স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও প্রত্যাশা— ১ম পর্ব
১ আগস্ট ২০২২ ২৩:২৯
২৭ জুলাই স্বেচ্ছাসেবক লীগের ২৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হলো। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যে কয়টি অঙ্গসংগঠন বা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রয়েছে তারমধ্যে স্বেচ্ছাসেবক লীগই একমাত্র শেখ হাসিনার হাতে গড়া সংগঠন। ১৯৯৪ সালের ২৭ জুলাই বঙ্গবন্ধু দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিনে যাত্রা শুরু হয়। সারা বছর আমরা নেতাকর্মীরা এই দিনটির প্রতীক্ষায় থাকি, কেননা প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানটিতে প্রধান অতিথি থাকেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। গত কয়েকটা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেখেছি এইদিন নেত্রী যথেষ্ট সময় নিয়ে তার বিরল অভিজ্ঞতা ও অবজারভেশন দিয়ে যে আবেগময় ও দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন তা সত্যিকার অর্থেই সকল নেতাকর্মীর অফুরান প্রেরণার উৎস।
জাতির পিতার আদর্শে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী সংগঠনসমূহের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক লীগকে নবীনতম সংগঠন হিসেবে অনেকে মনে করতে পারেন। কিন্তু বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বঞ্চিত জনপদে জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম, বিকাশ ও ধারাবাহিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শেষে জাতির পিতার নেতৃত্বে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কীর্তিময় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্ম ইতিহাসের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন টিকাটুলি কেএমদাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাকালে প্রয়াত জননেতা জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। সেই সময়ের প্রেক্ষাপট অনুধাবন করা জরুরি।
একদিকে মুসলিম লীগের মৌলবাদী শাসন, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের হাতে। বিপরীতে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে প্রোগ্রেসিভ (উদারপন্থী) নেতারা ছিলেন তাদের দমন পীড়নের শিকার হতে হয় চরমভাবে। ১৫০ মোগলটুলিতে কর্মিশিবির খোলা হয় ১৯৪৪ সালে। দায়িত্বে ছিলেন টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাহেব। বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে হাল ধরেন সেই কর্মিশিবিরের।
দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ এ দেশভাগ হলো। বঙ্গভঙ্গ রদের ৩ যুগ পর ঢাকা আবার রাজধানীর মর্যাদা ফিরে পায়। বাঙালি মুসলমানের একটা নির্দিষ্ট স্বাধীন ভূখণ্ড হলো। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা প্রমাণ হতে সময় লাগেনি। দেশভাগে বাস্তুহারা হয় প্রায় ২ কোটি, মারা যায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ। মুসলিম লীগের পাণ্ডারা হিন্দু সম্পত্তি দখলে ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে ওঠে। সারা বাংলাদেশ থেকে যে লাখ লাখ হিন্দু নিজভূম থেকে বিতাড়িত হলো তার মূলে ছিল মুসলিম লীগ। পূর্ব পাকিস্তানের এমন কোনো জেলা বা থানা নেই যেখানে মুসলিম লীগের মোড়লরা ছলে-বলে-কৌশলে হিন্দু সম্পত্তির সিংহভাগ অংশ দখল করেনি।
বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এসেই পরিস্থিতি আঁচ করেন। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ছাত্রলীগ। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেনির কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থনের কারণে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও গ্রেফতার করা হয়।
মুসলিম লীগের দমন পীড়নের মাত্রা চরমে ওঠে। টাঙ্গাইলের ১টি আসনের উপনির্বাচনে একবার মাওলানা ভাসানী ও আরেকবার শামসুল হক জয়লাভ করেন। কটিযার প্রভাবশালী জমিদার, মুসলিম লীগ নেতা খুররম খান পন্নী নিজ জমিদারি এলাকায় শামসুল হক সাহেবের কাছে বিপুল ভোটের হার। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার নির্বাচনি ফলাফল বাতিল করে।
একদিকে গোয়েন্দা সংস্থা অন্যদিকে মুসলিম লীগের পাণ্ডারা ভয় ভীতি দেখিয়ে চলছে। কেন্দ্রে বিচার দিয়েও লাভ হয়নি। বঙ্গবন্ধু কারাগারে। সোহরাওযার্দী, ভাসানীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ কর্মীসভা করার কোথায়ও জায়গা পায় না। অবশেষে কেএমদাস লেনের বশির উদ্দিন সাহেবের রোজ গার্ডেনে সভা করতে সম্মতি দেন তখনকার মালিক হুমায়ুন সাহেব। ২৩ ও ২৪ মনে জুন দুই দিন ব্যাপী কর্মীসভা ডাকা হয়। ৩০০ প্রতিনিধি অংশ নেন। মুসলিম লীগের সন্ত্রাসীরা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ঢাকা শহরে। ফলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখন জিল্লুর রহমানকে আহ্বায়ক করে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়।
এরপর আওয়ামী লীগের সকল সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী শৃঙ্খলা রক্ষা ও সাংগঠনিক সেবায় ধারাবাহিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৬ দফা আন্দোলন ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে উত্তাল রাজপথে গণআন্দোলন শুরু হলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাককে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের আগুনঝরা দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের রসদ সরবরাহের দুঃসাহসী ভূমিকা ছিল এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর। দুঃখের বিষয় হলো—মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘মুজিববাহিনী’ বা ‘ছাত্রলীগ’ এর অবদান নিয়ে সুশীল ইতিহাসবিদদের যথেষ্ট চুলকানি থাকলেও ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হওয়ায় মুজিব বাহিনীর ইতিহাস মুছে ফেলতে পারে নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বেচ্ছাসেবকদের অবদান মুছে ফেলতে অনেকটাই সফল। তাই স্বেচ্ছাসেবকদের অবদান নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু হওয়া জরুরি।
’৭৫ পরবর্তী দুঃসময়ে বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিনাশ করতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে স্বৈরশাসকদের নির্লজ্জ লম্ফঝম্ফ ইতিহাস দেখেছে। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শেষেও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে ছিল না। এর ধারাবাহিকতায় আরেকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক নেতা তৈরির আঁতুড়ঘর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের একটা বড় সময় রাজনীতিতে যুক্ত থাকা কঠিন হয়ে ওঠে। এত বড় একটি রাজনৈতিক শক্তিকে ধারণ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নতুন প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৪ সালে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিন ২৭ জুলাইয়ে ঐতিহ্যবাহী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে পুনর্গঠিত করার উদ্দেশ্যে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের যাত্রা শুরু হয়। হাজী মকবুল হোসেন ছিলেন প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক।
পরবর্তীতে ২০০৩ সালে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে সভাপতি করে পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক কাঠামো করার পর সেবা-শান্তি-প্রগতির পতাকাবাহী সংগঠনটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় দেশ ও জাতির সকল দুর্যোগ-দুর্বিপাকে নিঃস্বার্থ স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে আসছে।
সারাবাংলা/আইই