প্রকৃতির প্রতি বিশেষ করে পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ-র প্রতি তার যে ভালোবাসা সত্যি হৃদয় স্পর্শ করে লেখকের একরাত কবিতায় লিখেছেন, ‘এখন গভীর রাত- ঈশ^রের পৃথিবী শান্ত নিসর্গ নিশ্চুম নক্ষত্রের চোখে ঘুম, পশু-পাখি গাছ-পালা ঘুমে অচেতন আমার নিভৃত প্রাণে নিশাচরী তুলেছ কেতন জ্বালিয়ে দিয়েছ হু হু দাবানল এই রাতে পুড়িছে অন্তর। এখন গভীর রাত পৃথিবী নিদ্রার ঘোরে ওলটে পালটে ঘুমন্ত শিশুর মত, শান্ত বড় সুখাবেশমাখা সারাদেহ ভাঙ্গা হেমন্তের চাঁদ কৃশতনু নারী যেন ক্ষীণ স্নেহ’।
‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণে’ লেখক বলেছেন, ‘ফুল ফোটানো সহজ কথা নয় শূন্য থেকে মূর্ত করা সৃষ্টির বিস্ময়। পারে সে জন ভেতর থেকে ফোটার স্বভাব যার, ফালতু লোকের ভাগ্যে থাকে বন্ধ্যা অহংকার’ লেখক আহমদ ছফার বৃক্ষের প্রতি যে মায়া ভালোবাসা সত্যি অকল্পনীয়। ‘সবুজ উদ্ভিদের যে একটা আত্মা রয়েছে তার স্পর্শ আমার নিজের আত্মায় এসে লাগে। মুখে কোনো বাক্য আসতে চায় না। এইখানে ঈশ্বরের এই প্রাচুর্যের পাশে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে’। আহা বৃক্ষ নিয়ে কী সুন্দর অনুধাবন লেখকের। বৃক্ষের মাঝে তিনি মানুষের জীবন ও আত্মা সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। তিনি আপেল চারাকে আপেল শিশু এবং বৃক্ষচারাকে তরুশিশু বলে চমৎকার একটা উপমা উপস্থাপন করেছেন। কাক নিয়ে বলেছেন, ‘কাক একটু কর্কশ বটে কিন্তু কান খাড়া করে শুনলে তার ভিতর একটা চিকন রেশ পাওয়া যাবে। কেন যে পাখিটিকে নোংরা পাখি বলে আমি তো তার কারণ খুঁজে পাইনি। কাক চেষ্টায় বক ধ্যানং কাকের মতো চেষ্টা করতে হবে, বকের মতো ধ্যান করতে হবে। স্বল্পহার, স্বল্প নিদ্রা এবং গৃহত্যাগ বিদ্যার্থীর পাঁচটি লক্ষণ’। লেখক বুলবুলি পাখির সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বুলবুলি পাখি যে খাবারে ঠোকর দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে যে গানের স্বর ঝরে পড়ে সেটাকে তিনি পাহাড়ি ঝরনা বয়ে যে পাথরের ঘষা লেগে যে নরম ভেজা শব্দ-র সাথে তুলনা করেছেন। তিনি খাঁচায় করে শালিক ও টিয়া পাখি পুষতেন। টিয়া পাখি কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন যান্ত্রিক নগরে। শালিক পাখিকে পুত্র বলে সম্বোধনও করেছেন। শালিক পাখিকে উন্মুক্ত করার পর বেশকিছুদিন পর যখন দেখলেন অন্য একটি শালিক পাখি নিয়ে পোষা শালিক যখন দেখলেন বাড়ির ছাদে তখন তিনি বলেছেন, ‘আমার পাখি পুত্রটি একটি বউ জুটিয়ে নিতে পেরেছে দেখে আমার খুব আনন্দ হলো’। পাখিদের শরীর থেকে পবিত্র সৌন্দর্য-র কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। ‘এই পুষ্প, এই বৃক্ষ, এই তরুলতা, এই বিহঙ্গ আমার জীবন এমন কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে, আমার মধ্যে কোনো একাকিত্ব, কোনো বিচ্ছিন্নতা আমি অনুভব করতে পারিনি। আমি পাখি পুত্রের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। আমার পাখি পুত্র আমাকে যা শিখিয়েছে কোনো মহৎ গ্রন্থ, কোনো তত্ত্বকথা, কোনো গুরুবাণী আমাকে সে শিক্ষা দিতে পারেনি। একমাত্র অন্যকে মুক্ত করেই মানুষ নিজেই মুক্তি অর্জন করতে পারে। আমার পাখি পুত্র মুক্ত আমি মুক্ত আমাদের সম্পর্ক থেকে প্রত্যহ অমৃত উৎপন্ন হয়। এই আকাশের জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে সেটা কি অমৃত সমুদ্রের অবগাহন নয়?’ লেখক পাখিদের ভাষা, পুষ্প-বৃক্ষের ভাষা বুঝতে পারতেন। প্রকৃতি ও শিশুদের প্রতি ছিল তার জলতরঙ্গ ভালোবাসা। নিজে সংসার করেননি কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করে গেছেন, তিনি বলতেন, ‘সকলে আমার মধ্যে আছে, আমি সকলের মধ্যে রয়েছি। শরীরের কোনো অংশ অসুস্থ হলে যেমন পুরো শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। তেমনই দরিদ্র ও বস্তিবাসী শিশুদের শিক্ষা বঞ্চিত করে দেশকে সমৃদ্ধ করা যাবে না’। দুঃসময় কবিতায় লিখেছেন, নদীতে বইছে বেগে খরতর খলস্রোত দুকূলে নামছে ধ্বস, অবিরত চলছে ভাঙন, ভাঙন ভাঙন শুধু চারিদিকে ভাঙনের ক্ষণ। তিনি ফুলের মতো শিশুদের মতো জীবনযাপন উপভোগ করতে পছন্দ করতেন। প্রকৃতি ও শিশুদের মাঝে নিজের জীবনকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন মানুষ ও প্রকৃতি একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ যেন প্রকৃতির মাঝে তরুলতা হয়ে দুলছে আর খেলছে। প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে।
সাহিত্যের মাঝে অনন্তকাল বেঁচে থাকুক কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখে গেছেন লেখক আহমদ ছফা। মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যু হলো শোকের চেয়েও প্রয়োজনীয়, মৃত্যু জীবিতদের জন্যে স্পেস সৃষ্টি করে। মৃত্যু সৃষ্ট জীবের কলুষ কালিমা হরণ করে, মৃত্যু জীবনকে শুদ্ধ এবং পবিত্র করে’। জীবনের প্রতি কোন মায়া ছিল না। নিয়মকানুন মানতেন না, খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করতেন না, গানের কথায়ও লিখেছেন, ‘ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম আউল বাউল ফকির সেজে আমি কোনো ভেক নিলাম না’।
২০০১ সালে ২৮ জুলাই বাংলাদেশের সক্রেটিস খ্যাত কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা সবাইকে কাঁদিয়ে চিরতরে প্রস্থান নেন। সাহিত্য জগতের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বিচিত্র দার্শনিকের শেষের ঠিকানা হলো মিরপুর কবরস্থানের ব্লক ক, ২৮ লাইন ১০৮৫ নং সাড়ে তিন হাত ছোটো মাটির কুটিরে শুয়ে আছেন। বর্তমান প্রজন্মের দাবি একটাই কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফাকে যেন মরণোত্তর বাংলা একাডেমি পদকসহ যথাযথভাবে মূল্যায়ন ও সম্মাননা প্রদানসহ সবার প্রত্যাশা প্রিয় লেখক আহমদ ছফার নামে গাছবাড়িয়া গ্রামে স্মৃতিবিজড়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাগার ও ছফা একাডেমি ও তার নামে নামে সড়কের নামকরণ করার জন্য চন্দনাইশ উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের কাছে সবিনয় নিবেদন করছি।
লেখক: প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ প্রেমী কথাসাহিত্যিক লেখক আহমদ ছফা মুক্তমত রশীদ এনাম