অটুট বন্ধুত্বের হোক অঙ্গীকার
৬ আগস্ট ২০২২ ১৭:৩৭
‘বন্ধু’। ছোট এ শব্দের মাঝে মিশে আছে যেন পৃথিবীর সব নির্ভরতা। বন্ধুত্ব মানেই জীবনের সবুজতম সম্পর্ক। বন্ধু মানে দুটি দেহের একটি প্রাণ। আরও সহজ করে বলতে গেলে আত্মার কাছাকাছি যে বাস করে, সেই বন্ধু। সুসময় কিংবা অসময়ের সঙ্গী। কিশোর থেকে বৃদ্ধ সবাই বন্ধুত্বের কদর করেন। বলা হয়ে থাকে, যদি বন্ধু হও হাতটা বাড়াও। সেই হৃদয়ের আহবানে মিলেছে সব বন্ধুদের হাত। সত্যিকারার্থেই বন্ধুত্ব এক অদ্ভূত সম্পর্কের নাম। রক্তের হয়তো কোনো লেনদেন থাকে না এ ক্ষেত্রে, তবু সে সম্পর্কের চেয়েও বেশি আবেগের হয়ে ওঠে বন্ধুত্ব।
বন্ধু মানেই বিশেষ কিছু। বন্ধু মানে নির্ভরতা। বন্ধু মানে আনন্দ, প্রাণখুলে আড্ডা আর অম্লমধুর খুনসুটি। সবারই বন্ধু আছে আর বন্ধু থাকলেই দেখা হবে, কথা হবে, হবে অনাবিল আড্ডা। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ নিংড়ে, সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে যে জায়গায় কথা বলা যায়, তা হলো বন্ধু। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা নানা কাজে ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মধ্যেও মন চায় এই দিনটিতে বন্ধুর হাতে হাত রেখে হাঁটি, মন খুলে জমানো কথাগুলো খুলে বলি বন্ধুদের।
প্রতিবছর আগস্ট মাসের প্রথম রোববার সারা বিশ্বে বন্ধু দিবস পালিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশেও এখন বন্ধু দিবস পালন হয়। কিন্তু এই বন্ধু দিবসেরও রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৩৫ সাল থেকেই বন্ধু দিবস পালনের প্রথা চলে আসছে আমেরিকাতে। জানা যায়, ১৯৩৫ সালে আমেরিকা সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। দিনটি ছিল আগস্ট মাসের প্রথম শনিবার। তার প্রতিবাদে পরের দিন ওই ব্যক্তির বন্ধুটি আত্মহত্যা করেন। এরপরই জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদান আর তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর লক্ষ্যেই আমেরিকার কংগ্রেস ১৯৩৫ সালে আগস্ট মাসের প্রথম রোববার বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
পৃথিবীর অসংখ্য দিবসের মাঝে রয়েছে বন্ধু দিবসও। বন্ধুত্বের গুরুত্ব নিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী পালন করা হচ্ছে ‘বন্ধু দিবস’। সবাইকে বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা। মানুষ স্বভাবতই আড্ডা ও বন্ধুপ্রিয়। পৃথিবীতে অল্পসংখ্যক লোক থাকতে পারে যারা আড্ডা পছন্দ করেন না। বন্ধুত্বের পরিপূরক সম্পর্কের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় যাপিত জীবনের রস। কর্মব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনে বন্ধুত্বের স্বর্ণালি প্রহরগুলোকে আমরা ভুলতেই বসেছি।
প্রকৃত বন্ধু হলো সে যে অপর বন্ধুর দুঃখে সমব্যথী হয়, সুখকে সমানভাবে ভাগ করে নেয়। বন্ধুত্ব কোনো সূত্রের মাপকাটিতে মাপা যায় না। যে কথাগুলো গুরুজন বা পিতা-মাতাকে বলা যায় না, সে কথাগুলো আমরা প্রাণ খুলে বন্ধুর কাছে প্রকাশ করি। ভালো-লাগা, মন্দ-লাগা, সুখ-দুঃখের কথা বন্ধুর কাছে নির্ভয়ে মন খুলে বলা যায়। বন্ধুত্বের বন্ধনে কোনো স্বার্থ থাকে না। বন্ধুত্ব যতই পুরোনো হয়, ততই দৃঢ় হয়। জীবনের প্রয়োজনেই মানুষ বন্ধু খুঁজে নেয়। তবে এ কথাও ঠিক, সব বন্ধুর গুরুত্ব সমান হয় না। সত্যিকারের বন্ধুত্ব নিয়ে নানান মত থাকলেও একটি ব্যাপারে সবাই একমত- বন্ধু ছাড়া জীবন অসম্ভব।
একজন ভলো বন্ধু হচ্ছে জীবনের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। ভাবনা, টেনশন, আবেগ, অনুরাগ সব কিছুই বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করা যায়। তুমি আমার পাশে বন্ধু হে একটু বসিয়া থাক…আসলেই এ গানের মতো করে বন্ধুর পাশে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় পার করে দেয়া যায়, সময় কখন ফুরিয়ে যায় তা টেরই পাওয়া যায় না। বন্ধুত্বের অটুট বন্ধন। এ বন্ধন যেন থাকে চিরকাল। বন্ধুদের সঙ্গে আজ মন হারিয়েছে অজানায়। বলা হয়ে থাকে বন্ধু ছাড়া জীবন কখনোই পূর্ণতা পায় না। সেলফি এখন আমাদের জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। তাই প্রিয় মানুষদের কাছে পেলে সেলফি তোলা চাই-ই চাই। বন্ধুত্বের মাপকাঠি নিচে নামতে নামতে এতটাই সংকীর্ণ এক কানাগলিতে এসে ঘুরপাক খাচ্ছে, যেখানে বন্ধুত্ব বলতে বোঝায় কেবলই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। বন্ধুত্বের এমন মধুর বন্ধন স্মৃতি থেকে যেন কখনোই হারিয়ে না যায়। বন্ধুত্বের সম্পর্ক দিয়েই সেজে উঠুক আগামীর পৃথিবী।
শৈশবে স্কুল ছুটি হলে অনেকেই গাঁয়ের বন্ধুরা মিলে দল বেঁধে নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি, বিকেল হলে লুকোচুরি, কানামাছি আর গোল্লাছুট খেলায় কাটিয়েছে। কলেজ জীবনে ক্যাম্পাস কিংবা করিডোরগুলোকে প্রতিদিনই মুখরিত করে রেখেছে নানান গুঞ্জনে। আধুনিকতার স্রোতে অনেকেই হারাতে বসেছেন প্রকৃত বন্ধুদের। বন্ধুত্ব এখন আটকে আছে কতিপয় অ্যাপসে। আজকের এই বন্ধু দিবসে শৈশবে খেলার ছলে বেড়ে ওঠা বন্ধুদের বেশ মনে পড়ছে। জীবিকার তাগিদে কর্মের সন্ধানে আজ কে কোথায়। শৈশবের অনেক বন্ধুই হারিয়ে গেছে। এমনি করেই শেষ হয়ে যায় বন্ধুত্ব।
আধুনিক যুগে বন্ধুত্ব ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে দূর তেপান্তরে। গোটা বিশ্ব হাতের মুঠোয় চলে এসেছে প্রযুক্তির কল্যাণে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষ যোগাযোগ রাখতে পারছে বন্ধুর সঙ্গে। ফলে বন্ধুত্বের পরিধি আজ বিশ্বময়। যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে বন্ধুত্বের ধরন পাল্টে গিয়েছে বহুলাংশে। যুগ পাল্টালেও বন্ধুত্বের বন্ধন আদি ও অকৃত্রিম। প্রকৃতির চিরন্তন নিয়মে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে মানুষে-মানুষে, ছেলে-মেয়েতে, ছাত্র-শিক্ষকে, বাবা-মায়ে, পাড়া-প্রতিবেশীতে। জীবনের পথ পরিক্রমায় শৈশব, কৈশোর, ছাত্রজীবন, কর্মক্ষেত্রে, সংসার ও সমাজজীবনে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে অনেকের সাথে। প্রকৃত ও যোগ্য বন্ধু নির্বাচন একটি সঠিক সিদ্ধান্ত জীবনের জন্য প্রয়োজন। বন্ধু নির্বাচনে ভুল করলে জীবনে ছন্দপতন ঘটে। ছেলে-মেয়ে প্রত্যেকেরই উচিত সঠিক ও যোগ্য বন্ধু নির্বাচন করা। তবে কোনো বাঁধাধরা নিয়মে নয়, বন্ধুকে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জানাতে হলে তাকে বন্ধুত্বের রাখিবন্ধন করে রাখতে হবে।
সব থেকে বড় কথা, এই বন্ধুত্বের মাঝে মানুষ আশায় রঙিন স্বপ্ন দেখে। কখনো মারাত্মক হতাশ হয়ে নিরাশার পাহাড় মাথায় নিয়ে উল্টে পড়তে বসে। পালিয়ে বাঁচতে চায় জীবন থেকে। তখন বন্ধুত্ব আর বন্ধু শব্দটাই কেন যেন অসহ্য মনে হতে থাকে। তাই মনে হয় সব থেকে কঠিন হচ্ছে বন্ধুত্বের বিষয় আর মাত্রাজ্ঞান। স্কুলজীবনে ধীরে ধীরে এই বন্ধুত্বের মাত্রা পরিবর্তন হতে শুরু করে। কিন্তু লক্ষ করলে খুব অবাকই লাগে কেননা একসময় সবাই বন্ধুত্ব করতে চেষ্টা করেছে ক্লাসের প্রয়োজনে। ঠিক কিছুদিন পর স্কুলজীবনের শেষে ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর আবার সেই স্কুলের মতো প্রয়োজনেই। কিন্তু সত্যি বলতে সেই বন্ধুত্ব বেশি দিন টেকেনি। আর বন্ধুত্বের লিঙ্গবৈষম্যের ক্ষেত্রে জটিলতাটা একটু মনে হয় বেশি। একটি ছেলে ও একটি মেয়ের বন্ধুত্ব খুব সুন্দরভাবে ততদিন ঠিকই এগিয়ে যায়, যতদিন তারা একে অপরের ওপর আস্থাশীল না হয়। বিষয়টি অবাক হওয়ার মতো হলেও সত্য। বিশেষ করে এখনকার সমাজে একটি ছেলে ও মেয়ে বন্ধু হতে পারে। কিছুদিন পর এই বন্ধুত্ব যখন আরও ঘনিষ্ঠতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, একসময় তা বর্ষকালের পরিপক্ব দোপাটি ফুলের মতো ফেটেছিটে যেতে সময় নেয় না।
সারা পৃথিবীতে দিবসটি নিয়ে মাতামাতি হলেও অনেক দেশ রয়েছে যেখানে বন্ধু দিবস হিসেবে কোনো আলাদা দিবস পালিত হয় না। তবে বন্ধুত্ব আর আড্ডা কেবল সময় নষ্ট আর বখাটেপনা নয়। এই বন্ধুত্ব হতে পারে নির্মল বিনোদনের উৎস। এই বন্ধুত্ব হতে পারে সৃষ্টিশীলতার সূতিকাগার। আর উন্নয়নের শপথ নিয়ে একুশ শতকের বিশ্বে এগিয়ে যেতে গেলে এ ধরনের বন্ধুত্বটা অনেক জরুরি। এখানে বয়স আর লিঙ্গগত সমতা আর চাহিদা থেকে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য যদি থাকে সৎ আর চিন্তাধারা যদি হয় সৃষ্টিশীল, তবে এই ধরনের বন্ধুত্ব নিজের দেশ ও দশের জন্য হবে মঙ্গলজনক। কিন্তু বিপরীত ধারায় চলতে গিয়ে সমাজের প্রচলিত রীতি ভাঙার কৃৎকৌশলে যদি কারও মূল চিন্তা হয়ে থাকে তবে তা ভিন্ন কথা। দিবস পালন হোক বা না হোক, বন্ধুত্বের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হোক এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা। সবাই হানাহানি আর বৈরিতা ভুলে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করুক এই হোক একুশ শতকের অঙ্গীকার।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি