উন্নত জাতি গঠনে অন্তরায় ‘কিশোর অপরাধ’
৬ আগস্ট ২০২২ ১৪:৪৮
কিশোর অপরাধ ও অপরাধ প্রবণতার হার দিন দিন ঊর্ধ্বমুখি। বর্তমান সময় বিবেচনায় এটি একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। কিশোর গ্যাং,কিশোর অপরাধের চিত্র যে কতটা বর্তমান সমাজকে নাজুক করে ফেলেছে তা বলা বাহুল্য। প্রতিনিয়তই আমরা গণমাধ্যমে কিশোর অপরাধের পরিসংখ্যানের হাল হকিকত দেখতে পাচ্ছি। এই কিশোর অপরাধের দৌরাত্ম কোন ভাবেই যেন রোধ করা যাচ্ছে না। এ অপরাধের রাশ টেনে ধরতে সরকার শিশু আইন ও আদালত সহ নানান প্রকার আইনী ব্যবস্থা রেখেছে। শিশু আইন ২০১৩-এর ৪ ধারা বিদ্যমান ‘অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন,অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হইবে। শিশু আইন অনুযায়ী বিদ্যমান কোনো আইনের অধীন কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত অথবা বিচারে দোষী সাব্যস্ত কোনো শিশুকে সাধারণ জেলহাজতের পরিবর্তে নিরাপদ হেফাজতে বা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বা প্রত্যায়িত প্রতিষ্ঠানে রাখার বিধান রয়েছে।
শিশু আইনে একজন শিশু যত বড় অপরাধেই করুক না কেন তার সর্বোচ্চ সাজা ১০ বছরের বিধান রয়েছে। এ ছাড়াও একজন শিশু অপরাধীকে আদালত প্রবেশনে মুক্তি দিয়ে তাকে সংশোধনের সুযোগ দিতে পারে। আর এটা করার উদ্দেশ্য এই যে অপ্রাপ্ত বয়সে না বুঝে শিশুটি উক্ত অপরাধ করেছে,তা শর্ত সাপেক্ষে সংশোধনের সুযোগ দিয়ে সমাজে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠুক। এ অপরাধের রাশ টেনে ধরতে পরিবার ও সমাজ কতটা দায়িত্ব পালন করছে এটাই বড় কথা। আমরা ডিজিটাল যুগে প্রায় সব কিছুই করছি ডিজিটাল। কৃষি ক্ষেত্র থেকে শুরু করে অফিস আদালত পর্যন্ত ডিজিটাইজেশনের ছোঁয়া। এ ডিজিটালাইজেশনের অপসংস্কৃতির ভয়াল গ্রাসে শিশু কিশোরদের মেধাশূণ্য হওয়ার প্রবণতা বাঁড়ছে। শিশুরা সময় পেলে বই নয়,মোবাইল নিয়ে সময় কাটায়। উঠতি বয়সের শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে না দিয়ে অবিভাকরা আদর করে স্মার্টফোন তুলে দিচ্ছে। আর সন্তানরা এই আদুরে স্মার্টফোনের অপব্যবহার করে একদিকে বই বিমুখ হচ্ছে অন্য দিকে পর্নোগ্রাফি,সাইবার ক্রাইম সহ নানান অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। একটা শিশু যখন কিছু কিছু বুঝতে শিখে তখনই যদি একজন অবিভাবক ঐ শিশুটির হাতে বিভিন্ন খেলনা কিংবা শিক্ষামূলক প্রদর্শনী তুলে না দিয়ে,তুলে দেয় স্মার্ট ফোন। আর এই ফোনে শিশুরা বিভিন্ন গেম খেলে সময় ব্যায় করে। তাহলে এই পশ্চিমা অপসংস্কৃতির তৈরি অ্যাপ জাতীয় ভিডিও গেমে সন্তানটি শিক্ষা নিচ্ছে কিভাবে পিস্তল চালাতে হয়,কিভাবে যুদ্ধ করতে হয়,কিভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করতে হয়। এক কথায় বলা চলে শিশুটির বইয়ের শিক্ষা বিমুখ হয়ে ধিরে ধিরে তার আচার-আচারণ কেন জানি সন্ত্রাসী প্রকৃতির হয়ে যায়। একটা পর্যায়ে বাবা-মায়ের অবাধ্যতায় চলতে শুরু করে। মিশতে শুরু করে পাড়ার বখাটে ছেলেদের সাথে। শুরু হয় শিশুটির অধপতন। পাড়া মহল্লার বখাটে দলের সদস্যভূক্ত হয়ে হয়তবা হয়ে যায় বর ভাই বা দাদার দলের লোক! হায়রে জীবন! কারো কারো জীবনে ফুটতেই গোলাপ ঝড়ে যাচ্ছে। আবার কোন কোন বখাটে সন্তান এক কিশোর গ্যাং এর সাথে অন্য কিশোর গ্যাং এর দলের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে শুরু করে সন্ত্রাসী প্রকৃতির কার্যক্রম। দলাদলির কারনে কেউ কেউ পিস্তল কিংবা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়ে পত্রিকার হেডলাইন হয়- ‘… কিশোর গ্যাং এর দলাদলিতে নিহত অমুক’। এখন প্রশ্ন এই অপরাধের প্রথম হাতেকড়ি কার হাতে বলতে পাড়েন?কে এই কিশোরকে সন্ত্রাসী বানাতে সহযোগীতা করলো?কে এই শিশুটিকে সাধারণ খেলনা হাতে না দিয়ে স্মার্টফোন দিয়ে নস্ট বানালো?প্রশ্নগুলো রয়েই গেল। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের সামনে থাকে অদম্য আশা আর জীবন জগৎ সম্পর্কে থাকে অতিকৌতূহল। অনেক সময় প্রতিকূল পরিবেশগত কারণে আশাভঙ্গের বেদনায় হতাশার হাত ধরে নৈরাশ্যের অন্ধকারে পতিত হয় তাদের জীবন। এতে কিশোর বয়সীরা ধীরে ধীরে অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে। কিশোর অপরাধ দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
বৃক্ষের ভাল ফল পেতে হলে যেমন ভাল বীজতলা তৈরি থেকে শুরু করে ফল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সঠিক পরিচর্যা করতে হয় তেমনি যোগ্য নাগরিক হিসেবে সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে হলেও সঠিক পরিচর্যার প্রয়োজন। আপনী সন্তানদের উপযুক্ত পন্থায় পরিচর্যা করবেন না,আদুরে ভাব দেখায় সন্তানদের জীবনকে হুমকির মুখে পতিত করে দিচ্ছেন আর বলবেন ছেলেটাকে আর ঠিক করতে পাড়লাম না,এ দোষ কার আপনী নিজেই ভেবে দেখেন। আমরা কথায় কথায় নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে যেন হাফ ছেড়ে বসি। একবারও নিজের কর্ম ও দোষের পর্যালোচনা করি না। একটা সন্তানকে জন্মের পর থেকে সঠিক দিক নির্দেশনায় মানুষের মত মানুষ করার দায়িত্ব অবিভাবকের। শুধু সন্তানকে ভাত কাপড় আর টাকা-পয়সা দিলেই হবে না সব কিছুই নিজেই পর্যবেক্ষণ করতে হবে অবিভাবকদের।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ‘২০২০ সালে নানা কারণে ২৬৪ শিশু নিহত হয়েছে। ২০১৯ সালে নিহতের সংখ্যা ২২১ জন’। হয়তবা বর্তমান সময় বিবেচনায় হয়তবা সংখ্যাটা আরো অনেক। কিশোর অপরাধীরা সাজাও পাচ্ছে। দেশের শিশু আদালতগুলো শিশু অপরাধীদের সাজা দিচ্ছে প্রতিনিয়তই।
চলতি বছরের মে মাসে খুলনার পাবলিক কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ফাহমিদ তানভীর ওরফে রাজিন হত্যা মামলায় ১৭ ‘কিশোরকে’ সাত বছর করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারিক আদালত।
সুন্দর সমাজ বিনির্মানে চাই সুন্দর সামাজিক পরিকল্পনা। কিশোর অপরাধ যেহেতু সুষ্ঠু সমাজে গঠনে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেহেতু সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি সমাজের একজন সুনাগরিক হিসেবে আপনার আমারও কিছু দায়িত্ব থাকে। সেই দায়িত্ব থেকে আমরা সবাই নিজ নিজ পরিবারে শিশু-কিশোরদের স্মার্ট ফোন থেকে যতদূর সম্ভব দূরে রাখবো। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে স্মার্ট ফোনের শিক্ষামূলক সাইডগুলো ইনস্টল করে তাদের শিক্ষা দেব। সকলের সার্বিক সহযোগিতায় সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কিশোর অপরাধ নির্মূলে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: আইনজীবী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
উন্নত জাতী গঠনে অন্তরায় ‘কিশোর অপরাধ’ মুক্তমত মো. রায়হান আলী