রেলওয়ের অব্যবস্থাপনা কি কখনো দূর হবে না?
৩০ জুলাই ২০২২ ১৮:২৯
সাধারণ মানুষের ভিতর আগ্রহের কোনো কমতি নেই। সেই আগ্রহ হচ্ছে মানুষ পরিবর্তন চায়। তবে ঘরে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অধিকাংশ মানুষ পরিবর্তনের আওয়াজ তোলেন। কিন্তু রাজপথে পথে এসে পরিবর্তন কথা বলতে চায় না। তবে কিছু মানুষ সত্যিকারের দেশপ্রমিক হিসাবে পরিচয় প্রকাশিত হয় তখনি কেউ রাজপথে এসে সংকটের কথা বলেন এবং সংকট থেকে মুক্তির পথ দেখান তখন কিছু মানুষ সংকটের কথা শুনে রাজপথে নিরব দর্শকের মত দাঁড়িয়ে শুধু শুনে যায়। আবার সংকটের প্রতিবাদের কণ্ঠ যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পৌঁছে যায় তখন হাজারও মানুষ শুভ কামনা জানায়। এমনকি পাশে থাকবেন বলেও অঙ্গিকার ব্যক্ত করেন। ফলে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সবাই সংকট থেকে মুক্তি চায়। তার জন্য পরিবর্তন চায় কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে কিছু মানুষ আছে ভয়ে রাজপথে কথা বলতেও ভয় পায় আবার কিছু মানুষ আছে পাছের লোকে যদি কিছু বলবে এভেবে নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায়। তবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ‘থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে, কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে’। বিদ্রোহী মানুষের অন্তরে গেঁথে গেছে সংকল্প কবিতা। ফলে বিদ্রোহীরা যখনি দেশের সংকট কিংবা অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন হলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজপথে। তারা বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ থাকতে চায় না।
রাষ্ট্রের বেঁধে দেওয়া শিকল ছিন্ন করার চেষ্টা করেন। কখনও গানের ভাষায় যদি তোর ডাক শোনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। আবার কখনও কবিতায় ভাষায় রাষ্ট্রকে জানান দেন। তবে প্রচলিত কথা আছে ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো সহজ কাজ কিন্তু ঘুমানোর অভিনয় করে যারা জেগে থাকে সেই সব মানুষকে জাগানো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কঠিন কাজ। ঠিক তেমনি আমাদের রাষ্ট্র জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে। কথা গুলো বলছি আমাদের জাতীয় সম্পদ রেল নিয়ে।
সম্প্রতি রেলের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে একাই রাজপথে প্রতিবাদে নেমেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি। এক হাতে প্ল্যাকার্ড, অন্য হাতে একটি শিকলের এক প্রান্ত ধরা। শিকলের অন্য প্রান্ত আরেকজনের গলায় জড়ানো। ছবি দেখে বুঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত রেলওয়ের প্রতীক। রেলওয়েকে শিকলমুক্ত, মানে দুর্নীতিমুক্ত করার শপথ নিয়ে প্রতিদিন কমলাপুর রেলস্টেশনে অবস্থান কর্মসূচি কর্মসূচি পালন করছেন। গণতান্ত্রিক দেশে একজন নাগরিক হিসাবে দাবি আদায়ের আন্দোলন করার অধিকার আছে। কিন্তু সেই অধিকারের মধ্যে যেন মরিচীকা ধরেছে। যারা কালো টাকা সাদা করেন, যারা মানুষের পকেট কাটেন অর্থাৎ কালোবাজারিরা বুক ফুলে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়ায় তাদের গ্রেফতার করার তো দূরের কথা মাঝে রাজনৈতিক দলের পদপদবি দেওয়া হয়। কিন্তু যারা অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে কথা বলেন,দুর্নীতিবাজ আর কালোবাজারিদের মুখোশ উন্মোচন করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তারাই থাকে বেশি বিপদে। ফলে অন্যায়কারীকে নয় অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করে তারাই হয়রানির শিকার হতে হয়। যেমনটা আমরা দেখতে পাচ্ছি রেলের কর্মী ও পুলিশের হাতে হেনস্তারও শিকার হয়েছেন ঢাবির প্রতিবাদী সেই শিক্ষার্থী। তবে প্রশ্ন কমলাপুর রেলস্টেশনে কি দুর্নীতি হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবার জানা আছে কারণ রেলে উঠেন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। ফলে রেলের যাতায়াতে কি পরিমাণ হয়রানির শিকার হতে হয় তা আমাদের সবার প্রত্যক্ষ আছে। ফলে রনির যৌক্তিক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে জয়পুরহাট সরকারি কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে জয়পুরহাট রেলওয়ে স্টেশনে বাংলাদেশ রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে অবস্থান কর্মসূচি করেছিল। তাদের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে রুঁখে দাঁড়াবেন না? আরও লেখা ছিল টিকিট কালোবাজারি শিকল কবে মুক্ত হবে? হাতে লেখা প্ল্যাকার্ডের দুই বাক্যে দ্বারায় বুঝায় যায় বাংলাদেশ রেলওয়ের সিস্টেম পুরো দুর্নীতিতে ভরপুর। রাষ্ট্র কি প্ল্যাকার্ডের ভাষা বুঝে?
বিশ্বের উন্নত দেশ গুলোতে দেখা যায় রেলওয়ে হচ্ছে লাভজনক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই চিত্র দেখা যায় ভিন্ন বছরের পর বছর লোকসান গুনতে হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রতিদিন যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে ৩৯৪টি ট্রেন পরিচালনা করে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে যা আয় হয়, তার চেয়ে বেশি অর্থ ট্রেনগুলো পরিচালনায় ব্যয় হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটির। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছর ১ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে রেলওয়ে। গত পাঁচ বছরে লোকসানের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। ধারাবাহিক এ লোকসানের জন্য দায়ি কে? প্রসঙ্গে ক্রমে বলতেই হয় চিলাহাটি থেকে রাজশাহী রুটে তিতুমীর এক্সপ্রেস ট্রেনে চলে হরিলুট। কারণ এই ট্রেনে অলিখিত ভাবে পুলিশ বগি নামে একটি বগি আছে। সেই বগিতে যারা উঠে সবাই টিকিটবিহীন। তবে পুলিশ সেই যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পকেট ভরায়। এটাই শেষ নয় যেসকল যাত্রী টিকিট ছাড়াই ট্রেনে উঠে রেলের নিয়ম অনুযায়ী ঐ যাত্রীকে জরিমানাসহ ভাড়া নিয়ে যাত্রীকে টিকিট দেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু অনেক সময় টাকা নেওয়া হয় কিন্তু যাত্রীকে টিকিট দেওয়া হয় না। এই চিত্র শুধু রাজশাহী ও চিলাহাটি রুটে নয় খোঁজ নিলে দেখা যাবে এক ও অভিন্ন ভাবে চলছে অনিয়ম, করছে দুর্নীতি সেই দুর্নীতির পাগলা ঘোড়া থামাবে কে?
বাংলাদেশ বহুমাত্রিক সংকটের মধ্যে অতিক্রম করছে। তার মধ্যে রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার কারণে সাধারণ মানুষ হয়রানি আর ভোগান্তির শেষ নেই। ফলে এর থেকে মুক্তি পেতে টিকেট ব্যবস্থাপনায় সহজ ডটকমের হয়রানি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। হয়রানির ঘটনায় তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে টিকেট কালোবাজারি প্রতিরোধ করতে হবে। অনলাইনে কোটায় টিকেট ব্লক করা বা বুক করা বন্ধ করতে হবে। ট্রেনের টিকেট পরীক্ষক ও তত্ত্বাবধায়কসহ অন্যান্য দায়িত্বশীলদের কর্মকাণ্ড সার্বক্ষণিক মনিটর, শক্তিশালী তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে রেল সেবার মান বৃদ্ধি করতে হবে। অনলাইন-অফলাইনে টিকেট কেনার ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রী চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ রেলের অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ট্রেনে ন্যায্য দামে খাবার বিক্রি, বিনা মূল্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। টিকিট কালোবাজারিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে এসে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ভবিষৎতে আর কোনো যাত্রী যেন ছাদে উঠতে না হয় তার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। ফলে হাতে লেখা প্ল্যাকার্ডের ভাষা বুঝে দ্রুত রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার দিকে রাষ্ট্রের নজর দেওয়া যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ রেলওয়ের অব্যবস্থাপনা কি কখনো দূর হবে না?