টিকটক, লাইকি ও বিগো লাইভ অ্যাপের ব্যবহারে চাই কঠোর নীতিমালা
১০ আগস্ট ২০২২ ১৯:৫৩
তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে মানুষের অন্যতম সঙ্গী হল সোশাল মিডিয়া। মানুষের নিত্য নৈমিত্তিক জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছে এই সোশাল মিডিয়া। বিনোদনের পাশাপাশি ব্যবসা-বানিজ্য, সমাজ সেবা মূলক বিভিন্ন কর্মকান্ড,প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক বিভিন্ন কার্যাবলী এখন সোশাল মিডিয়া দ্বারা পরিচালিত ও প্রভাবিত হচ্ছে। সকল বয়সী ও সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের সাথে সোশ্যাল মিডিয়া এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইন্স্টাগ্রাম, লিংকড-ইন, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, স্কাইপি, জুম, গুগল মিটিং ইত্যাদি। এসব সোশ্যাল মিডিয়ার নানাবিধ উপকারীতার পাশাপাশি নেতিবাচক দিক রয়েছে।কারণ প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের পরিবর্তে যখন অপব্যবহার হয় তখন সেই প্রযুক্তি আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কিছু অ্যাপস রয়েছে যেমন টিকটক, লাইকি, বিগো ইত্যাদি যাদের কোনো ইতিবাচক দিক নেই। পরিতাপ ও উদ্বেগের বিষয় হল মানুষ এসবের দিকেই বেশি ঝুঁকছে। বিশেষ করে অল্প বয়সী তরুণ তরুণীরা মারাত্মক ভাবে এসব অ্যাপ ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এসব অ্যাপ ব্যবহারের ফলে তরুণ প্রজন্ম বিপথগামী হয়ে পড়ছে। নষ্ট হচ্ছে নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। তরুণ বা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে, হয়ে উঠছে সহিংস।
উপরোক্ত অ্যাপস গুলোর মধ্যে বিগো লাইভ অ্যাপের মাধ্যমে তরুণ ও যুবকদের টার্গেট করে লাইভে এসে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দিয়ে এবং যৌনতার ফাঁদে ফেলে কৌশলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক তরুণ। অ্যাপটি মূলত একটি লাইভ স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম, যেখানে একজন ব্যবহারকারী তার অনুসারীদের সঙ্গে লাইভে মুহূর্ত শেয়ার করে। লাইভে আসা অনেকেই নগ্ন ও অর্ধনগ্ন অবস্থায় থাকে এবং এসব লাইভের অধিকাংশই যৌন উসকানিতে ভরা থাকে।
টিকটক ও লাইকি অ্যাপের মাধ্যমে উৎসাহিত হয়ে অনেক কিশোর-তরুণ উদ্ভট স্টাইলে চুল কেটে ও রঙে রঙ্গিন করে এবং ভিনদেশি অপসংস্কৃতি অনুসরণ করে ভিডিও তৈরি করে। যাতে অনেক সময় সহিংস ও কুরুচিপূর্ণ কনটেন্ট থাকে। অশালীন পোশাক পরিহিত তরুণীরা টিকটকের অশ্লীল ভিডিওতে নাচ, গান ও অভিনয়ের পাশাপাশি নিজেদের ধূমপান ও সিসা গ্রহণ করার ভিডিও আপলোড করেছেন। উদ্বেগজনক যে এই টিকটক ও লাইকি ভিডিও গুলোতে নেই কোনো শিক্ষনীয় বার্তা। উল্টো এসব ভিডিওর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তা চলে যাচ্ছে। অ্যাপগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রদর্শনেচ্ছার বিষয় থাকে।
টিকটক ও লাইকি ব্যবহারকারীর অনেকে তথাকথিত স্টার বা সেলিব্রিটি হন। প্রত্যেকটি সেলিব্রিটি বা স্টারের বলয়ে এক বা একাধিক গ্রুপ থাকে। আর এই গ্রুপ গুলো একসময় কিশোর গ্যাং- এ পরিণত হয়।অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে কিশোর গ্যাং গুলো বিভিন্ন অপরাধ যেমন মাদক গ্রহণ, হত্যাকান্ড , মারামারি ও ধর্ষণের মত ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন। এইতো গত বছরে ২৬ ডিসেম্বরের ঘটনা- দেশীয় বিভিন্ন পত্রিকায় এসেছে ‘টিকটক স্টার’ বানানো হবে এমন কথা বলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া একটি মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করেন। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি নির্জন জায়গায়। সেখানে টানা তিন দিন আটকে রেখে চলে দলবেঁধে ধর্ষণ। মেয়েটির বাড়ি গাজীপুরে। মেয়েটির নিজেরও একটি টিকটক আইডি ছিল।
এছাড়া কিছু দিন আগে টিকটক ভিডিও করার সময় এক প্রকৌশলীসহ স্থানীয় লোকজনকে মারধর করার অভিযোগ উঠে ‘অপু ভাই’ নামে এক টিকটকার ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে।ভয়ঙ্কর তথ্য হল অপসংস্কৃতির ধারক বাহক এসব অপু ভাইদেরও হাজার হাজার ফ্যান-ফলোয়ার থাকে! এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে এসব লাইভ স্ট্রিমিং অ্যাপের অপব্যবহার ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। এসব অ্যাপগুলোকে কেন্দ্র করে মানবপাচার এবং লক্ষ লক্ষ টাকা বিদেশ পাচার হচ্ছে। পাশাপাশি গড়ে উঠেছে ভয়ংকর সব অপরাধী চক্র।
একটি ঘটনা বলি-সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া আমার এক (টিউশন) ছাত্র রয়েছে। তার একটি টিকটক ও একাধিক ফেসবুক আইডি রয়েছে। একদিন দেখলাম সে তার মাই-ডে স্টোরিতে (আনুমানিক) বিশোর্ধ্ব যুবতীর একটি টিকটক ভিডিও ক্লিপ শেয়ার দিয়েছে এবং ক্যাপশনে লিখেছে ‘মাই ক্রাশ’। যেই বয়সে চকলেট খাওয়া উচিত ছিল সেই বয়সে সে টিকটকে ক্রাশ খাচ্ছে। আচঁ করুন পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে।
বেহায়াপনা ও নির্লজ্জতা ব্যতিরেকে শিক্ষামুলক কোনো কনটেন্ট ভিডিওগুলোতে থাকে না। অথচ উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা বাদ দিয়ে এসব অ্যাপে অধিক সময় ব্যয় করছে। এতে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে নানাবিধ ভীনদেশী ও অপসংস্কৃতির বেড়াজালে আটকে এসব ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। তরুণ সমাজ এসব ব্যবহারের মাধ্যমে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চায় এবং নিজেকে জনপ্রিয় ভাবতে শুরু করে। এ-ও শুনা যায় এসব ভিডিও বানিয়ে নাকি তথাকথিত টিকটক ও লাইকি সেলিব্রিটিরা বিশ্বের বুকে সারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে ! অথচ উচিত ছিল বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানে অবদান রেখে বিশ্বের বুকে প্রতিনিধিত্ব করা। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে তা না করে আমরা টিকটক ও লাইকি এবং গ্যামাসক্ত একটি জাতিতে পরিণত হচ্ছি।
সুস্থ ধারার বিনোদনের পরিবর্তে সস্তা, নিম্ন মানের এবং অশ্লীল ও যৌন উসকানিমুলক এসব কনটেন্ট দেখে সমাজের ছোট ছোট কিশোর কিশোরীদের মনজগত, আচার আচরণ ও পোশাক পরিচ্ছদে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে বাড়ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও বিচ্যুতি। বিব্রতকর, অনৈতিক ও অশ্লীল ভিডিওগুলো পর্নোগ্রাফিকে উৎসাহিত করায় এরই মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া এসব ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনতিবিলম্বে এসব অন্তঃসারশূন্য অ্যাপগুলো নিষিদ্ধ করা উচিত। নতুবা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ও এসব অ্যাপস ব্যবহারে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। এছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক ভাবেও সচেতনতা বাড়াতে হবে।
লেখক: কলাম লেখক
সারাবাংলা/এজেডএস