সাংস্কৃতিক অভিঘাত: বৃষ্টি, বুয়া ও ব্রিজবেন জীবন
৩০ জুলাই ২০২২ ১৭:৪৯
এ জীবনে আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত করে, আচ্ছন্ন করে বর্ষাকালের ঝুম বৃষ্টি। আকাশ ছাপিয়ে বৃষ্টি। চারদিক সাদা করে শো শো শব্দের বৃষ্টি। বড় বড় ফোটার বৃষ্টি। আকাশের অঝোর ক্রন্দনকে আমার প্রকৃতির অপার লীলা মনে হয়। নিঃসন্দেহে বৃষ্টি সৃষ্টিকর্তার অনুপম সৃষ্টি। আর গাছের পাতা ও টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ সত্যিই অনবদ্য এক সুমধুর সঙ্গীত। যার কোনো তুলনা হয় না। ব্রিজবেনে আসার আগে স্ত্রীর চাকুরিসূত্রে আমরা থাকতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের হাউজ টিউটর কোয়াটারে। নতুন এই ভবনটির অবস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের ঠিক উল্টো পাশে। এই ভবনের সাত তলা থেকে মধ্যরাত, ভর দুপুর অথবা সন্ধ্যায় অপলক দৃষ্টিতে অকারণেই বৃষ্টি দেখেছি। আহা কি অনবদ্য দৃশ্য। কি মোহনীয় মুহুর্ত। চোখ বন্ধ করলেই এখনও মনটাকে শীতল করে, ভিজিয়ে ফেলে।
কুইন্সল্যান্ডের ব্রিজবেনে এসেও বৃষ্টির দেখা পেলাম। টিপটিপ বৃষ্টি। ঝিরঝির বৃষ্টি। জানি না, এখানে কখনও ঝুম বৃষ্টি হয় কি না। যদিও ব্রিজবেনে জুলাই মাসে শীতকাল। হয়তো গ্রীষ্মকালে ঝুম বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়। ব্রিজবেনে এসে বারবার ঢাকার অঝর ধারার বৃষ্টির কথা মনে পড়ছে। সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের পেছনের শ্যাডো কিংবা টিএসসি’র এক কাপ চা। উল্লেখ করা যেতে পারে ব্রিজবেন শহরের রাস্তায় কোনো চা’য়ের দোকান নেই। হ্যাঁ, রাস্তার পাশের দোকানে চা-কফি ঠিকই পাওয়া যায়। যার জন্য গুণতে হয় সর্বনিন্ম ২-৩ ডলার। বাংলাদেশী টাকায় অন্তত ২০০ টাকা। ঢাকার মতো রাস্তার উপর কোনো মামার দোকান অথবা হোটেলে ১০ টাকায় এখানে চা খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এবার আসা যাক বুয়ার কথায়। যারা ঢাকায় থাকেন সাধারণত তাদের প্রত্যেকের বাসায় কোনো না কোনো সাহায্যকারী বা বুয়া থাকেন। যারা আমাদের কাছে সাহায্য করে থাকেন। আর ছোট বাচ্চা দেখার বিষয়েতো বুয়া অপরিহার্য। ঢাকাতে আমার দুই বাচ্চাকে দেখার জন্যেও সাহায্যকারী ছিলেন। যার উপরে আমরা অনেক বিষয়েই নির্ভর করতাম, আস্থা রাখতাম। কিন্তু ব্রিজবেনে এ রকম সাহায্যকারী পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আপনি চাইলে শিশুকে ডে-কেয়ার বা দিবা যত্ন কেন্দ্রে দিতে পারবেন। কিন্তু তা খুবই ব্যয়বহুল। প্রতিদিন ফি অন্তত ১০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাত হাজার টাকা। প্রতিদিন এতো টাকা খরচ করা সত্যিই কঠিন। আরও একটি বিষয় খুব জরুরি। ঢাকা বা বাংলাদেশের অন্যান্য শহরে সাধারণত আমরা আমাদের সংসারের কাজে সাহায্যকারীর আশ্রয় নিই। যেমন- রান্না, কাপড় ধোয়া, চা-নাস্তা বানানো ইত্যাদি। অস্ট্রেলিয়ান জীবনে এ বিষয়গুলো ভুলে যেতে হবে। রান্না থেকে শুরু করে প্লেট পরিষ্কার পর্যন্ত, সব কিছুই নিজেদের কাজ। যতো কষ্টই হোক, যতই অভ্যাস না থাকুক এই কাজগুলো নিজেকেই করতে হয়। একবার আমার স্ত্রী বাজার থেকে আস্ত ফ্রোজেন মুরগী কিনে নিয়ে আসে। যা নিয়ে মহা বিপদ। কারণ আমরা স্ত্রী বটি ছাড়া মুরগী কাটতে পারেন না, আর এখানে বটির প্রচলন নেই। অন্য দিকে আমি ইহ জীবনে মুরগী কাটিনি। তখন সাহায্য নিলাম ভিডিও শেয়ারিং ওয়েবসাইট ইউটিউব-এর। ইউটিউব ভিডিও দেখেই ধারালো ছুরি দিয়ে আমি জীবনের প্রথম মুরগী কাটি। এবড়ো থেকড়ো, কাহিল অবস্থা। এই কথাগুলো বলার মূল উদ্দেশ্য হলো যারা অস্ট্রেলিয়া বা বিদেশে পড়তে যাবেন তারা অবশ্যই রান্না থেকে শুরু করে নিজের কাজ নিজে করার বিষয়ে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করবেন। তা ছাড়া খুবই বিপদ। পদে পদে বিপদ।
ইংরেজি ভাষায় Culture shock বা সাংস্কৃতিক অভিঘাত নামে একটা কথা আছে। যার মূল কথা হলো কোনো স্থান বা দেশের পারিপার্শিক অবস্থার সাথে নিজেকে অনুপযুক্ত বা আনফিট মনে করা। এটা একটা প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় মানুষ নতুন সংস্কৃতি সম্পর্কেও অনেক কিছু শিখতে পারে। নতুন পরিবেশ বা সংস্কৃতি থেকে অনেক কিছু ধারণ করে। যাকে সাধারণত বলা হয় সাংস্কৃতিক অভিযোজন বা ‘cultural adaptation’. অস্ট্রেলিয়ায় এসে সাংস্কৃতিক অভিঘাতের বিষয়টি আমি দুইভাবে অনুভব করেছি। প্রথম যেদিন ব্রিজবেনে পৌঁছায় সেদিন-ই আমার বড় ছেলে আইমান বলে বসে, সে এখানে থাকবে না, সে তার নানীর বাসায় চলে যাবে। সাথে অঝরে কান্না। তার অবুঝ কান্না আমাদের প্রবলভাবে ছুঁয়ে যায়। আর মনে হয় আহা বাচ্চাটা আর কবে তার নানীর কোলে ফিরবে। আদৌ ফিরতে পারবে কি না! আহা প্রবাস জীবন। আর হয়তো এই বাচ্চা যখন দেশে ফিরবে তখন দেশের কত কিছুই না পরিবর্তন হয়ে যাবে। অনেক আত্মীয়-স্বজনই হয়তো এই পৃথিবী থেকে চলে যাবেন। আহা।
সাংস্কৃতিক অভিঘাতের বিষয়টি আমি অনুভব করি ২৬ জুলাই ২০০২ তারিখে। এদিন গ্যাবা স্টেডিয়ামের (the Gabba) পাশের একটি জায়গা উলানগ্যাবা (Woolloongabba) থেকে বাড়ি ফেরার পথে ভুল করে আমি চলে গিয়েছিলাম ১২, এ্যান স্ট্রিট নামক একটি জায়গায়। এটি ব্রিজবেনের বিখ্যাত সিটি হলের পাশের একটা রাস্তা। ব্রিজবেনে সিটি হল অত্যন্ত সুপ্রাচীন একটি স্থাপনা। এটির কাজ শুরু হয়েছিল ১৯২০ সালে আর ভবনটির উদ্বোধন করা হয় ১৯৩০ সালে। সিটি হলের পাশের এই রাস্তায় আমি নির্দিষ্ট রুটের বাসের অপেক্ষায়। এদিকে প্রবল ঠাণ্ডা বাতাস। রাত প্রায় ১১টা। একেবারেই অচেনা সড়ক। জীবনে প্রথম এসেছি এই স্থানে। চারদিকে স্থাপনাগুলো অচেনা। মানুষ অচেনা। রাস্তায় মানুষ খুব কম। কোন পথে বাড়ি ফিরবো তাও অজানা। অপেক্ষা করছি একটি বাসের জন্য। কেনো যেন হঠাৎ করেই এই পরিবেশে নিজেকে বেমানান মনে হলো। আমার পাশ দিয়েই আধুনিক পোষাকের অজিরা হেঁটে যাচ্ছেন। তাদের কাউকে আমি চিনি না। সবই অচেনা, অজানা। নিজেকে বড় একা একা মনে হলো। কেনো যেন খুব কান্না পাচ্ছিলো। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বলেই হয়তো কাঁদা হয়নি। কিন্তু মনের ভেতরে একটা উথাল-পাথাল ভাব। মনে হচ্ছিলো আমার ঢাকা-ই ভালো। অন্ততপক্ষে এই শহরের প্রতিটি গলি আমার চেনা। মূল কথা এই শহরটিকে আমার নিজের বলে মনে হয়। আহা আমার ঢাকা শহর। কেমন আছে আমার ঢাকা শহর? কেমন আছে এই শহরের আমার চেনা পথ আর অলি-গলিগুলো। সাংস্কৃতিক অভিঘাতের আঘাত ও নতুন সংস্কৃতিকে অভিযোজনের প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে বারবার আমার ভেতর থেকে বের হয়ে আসছিল একটি কথা, আহা আমার ঢাকা শহর, আহা আমার দেশ- বাংলাদেশ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে উচ্চশিক্ষার জন্য ব্রিজবেনে অবস্থানরত)
সারাবাংলা/আরএফ/এএসজি
মুক্তমত রাহাত মিনহাজ সাংস্কৃতিক অভিঘাত: বৃষ্টি বুয়া ও ব্রিজবেন জীবন