Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংকট-সংগ্রাম, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে অবিচল এক নারীর প্রতিকৃতি

মো. বিল্লাল হোসেন
৯ আগস্ট ২০২২ ১৩:৫০

“কোনো কালে হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে শক্তি দিয়েছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী”

সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতার এই লাইন দুটি যেন প্রাগৈহাতিক কাল থেকে আজ অব্দি সভ্যতা বিনির্মাণে নারীর অবদানের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি। এখানেই ফুটে উঠেছে আজকের বাসযোগ্য পৃথিবীতে নারীর অবদান বর্ণনাতীত। নারী মানেই কখনো মা, কখনো বোন আবার কখনো বউ। এ যেন একই সত্ত্বার মাঝে তিন রুপ। নারী জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে সম্ভাবনা, সংকট, দুর্যোগ কিংবা হারিয়ে যাবার ভয়, তবে এই সব কিছুকে ছাপিয়ে একজন নারী যখন সামনে নিয়ে যায় একজন মানুষকে, একটি দেশকে তখন তিনি আর সাধারণ নারী থাকেন না হয়ে যান অসাধারণ নারী। নজরুলের কবিতার বাস্তব প্রতিচ্ছবি ও তেমনই একজন দেশপ্রেমিক মহিয়সী নারী হলেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। তিনি শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্ধাঙ্গীই নন, তিনি হলেন আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের নিশ্চুপ ও নিভৃতচারী নকশাকার। বলা যায় তার আঁচল তলেই রোপিত হয়েছে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব সত্যিকারের বাংলা মায়ের মত সেই বীজকে পরম যত্নে আগলে রাখতেন সবসময় যেন কোনো ধরনের ক্ষতি না হয়। আর সেই বীজ থেকেই জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। বীজ থেকে ফলদ বৃক্ষে পরিণত হতে যে পরিচর্যা কিংবা যত্ন প্রয়োজন সেটি করেছিলেন শেখ মুজিব। তিনি (বঙ্গমাতা) যেভাবে পরম যত্নে আজীবন আগলে রেখেছিলেন শেখ মুজিবকে ঠিক তেমনিভাবে আগলে রেখেছিলেন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশের স্বপ্নকে।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ১৯৩০ সালের ৮ই আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম হোসনে আরা বেগম এবং বাবার নাম শেখ জহুরুল হক। এক ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তার ডাকনাম ছিল রেণু। এই নামেই বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু বঙ্গমাতাকে ডেকেছেন। একদম ছোটবেলা থেকেই সংগ্রামী জীবন যাপন করতে হয়েছে তাকে। কেননা মাত্র তিন বছর বয়সে হারান তার বাবাকে এবং পাঁচ বছর বয়সে হারান তার মাকে। এরপর থেকে বড় হয়েছেন দাদা শেখ কাশেমের কাছে। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের বয়স যখন ৭ বছর তখন তার দাদাও পরলোকগমন করেন। এভাবে মা-বাবা ও দাদাকে হারানোর পরও তিনি শোকে মূহ্যমান না হয়ে যে মানসিক শক্তি নিজের মধ্যে সঞ্চার করেছিলেন কল্পনাতীত। এরপরই মূলত বঙ্গমাতা চলে আসেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন “রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইলো দাদা, দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপরে সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাই-বোনদের সাথেই রেণু বড়ো হয়”। কেননা বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার ঘর ছিল পাশাপাশি, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান। বেগম মুজিবের শিশু ও বাল্যকাল কেটেছে বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুনের আদর, যত্ন ও পরিচর্যায়। পারিবারিক শিক্ষা কিংবা গৃহস্থালী শিক্ষা সবটাই শিখেছিলেন মুজিবের মায়ের হাত ধরে। অর্থাৎ, বেগম মুজিবের শৈশব, কৈশোর কেটেছে শেখ মুজিবের খেলার সাথী হয়ে।

বিজ্ঞাপন

বেগম মুজিবের লেখাপড়ার হতেখড়ি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে। কিন্তু সেটি খুব বেশিদিন দীর্ঘায়িত করতে পারেননি, গৃহশিক্ষকের কাছ থেকেই তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। এরপর থেকে ঘরেই চলত তার লেখাপড়ার চর্চা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন। এই প্রতিভার স্বাক্ষর কিন্তু তিনি তার স্বীয় কর্মে রেখে গেছেন।
শেখ মুজিবের বয়স যখন ১৩ বছর তখন ছোট্ট রেণুর সাথে বিয়ে হয়। রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। তবে এটি ছিল আজকের বাংলাদেশ প্রাপ্তির পেছনে একটি বড় মাইলফলক। কেননা এই দম্পতির জন্যই আমরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। বিয়ে হলেও বঙ্গবন্ধু এন্ট্রান্স পাশ করার পরই তাদের সংসারজীবন শুরু করেছিলেন।

যেহেতু খুব ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন বেগম মুজিব তাই তিনি ছোটবেলা থেকেই শেখ মুজিবের চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস, পরিকল্পনা, আকাঙ্খা, মানসিকতা ও জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। বেগম মুজিবের প্রতিটি কর্মে আমরা সেগুলোর প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। অসীম সাহসিকতায় দেশের মানুষের জন্য বুক চিতিয়ে লড়াই করে যাওয়ার প্রেরণা ও মানসিকতা তিনি পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে নিরবে সেটি প্রতিপালনের সর্বোচ্চ প্রয়াস দেখিয়েছেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধু তার প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রেণুর সাথে পরামর্শ করতেন। কারণ প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ের একদম প্রথমে। সেখানে তিনি লিখেছেন “আমার সহধর্মীণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছো লেখ তোমার জীবন কাহিনী। বললাম লিখতে যে পারিনা; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি”। স্ত্রীর এই পরামর্শে এবং তার দেওয়া খাতায় ই জাতির পিতা অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা লিখেছিলেন জেলে বসেই। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বেগম মুজিব খুবই বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতি ছিলেন বলেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জাতির পিতার জীবনী সাধারণ মানুষের জানা খুব জরুরী। আর তাইতো তিনি তার স্বামীকে জীবনী লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বপ্রণোদিত হয়ে।

সংকট-সংগ্রামে, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বঙ্গমাতা বেগম মুজিব

বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার জীবনে বহু সংকট এসেছে, করতে হয়েছে নানা ধরনের সংগ্রাম। এই দীর্ঘ যাত্রায় বঙ্গবন্ধুর নীরব সঙ্গী ও সার্বক্ষণিক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করে গেছেন বেগম মুজিব। শেখ মুজিবের জীবনে যখনই কোনো সংকট এসেছে হোক সেটা পারিবারিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই ত্রাতার ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্গমাতা। এরকম বহু ঘটনা আছে যেগুলো প্রমাণ করে ফজিলাতুন নেছা মুজিব কিভাবে সংকটে ও সংগ্রামে এগিয়ে গেছেন দুর্বার গতিতে। যদিও তার খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলনা তবুও তিনি জীবনের বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে স্বশিক্ষায় নিজেকে এমনভাবে শিক্ষিত করেছিলেন যার ফলে তিনি নিজেই হয়ে গিয়েছিলেন একটি ‘প্রতিষ্ঠান’। সর্বোপরি শেখ মুজিবের লেখাপড়ার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন। ১৯৪২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হলেছিলেন। কিছুদিন পরীক্ষার জন্য কলকাতা যেতে হবে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হাতে তেমন কোনো টাকাপয়সা নেই। কি করবেন তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। পড়েছেন দারুণ সংকটে। এই সংকট থেকে কিভাবে পার হয়েছিলেন সেটা নিজেই লিখেছেন তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে। তিনি লিখেছেন “ কলকাতা যাব পরীক্ষাও নিকটবর্তী, লেখাপড়া তো মোটেই করিনা। ভাবলাম কিছুদিন লেখাপড়া করব। মাহিনা বাকি পড়েছিল, টাকা পয়সার অভাব। রেণুর কাছে আমার অবস্থা প্রথম জানালাম। আব্বাকে বললে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন মনে হলো। কিছুই বললেন না। টাকা দিয়ে আব্বা বললেন কোনো কিছুই শুনতে চাইনা, বি.এ পাশ ভালভাবে করতে হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছ। পাকিস্তানের আন্দোলন বলে কিছুই বলি নাই। এখন কিছু লেখাপড়া করো। আব্বা, মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। অমঙ্গল অশ্রুজল বোধ হয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে”। এমনকি বহুবার তিনি নিজেদের ধান বিক্রি করে নিজের স্বামীকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেছেন। আর এভাবেই রেণুর হাত ধরে সংকট উতরে গেছেন শেখ মুজিব।

১৯৪৬ সালে দাঙ্গার সময় বঙ্গমাতা নিজে অসুস্থ থাকা অবস্থায় ও তিনি তার স্বামীকে মানুষের জন্য কাজ করার তাগাদা দিয়েছিলেন। চিঠি লিখে দেশের কাজের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন এভাবে “আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্য জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচেয়ে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপর আমার ভার ছেড়ে দিন”। মানুষের জন্য কতটা ত্যাগী হলে এই কথাগুলো বলা সম্ভব নিজে অসুস্থ থেকেও, ভাবলেই চোখে জল আসে। কেননা তখন তিনি ১৬ বছরের কিশোরী কিন্তু চিন্তা চেতনায় অসম্ভব পরিপক্বতার ছাপ।

১৯৫৪ সালে ঢাকা এসে বঙ্গমাতা একক সংসার জীবন শুরু করেন। তখন বসবাস শুরু করলেন ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকায় রজনী চৌধুরী লেনে। এরপর রাজনৈতিক কারণে বহুবার বাসা বদলাতে হয়েছে থাকতে হয়েছে পালিয়ে। যতবার বাসা বদলাতে হয়েছে প্রায় সব বারই নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন বঙ্গমাতা। নিজে গিয়ে গিয়ে বাসা খুঁজেছেন। এরপর বাঁচ্চাদের নিয়ে সেখানে বসবাস করেছেন। এর বেশ কয়েক বছর পর ১৯৬১ সালে ধানমন্ডির ৩২ নং সড়কে তৈরী করেছিলেন নিজেদের বাড়ি। এ বাড়ি তৈরীতেও তার শ্রম ঘাম জড়িয়ে আছে। শ্রমিকদের খরচ বাঁচাতে তিনি নিজেই ইট বিছিয়ে দিতেন এবং প্রতিদিন দেয়ালে পানি দিতেন। এভাবেই বেগম মুজিবের শ্রমে ঘামে তৈরী হয়েছিল ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাড়িটি। যে বাড়িটি পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর আস্থা, ভালোবাসা, আগ্রহ ও নির্ভরতার প্রতীক। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম যেন এই বাড়িকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল। এসব কিছুর মূলে ছিলেন বঙ্গমাতা। এ যেন এক সংগ্রামী নারীর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। যিনি সংগ্রাম করেছেন জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে।

জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু প্রায় নয় বছরের বেশি সময় জেলখানায় কাটিয়েছেন। জেলে থাকাকালীন সময়গুলোতে নিজের সংসার চালানো, ছেলে মেয়েদের দেখাশুনা ও পড়ালেখা এবং রাজনৈতিক কর্মী ও তাদের পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্ব ইত্যাদি পালন করেছেন বঙ্গমাতা। সংসারে কখন কি লাগবে সবটাই নিজের মত করে ব্যবস্থা করেছে। দিন গুজরান করেছেন অনেক কষ্টে কিন্তু কখনো মুখ ফুটে কারো কাছে কখনো সাহায্য চাননি। এমনও হয়েছে ঘরে তেমন কোনো বাজার নেই কিন্তু বাচ্চারা খাওয়ার জন্য চাপাচাপি করছে। তখন তিনি ডাল চাল মিশিয়ে খিঁচুড়ি রান্না করে দিয়েছেন। আর বলেছেন আচার দিয়ে খাও এগুলো খুব সুস্বাদু খাবার।

আবার সাংসারিক প্রয়োজনে একটু কম দরকারী জিনিসগুলোকে বিক্রি করে তিনি সংসার সামলেছেন। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনা লিখেছেন “আমাদের বাসায় ফ্রিজ ছিল, আব্বা আমেরিকা যখন গেছেন ফ্রিজ নিয়ে এসেছেন। সেই ফ্রিজটা বিক্রি করে দিলেন। আমাদের বললেন ঠান্ডা পানি খেলে সর্দি-কাশি হয়, ঠান্ডা লাগে, গলা ব্যথা হয়, ঠান্ডা পানি খাওয়া ঠিক না। কিন্তু এটা কখনো বলেননি যে আমার টাকার অভাব। সংসার চালাতে হচ্ছে, আওয়ামীলীগের নেতাদের সাহায্য করতে হচ্ছে। কে অসুস্থ তাকে টাকা দিতে হচ্ছে”। স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার এই পদক্ষেপগুলোই প্রমাণ করে তিনি কতটা দৃঢ় মনোবলের মানুষ ছিলেন। তার জীবনের এই ঘটনা গুলোই এক এক টুকরো সংগ্রাম!

দল কিংবা দলীয় নেতাকর্মীদের দায়িত্ব নেয়া প্রসঙ্গে আওয়ামীলীগ নেতা তোফায়েল আহমদের কিছু স্মৃতিচারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন “১৯৬৬-৬৭ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ে। শ্রদ্ধেয় নেতা প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক তখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, মজহারুল হক বাকি সভাপতি। আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ভিপি। আমি মোটরসাইকেল চালাচ্ছি, রাজ্জাক ভাই পেছনে বসা। গন্তব্য আগামসি লেনে অবস্থিত ছাত্রলীগের অফিস। সেখানে যাওয়ার পর বাড়িওয়ালা আমাদের ডেকে বললেন, আপনারা এখান থেকে চলে যান। তিন মাসের ভাড়া বাকি। আপনারা অফিন ভাড়া দিতেন পারেন না। এখানে ছাত্রলীগ অফিস রাখা যাবেনা। আমরা বাড়িওয়ালাকে সবিনয়ে অনুরোধ করলাম- দয়া করে আমাদের কয়েক ঘন্টা সময় দেন। তিনি আমাদের অনুরোধ রাখলেন। তখন বঙ্গবন্ধুসহ শীর্ষ নেতার কারারুদ্ধ। আমরা সেখান থেকে ধানমন্ডি ৩২ নং-এ বঙ্গমাতার কাছে গিয়ে আমাদের দুরবস্থার কথা বললে তিনি রাজ্জাক ভাইয়ের হাতে ২০০ টাকা দিলেন। এ ২০০ টাকা থেকে বাড়িওয়ালার ৩ মাসের ভাড়া বাবদ মাসিক ৬০ টাকা করে ১৮০ টাকা পরিশোধ করলাম। বাকি ২০ টাকা দিয়ে আমরা একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেলাম”। এই কথাগুলোই প্রমাণ করে বেগম মুজিব কতটা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন।

শেখ মুজিব জীবনের বেশিরভাগ সময় জেলে কাটিয়েছেন। জেলে থাকা অবস্থায় জামিন কিংবা আইনী পরামর্শের জন্য সকল দৌড়-ঝাপ করতেন বঙ্গমাতা নিজেই। এ প্রসঙ্গে জাতির পিতা বলেছেন “জীবনে এ পর্যন্ত ২৪টি মামলার মোকাবিলা করেছি, আসলে মোকাবিলা করেছে আমার স্ত্রী রেণু। সে-ই কাগজপত্র দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে ছুটেছে এক উকিল থেকে আরেক উকিলে। ফলে আমার নামে মামলা মানে রেণুর নামে মামলা! রেণু ছাড়া আর কে ছিল তখন আমাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করার” (আমার রেণু, পৃষ্ঠা-১৮)। এভাবেই তিনি অসীম ধৈর্য্য ও সাহসিকতার পরিচয় জীবনের সংকটগুলোকে মোকাবেলা করেছেন। জেলে নিয়মিত সাক্ষাত করতেন শেখ মুজিবের সাথে আর সকল নির্দেশনাগুলো পৌঁছে দিতেন নেতাকর্মীদের কাছে।

১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের কারনে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গমাতা সবসময়ই এই আন্দোলনকে দৃঢ়চিত্তে সমর্থন করেছেন এবং জনমত গঠনে কাজ করেছেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে লাহোরে গোল টেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বঙ্গমাতার পরামর্শে বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিলেন। এরপর গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফ্রেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরেরদিন তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। প্যারোলে মুক্তি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন বেগম মুজিব আর এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তুলেছিল।

১৯৭১ এর ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল জ্বালানী হিসেবে কাজ করেছিল তখন। এই ভাষণ কিন্তু বঙ্গমাতার সাথে পরামর্শ করেই দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। ভাষণের পূর্বে বঙ্গমাতা তাকে বলেছিলেন “সমগ্র দেশের মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। সবার ভাগ্য আজ তোমার উপর নির্ভর করছে।—তোমার মনে যে কথা আসবে সে কথাই বলবে। বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে তোমার যে স্বপ্ন সেই কথাগুলো তুমি স্পষ্ট করে বলে দিবে”। হ্যাঁ সত্যিই বঙ্গবন্ধু তার মনের কথাগুলো বলতে পেরেছিলেন সেদিন এজন্যই আজ আমরা বাংলাদেশী।

সর্বোপরি, বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিটি সংগ্রাম, দুর্যোগ কিংবা দুর্বিপাকে বঙ্গমাতা ছিলেন সবসময়ই ছায়া হয়ে। তার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, দলকে সংগঠিত করা, দক্ষতা, দূরদর্শিতা ও সাহসিকতা এসব গুণগুলো দ¦ারাই জীবনের সংকটময় মূহুর্তগুলোকে মোকাবিলা করেছেন। বুক চিতিয়ে সংগ্রাম করেছেন আমৃত্যু আপামর জনতার অধিকার আদায়ে, কখনো ভেঙে পড়েননি এগিয়ে গেছেন দুর্বার দুরন্ত গতিতে। এ যেন সংকট-সংগ্রাম, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে অবিচল এক নারীর প্রতিকৃতি। এ যেন বাংলার হাজারো মায়ের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। তাইতো কবি কামাল চৌধুরী তার ‘বঙ্গমাতা’ কবিতায় লিখেছেন-

“তোমার জীবনও জাতির পিতার
জীবনী ও নিশ্বাস
স্মৃতিসত্তায় মহীয়সী নারী
সংগ্রামী ইতিহাস।

এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা একে অপরের পরিপূরক। আমাদের প্রত্যেকের উচিত বঙ্গমাতাকে নিয়ে আরো বেশি চর্চা করা। তার জীবন সম্পর্কে আরো বেশি জানা এবং সে মতে জীবন গঠনের চেষ্টা করা। পরিশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই যে, নিরবে পর্দার আড়ালে করা তোমার সংগ্রামের কথা তোমার প্রতিটি সন্তান কখনো ভুলবে না। মা তোমাকে সশ্রদ্ধ সালাম!

লেখক: শিক্ষার্থী

সারাবাংলা/এজেডএস

ফজিলাতুন নেছা মুজিব মো. বিল্লাল হোসেন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর