আবেগে এতবড়ো সর্বনাশ কেন?
৩০ জুলাই ২০২২ ১৭:১৭
নড়াইলের লোহাগড়ায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনার পর গত ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘ইমোশন কাজে লাগিয়ে একটি গোষ্ঠী অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। একটি ছেলের ফেসবুকের পোস্ট দেখে আবেগের (ইমোশনাল) বশবর্তী হয়ে নড়াইলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে।’
একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী হিসেবে সবার কাছে স্থান করে নিয়েছেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। অনেক বুঝে শোনে ও তথ্য যাচাই বাছাই করে তিনি ঠান্ডা মাথায় কথা বলেন। অর্থাৎ তিনি নড়াইল ইস্যুতে যা বলেছেন তা মোটেই মনগড়া নয়। খবর নিয়েই বলেছেন, এতে কোন সন্দেহ নেই।
কথা হলো আবেগের বশবর্তী হয়ে মানুষ, মানবতা ও একটি ধর্মের বিরুদ্ধে এতবড় আঘাত হানতে পারে? পরিকল্পিতভাবে যারা এই অপকর্মটি করেছেন তাদের মনে কী একবারও কাজ করেনি? ঘরে মানুষ রেখে আগুন দেয়া, সম্পদ লোটপাট, ভাঙচুর করা, দেবালয় ধ্বংস করে দেয়া অন্যায়। ধর্মের দৃষ্টিতেও এটি পাপ কাজ। শত শত হামলাকারীর মধ্যে কারো বিবেক কি জাগ্রত হয়নি? এতবড় সর্বনাশ করতে বুক কাপেনি? এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
একেবারেই পরিকল্পনা অনুযায়ি কাজটি না হলে; কারো না কারো মনে প্রশ্ন জাগতো, আমরা যা করছি বা করার চিন্তা করছি তা মোটেও ন্যায়সঙ্গত নয়। ধর্মের দৃষ্টিতেও এর চাইতে পাপ কাজ হয়না।
ঘটনার পর আশপাশের যারা প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছেন তাদের মনে তো কোন আবেগ কাজ করেনি। তাদের মধ্যে তো অনেকেই ইসলাম ধর্মের অনুসারি ছিলেন। তারাও শোনেছেন ধর্মীয় অবমাননার জের ধরেই এই হামলা। তবে তাদের মনে আবেগ কেন কাজ করেনি? ধর্মকে বড় করে দেখেননি।
তাদের তো উচিত ছিল ভাঙচুর, আর অগ্নিসংযোগে অংশ নেয়া। আগুনের লেলিহান শিখায় যখন সবকিছু জলছিল তখন আকাশে বাতাসে অসহায় মানুষের গগনবিদারি আর্ত্মচিৎকার শোনা গেছে। বিপদগ্রস্থ হয়ে কাঁন্নায় ভেঙ্গে পরা সেসব মানুষদের আরো অত্যাচার করে ধর্ম অবমাননার প্রতিশোধ নিতে পারত- বিপদে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা মানুষগুলো।
উল্টো তারা নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাঁড়ালেন। আগুন নিভাতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষদের আশ্রয় দিলেন। অসহায় মানুষদের মুখে খাবার তুলে দিলেন। দুর্বৃত্তদের ঠেকাতে পাহারা বসালেন। কেন মানবতার পথে হাটলেন তারা? কারণ একটাই তাদের মধ্যে কোন পরিকল্পনা ছিল না। লোটপাটের ধান্দা ছিল না। দেবালয় ভাঙচুরের পরিকল্পনা ছিল না। নারীদের প্রতি লোভ ছিল না। তারা মানুষ হিসেবে প্রকৃত কাজটি করেছেন। এটাই বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি।
প্রশ্ন উঠেছে, দেশে যারা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ, তাদেরই কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, আর কারও ধর্মীয় অনুভূতি নেই? অন্য কোন ধর্মকে আঘাত দিয়ে দেশে কেউ কথা বলে না বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় না। যখন এমন ঘটনা ঘটে তখন সংখ্যাগুরুরা তো প্রতিবাদ করে না। অপরাধী ব্যক্তির বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর করতে দেখি না। যারা লোহাগড়ায় হামলা চালিয়েছে তাদের সামনে অন্য ধর্মকে কেউ অবমাননা করলে, প্রতিবাদ করতো?
এই যে লোহাগড়ায় সনাতন সম্প্রদায়ের মন্দির ও প্রতিমা ভাঙা হলো, তাতে কি তাদের ধর্মীয় অনুভূতি আক্রান্ত হয়নি? তারা এর প্রতিকার পাবে? কেবল ভাঙা বা পুড়ে যাওয়া ঘর নির্মাণ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাদের হৃদয়ে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা কোন কিছুতেই পূরণ হবে না। শত-শত বছরের সম্প্রীতি যেখানে বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে তা কিভাবে ভুলবেন আক্রান্ত মানুষগুলো। যারা পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন তারাই বোঝে হৃদয়ে যন্ত্রণা কতোটুকু। এরকম ধারাবাহিক হামলার ঘটনা বন্ধ করতে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গেল ১৪ বছরে বেশিরভাগ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ফেসবুক’-এ ধর্মীয় অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে। তদন্তে বেশিরভাগ ঘটনার সতত্য মিলেনি। অর্থাৎ ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে একটি গোষ্টী দেশের বিভিন্ন জেলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। যারা ধর্ম রক্ষার নামে অন্য ধর্মের মানুষের ওপর হামলা চালাচ্ছে, বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ করছে, মন্দির ভাঙছে প্রকৃতঅর্থে তারা কী ধার্মিক? তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ধর্ম রক্ষা নয়, ভিন্ন কিছু এটা নিশ্চয়ই সরকারও বোঝে।
যদি তারা প্রকৃত ধার্মিক হতো তাহলে তো একের পর এক এমন ঘটত না। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক সরকার ক্ষমতায়। প্রতিটি ঘটনায় জড়িতরা সর্বদলিয় হলেও নেতৃত্বে থাকে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। এর চাইতে দুঃখের, যন্ত্রনার আর কী হতে পারে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা ১৪ বছর ধরে অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছি কাগজে কলমে আর সভা সেমিনারে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টিকোন থেকে গ্রামে গ্রামে যাদের বীজ বপন করার কথা, তারা কিন্তু মোটেই বসে নেই। তারা কাজের কাজটুকু করছে পরিকল্পনা মাফিক।
বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটি চক্র। নতুন প্রজন্মকে কথিত ধর্মের আবরণে সাম্প্রদায়িক করে তুলছে। অর্থাত অপশক্তি বা দেশবিরোধী শক্তি প্রচ- সক্রিয়। কিন্তু করণীয় শক্তি নির্বিকার। এটা হতে পারে না।
নড়াইলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনার পর ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বিশিষ্ট বাম নেতা রাশেদ খান মেনন এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘দেশের চারদিক তাকালে মনে হয় দেশটা আফগানিস্তান হয়ে গেছে, বাংলাদেশ নয়। যে ঘটনাগুলো ঘটছে এগুলো বাংলাদেশের চরিত্র নয়।’
একজন তুখোর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে বাংলাদেশের প্রকৃত চেহারা তার চোখ ফাঁকি দেবে এটা কখনই ভাবা যায় না। তিনি নিশ্চয়ই দেশে আফগানিস্তানের উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও তাদের সামাজিকতা, পোশাক আশাকের চিত্র লক্ষ করেছেন। সাদা চোখে সমাজের এমন বাস্তব চিত্র অনেকেরই দেখার কথা। তাহলে কী রাষ্টযন্ত্র তা দেখছে না? নাকি দেখেও না দেখার ভান করছে?
অপশক্তিকে মোকাবেলা না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকা মানেই সামনে আরো বিপদ আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ বিরোধী শক্তি মাঠ তৈরী করে রেখেছে। ইস্যু সৃষ্টি করে উদ্দেশ্য সফল করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর থেকে এই উপমহাদেশে যারা সাহিত্য চর্চা করেছেন তাদের অনেকেরই লেখনিতে সময়কে তুলে আনা হয়েছে। সময়ের লেখনিতে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মে ধর্মে বিভেদ, হিংসা কমবেশি প্রকাশ পেয়েছে। সময়ের কারণে তা শক্তি সঞ্চয় করে ভয়ারবহ রুপ লাভ করেছে। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতা নতুন কিছু নয়। সবাই নীরবে বসে থাকার কারণেই আজ এই রোগ ক্যান্সারে রুপ নিয়েছে। এখন দেখতে হবে এর পর্যায় কতোদূর…। চতুর্থ পর্যায়ে যেন না যায়।
কষ্টের কথা হলো ফেসবুক নিয়ে এতোকিছু। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ যদি ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করে স্ট্যাটাস দেয় তা সেন্সর করাতে সরকার ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করাতে পারেনি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ছবি পোস্ট দেয়া হলে তা বিভৎস বা বিতর্কিত পোস্ট বলে ফেসবুক নানা বিধিনিষেধ দেয়। কিন্তু ধর্মীয় ইসুতে বিতর্কিত পোস্টগুলো ফেসবুক গ্রহণ করছে। এই পোস্টগুলোর কারণে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হচ্ছে। একজনের আইডি হ্যাক করে অন্যজন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে স্ট্যাটাস দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে, সমাজে হানাহানি বাড়াচ্ছে। তাই সময়ের দাবি এখন ফেসবুক নিয়ন্ত্রণ করার।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি উপলব্দি বেশ বাস্তবসম্মত মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘ইমোশন কাজে লাগিয়ে যারা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় তারা সব জায়গাতেই এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে’। মাঠের বাস্তবতা আসলে তাই। একটি গোষ্টী তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য গুজব ছড়িয়ে সবাইকে উসকে দিয়ে মানুষের ওপর হামলে পড়ছে। এর বিহিত দরকার।
সরকার তথা আওয়ামী লীগ সহ অসাম্প্রদায়িক চেতনার সবাইকে বোঝা উচিত উগ্র সাম্প্রদায়িকতা সমাজকে গ্রাস করেছে। যারা এসবের কুশিলব তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে বাংলাদেশের মূল চরিত্র ফিরিয়ে আনতে মাঠ পর্যায়ে সম্মিলিতভাবে কাজ শুরু করা উচিত।
একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন জোড় করে বা অত্যাচার করে মানুষের বিশ^াস ভঙ্গ করা যায় না। বা প্রকৃত আদর্শ থেকে বিদ্যুত করা যায় না। যেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইমোশনে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনার কথা বলেছেন সেদিন বিকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি ঘুরপাক খাচ্ছিল।
এতে দেখা গেছে, লোহাগড়ায় ভাঙচুর করা মন্দিরে প্রতীমার চিহ্নটুকু নেই। তবুও বাইরে দাঁডিয়ে এক ব্যক্তি হাতজোড় করে পরম ভক্তিতে প্রণাম করছেন।
ছবিটি দেখে বারবার কেন জানি মনে হচ্ছিল, মূর্তি ভাঙচুর করলে কি আর ভক্তি কমে? ভক্তি থাকে অস্তিত্বে, ভক্তি থাকে হৃদয়ে। যা কখনও মুছে দেয়া সম্ভব নয়। ধর্ম হলো বিশ্বাস। কেউ কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন ধর্মেরই বিশ্বাস ভাঙতে পারে না।
পৃথিবীর যেসব দেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে সেখানে ধর্ম নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি, হানাহানি, হিংসা ও বিদ্বেশ নেই। যে যার মতো করে নীরবে ধর্ম চর্চা করেন। তাদের কাছে কাজই বড়। আমাদের কর্মমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠা জরুরী। আসলে কর্মই আসল। কাজই দেশ, সমাজকে এগিয়ে নিতে পারে।
মানুষ মাত্রই আবেগ থাকবে। থাকা স্বাভাবিক। তবে আবেগ থাক অসাম্প্রদায়িকতার নজির স্থাপনের। আবেগ থাক উন্নয়ন, সমৃদ্ধি আর বিজ্ঞানে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে। আবেগ থাকতে পারে সমাজ উন্নয়ন, মুক্তিযুদ্ধে মূলনীতি ও চেতনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান মনষ্ক সমাজ প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে চলার।
মনে রাখতে হবে ধর্মান্ধতা ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার আবেগ বিজ্ঞানের যুগে কোন দাম নেই। গোটা বিশ্ব এই আবেগ পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ধর্মের আবেগে সাম্প্রদায়িকতা, হামলা, হত্যা, গোটা দুনিয়া এখন আর সমর্থন করে না। এসব ঘটনাকে বিশ্ববিবেক ধিক্কার দেয়, ঘৃণা জানায়। তাই সবার উচিত এই ধরণের আবেগ বাদ দিয়ে নিজেদের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। আবেগে এত বড় সর্বনাশ হোক আর চাই না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি