মায়ের দুধের বিকল্প নেই
১ আগস্ট ২০২২ ১৪:৪২
শিশু যখন প্রথম ভূমিষ্ঠ হয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাস অনুভব করে, তখন তার প্রয়োজন হয় নিরাপত্তার। মা এবং মায়ের বুকের দুধ এ সময় তাকে সম্পূর্ণভাবে নিরাপত্তা প্রদান করে। মায়ের দুধ মা ও শিশুর ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে কাজ করে এবং উভয়ের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলে। মায়ের দুধ বিশুদ্ধ বা স্টেরাইল। এতে কোনোরকম ক্ষতিকর জীবাণু প্রবেশ করতে পারে না। তাই মায়ের দুধ খেলে শিশুর অসুখ হবার সম্ভাবনা কম থাকে, বিশেষ করে পেটের অসুখ। এছাড়া মায়ের দুধ তৈরির বাড়তি কোনো ঝামেলা নেই। মায়ের শরীরে তা আপনা-আপনিই তৈরি হয়। বহুকাল ধরেই নবজাত শিশু মায়ের বুকের দুধ পান করে বেঁচে আছে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি লাভ করছে।
মায়ের বুকের দুধে এক শ’রও বেশি উপাদান রয়েছে, যা শিশুর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এছাড়া এ দুধ শিশুর স্বাভাবিক স্বাস্থ্য বজায় রেখে সঠিক সময়ে কথা বলার ক্ষমতা অর্জনে এবং বুদ্ধি বিকাশেও সহায়তা করে। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে শুধুমাত্র শিশুরাই উপকৃত হয় না, মায়েরাও সরাসরি উপকৃত হন অনেক দিক থেকে। জন্মের পর থেকে স্তন্যদান করলে জরায়ু থেকে প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ কম হয় এবং মায়ের দৈহিক কাঠামো ও জরায়ু দ্রুত গর্ভকালীন পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। এছাড়া যেসব মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান, তাদের স্তনে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। স্তন্যদান একটা প্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসেবেও বিবেচিত হয়ে থাকে। মায়ের দুধের গুণাবলী ও উপকারিতা সম্বন্ধে অবগত হয়েও অনেক মা এ ব্যাপারে অবহেলা বা অনীহা প্রকাশ করেন। এর প্রধান কারণ হলো অজ্ঞতা বা অশিক্ষা এবং মায়েদের অসুস্থতা ও পুষ্টিহীনতা। সৌন্দর্যহানির বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণাও রয়েছে অনেকের মধ্যে, যা একেবারেই অবান্তর।
শিশু জন্মের পর মায়ের স্তন থেকে যে ঘন ও হালকা হলুদ বর্ণের দুধ নিঃসৃত হয়, তা হচ্ছে শালদুধ বা কলস্ট্রাম। বিশেষজ্ঞদের মতে, শালদুধে নবজাতকের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ভিটামিন ও অন্যান্য ক্যালোরিসমৃদ্ধ উপাদান উপযুক্ত পরিমাণে থাকে এবং রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা দারুণভাবে বৃদ্ধি করে। জন্মের আধ ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে এ দুধ অবশ্যই খেতে দেওয়া উচিত। অজ্ঞতার কারণে আমাদের দেশে এখনো অনেক মা শালদুধকে বিষাক্ত মনে করে সন্তানকে তা পান করা থেকে বিরত রাখেন এবং ফেলে দেন। এটিও মারাত্মক ভুল। এর ফলে শিশু তার স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং জন্মের অল্পদিনের মধ্যেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। অনেক শিশু জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ খেতে চায় না এবং মা-ও এ ব্যাপারে অনেক সময় কোনো গুরুত্ব দেন না। বলে বেড়ান, তার শিশু বুকের দুধ পায় না। এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এটা শিশুর জন্য সম্পূর্ণ অজানা এবং নতুন একটা বিষয়। কাজেই এক্ষেত্রে শিশুকে বারবার বুকের দুধ খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী করা উচিত অর্থাৎ একে অভ্যাস করতে হবে। অন্যদিকে, সহজ ও সুন্দরভাবে স্তন্যদানের ব্যাপারে মায়ের অবশ্যই মানসিক প্রস্তুতি এবং ইচ্ছা থাকতে হবে। সহজ করে বলা যায়, শিশুর স্তন চোষা ও মায়ের স্তন্যদানের দ্বিধাহীন ইচ্ছা- এ দু’য়ের মিল হলেই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো অত্যন্ত সহজ ও সফল হবে।
প্রতিটি মায়েরই তার সন্তানকে সঠিক পদ্ধতি ও সঠিক ভঙ্গিতে বুকের দুধ খাওয়ানো একান্ত প্রয়োজন। শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময় ভঙ্গি ঠিকমতো না হলে মায়ের অসুবিধা ও অস্বস্তি হতে পারে। অস্থির অবস্থায় মায়ের দুধ উপযুক্ত পরিমাণে প্রবাহিত হয় না। ফলে মা ও শিশু উভয়েরই কষ্ট হয়। সেজন্য প্রথমেই মায়ের উচিত দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে যেকোনো আরামদায়কভাবে বসে নেওয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনো ভঙ্গিতে দুধ খাওয়ান না কেন, লক্ষ্য রাখতে হবে- শিশুর ঘাড় যেন গুঁজে না থাকে, শিশুর দৃষ্টি মায়ের দিকে থাকে এবং শিশুর শরীর যেন মায়ের বুকের সঙ্গে মিশে থাকে। দুধ খাওয়ানোর সময় কখনও কাঁচি ধরার ভঙ্গিতে বোঁটা বা চারপাশের এরিওলা (বাদামী রঙের অংশ) টিপে ধরা উচিত নয়। এতে দুধের উৎপত্তি ও নিজস্ব প্রবাহ ব্যাহত হয়। বুকের নিচে অন্য চারটি আঙ্গুল দিয়ে একটু ঠেলে তুলে বুড়ো আঙ্গুলটি এরিওলার অনেক দূরে চেপে ধরে পুরো স্তনটিকে সামান্য একটু তুলে দুধ খাওয়ানোই হচ্ছে সঠিক ও শ্রেষ্ঠ পন্থা। মায়ের বুকে উপযুক্ত পরিমাণে দুধ আসতে পাঁচ থেকে সাতদিন সময় লাগে। সুতরাং শিশুর জন্ম হওয়ার পর প্রথম ক’দিন বুকের দুধের জন্য উদ্বিগ্ন না হয়ে অল্প সময় পরপর স্তন চুষতে দিতে হবে। এতে সহজেই বুকে দুধ চলে আসবে। প্রতিটি মাকে প্রতিবার অন্তত ২০ থেকে ২৫ মিনিট পর্যন্ত তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত। তবে সব সময় একই দিকের স্তন না দিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে উভয়দিকের স্তনই সমানভাবে খাওয়ানো উচিত। তাছাড়া সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর আগে প্রতিবার মায়ের স্তন বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত। অপরিষ্কার বা ময়লা স্তনের বোঁটা চোষার ফলে শিশুর ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পেটের অসুখ হতে পারে।
মায়ের দুধ সেরা দুধ, এর কোনো বিকল্প নেই। এ দুধ নিরাপদ, জীবাণুমুক্ত, সহজলভ্য। সবচেয়ে মূল্যবান কথা- এটি শিশুর চাহিদা অনুযায়ী তৈরি। মায়ের দুধ পান করলে শিশুর ডায়রিয়া, বিভিন্ন পেটের অসুখ, শ্বাসনালীর সংক্রমণ, খোঁস-পাচড়া, হাম ইত্যাদি কম হয়। পৃথিবীর কোনো খাবারই মায়ের দুধের বিকল্প বা এর চেয়ে সেরা হতে পারে না। জন্মের পর থেকে শিশু যখনই চায়, তখনই তাকে বুকের দুধ খেতে দেওয়া প্রতিটি মায়ের কর্তব্য। এতে বিরক্ত বা বিব্রত হলে চলবে না। এটি শিশুর মৌলিক অধিকার। শিশুকে তার এ প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কোনোভাবেই উচিত নয়। বুকের দুধের বিকল্প খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন এবং শিক্ষিত ও সচেতন মায়েদেরকে এগুলোর সহজ ও অবাধ ব্যবহার করতে দেখে গ্রামের সাধারণ মায়েরাও সহজেই গুঁড়ো দুধের ওপর ঝুঁকে পড়ে এবং আকৃষ্ট হয়। যার পরিণাম অত্যন্ত মারাত্মক। এ ব্যাপারে প্রতিটি মাকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। বিজ্ঞাপনের আকর্ষণীয় প্রচারণায় প্রতারিত না হয়ে, বিভিন্ন কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণাকে দূরে ঠেলে দিয়ে এবং বুকের দুধের গুরুত্ব ও উপকারিতা পুরোপুরি উপলব্ধি করে প্রতিটি মাকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।
আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠির বেশিরভাগ মহিলা বা মায়েরা বিভিন্ন কর্মসংস্থানে নিয়োজিত থাকে। ফলে সেসব মায়েদের পক্ষে সঠিক সময়ে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, বুকের দুধ খোলাভাবে আট ঘণ্টা নিরাপদ থাকে বলে তা সহজেই বাটিতে রেখে খাওয়ানো যায়। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের কর্মজীবী মায়েদের জন্য একটি চমৎকার পন্থা। এর ফলে শিশু তার মায়ের বুকের দুধ থেকে বঞ্চিত হয় না। অনেক অফিস বা কর্মস্থলে এখন ডে-কেয়ারের ব্যবস্থা রয়েছে। এর ফলে শিশু সহজেই তার মায়ের দুধ খেতে পারে। অবশ্য এ ব্যবস্থাটি এখনো আমাদের দেশে তেমনভাবে প্রচলিত হয়ে ওঠেনি। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে অবশ্যই উদ্যোগী ভূমিকা পালন করা উচিত। প্রতি বছর পৃথিবীর ১২০টিরও বেশি দেশে ১ থেকে ৭ আগস্ট পালন করা হয় ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ’। আমাদের দেশেও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোয় উৎসাহ দিতে এবং শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। শিশুকে বুকের দুধ দিয়ে সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান করে গড়ে তোলা এবং পুষ্টিহীনতা ও রোগবালাই থেকে শিশুকে রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি