ছাত্রশিবির, কিশোরকণ্ঠ ও একটি মগজধোলাই প্রজন্ম
১০ আগস্ট ২০২২ ২০:২৭
আমি তখন ক্লাস সেভেনে কি এইটে পড়ি। খুবই অল্প বয়স, কৈশোর কালের লক্ষণ আমার মাঝে তখন সদ্য প্রস্ফুটিত । সম্ভবত ২০১৩ কি ২০১৪ সাল।
খেয়াল করতাম, ক্লাসের বেশ কিছু বন্ধু কী যেন একটা বই পড়ে। বইটি প্রতি মাসে মাসে বের হতো বিধায় কারা যেন প্রতি মাস শেষে নিয়মিত বইগুলো সাপ্লাই দিতো। দাম ছিলো মাত্র ২০ টাকা। অনেক সময় তাদেরকে বইগুলো বাকিতেও সাপ্লাই দিতে দেখতাম । কৌতুহল বশত একদিন কোন এক বন্ধুর কাছ থেকে একটি বই নিয়ে পড়লাম। বেশ ভালো লাগলো। মোটা বাংলা অক্ষরে বইটির নাম লেখা ছিলো ‘কিশোরকণ্ঠ’। পদাধিকারবলে বইটির তখনকার সম্পাদক ছিলেন শিবিরের সাবেক সভাপতি মতিউর রহমান আকন্দ।
আমার দূর্ভাগ্য যে পাঠ্যবইয়ের বাইরে ওটাই ছিলো আমার জীবনের প্রথম কোনো মাসিক বই । বইটি পড়ে ভালো লাগার একপর্যায়ে অন্যদের দেখাদেখি আমিও কেনার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। দেখা করলাম সেই সাপ্লায়ারদের সাথে। আলাপচারিতা হলো। কথা হলো। এরইমাঝে চা-নাশতার দাওয়াত বিনিময়ও সম্পন্ন হলো। তাদের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়; আমার পার্শ্ববর্তী গ্রামেই।
বই নেওয়ার সুবাদে আমরা কয় বন্ধু একদিন গেলাম সেই সাপ্লায়ারদের গ্রামে। রমজান মাস হওয়ায় তারা আমাদেরকে নিয়ে বসলো গ্রামের রাস্তার ধারে বটবৃক্ষের নিচে একটি মসজিদে। কথা হয় বেশ কিছু বিক্ষিপ্ত টপিক নিয়ে। সেদিনের সেই টপিকের ভিতরে ওসামা বিন লাদেনকে হিরো পর্যন্ত বানিয়ে দেওয়া হয়। টগবগে কিশোরের ন্যায় বুক ফুলিয়ে শুনেছি সেদিন কথাগুলো। খুব মনে আছে, সেদিনের ছোট্ট মিটিংয়ের বড়ো উপস্থাপকটি ঘুরেফিরে বারবার একটা সংগঠনের নাম মুখ দিয়ে আওড়াচ্ছিলেন আর গুণগানে ফেটে পড়ছিলেন। সংগঠনের নামটা সবারই পরিচিত- “বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির।” সংক্ষেপে ‘ছাত্রশিবির’। আর বই সাপ্লায়ার ছিলো একজন পাক্কা শিবির নেতা। সুভাষিত সুমিষ্ট শব্দজালের ফাঁদে ফেলে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিতে লাগল শিবিরের সাংগঠনিক পোস্টার, স্টিকার, ক্যালেন্ডার।
“নামে ইসলাম, নিশ্চয়ই এরা ইসলামিক দল। তাহলে ওসামা বিন লাদেনও নিশ্চয় ভালো লোক ছিলো! ইশ, বেধর্মী শয়তানের দল তাহলে আমাদের মুসলিমদের এত খারাপ বানিয়ে দিচ্ছে। লাদেনের মতো ভালো লোককে তারা এত খারাপ বানিয়ে দিলো!”- মনে মনে কথাগুলো আওড়াচ্ছিলাম (এখন অবশ্য এগুলো মনে উঠলে হাসি পায়)।
এরপরে ঐ সাপ্লায়ারদের বেশ কিছু মিটিংয়ে আমি উপস্থিত হয়েছি, বড়ো একটা ইফতার পার্টিতেও উপস্থিত থেকেছি। ধিরেধিরে তাদের টার্গেট বুঝতে পারি, কিন্তু ঐ মুহুর্তে ঠিক কী করা উচিত আমি বুঝতে পারিনি। আগেই বলেছি, আমার বয়সটা তখন খুবই অল্প; অভিজ্ঞতার ঝুলিটাও শুন্যের কোঠায়।
নিয়মিত পত্রিকা পড়ার সুবাদে ঐসময়ে অনেকগুলো ঘটনা আমার নজরে আসতো। জীবন্ত মানুষের পায়ের রগ কাটা, পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ জ্বালিয়ে দেওয়া- এই ঘটনাগুলোই ছিলো তখনকার পত্রিকাগুলোর দৈনন্দিন সংবাদের খোরাক । আর এই সবগুলো ঘটনার পেছনে উপরের ঐ ইসলামিক দলটার নাম বারবার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকতো। ঠিক তখনই আমার অনুসন্ধিৎসু মনে বেশ কিছু প্রশ্নের উদয় হয়। সেদিনের মসজিদে বসে বই সাপ্লায়ার শিবির নেতার কথা আর পত্রিকার প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা, এত এত ঘটনা- এগুলো তো ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে! তাহলে আসল রহস্যটা কী?
আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজতে থাকি। একদিন শরণাপন্ন হই শ্রদ্ধেয় বড় ভাই তৌফিকের এর কাছে। জিজ্ঞাসার একপর্যায়ে শিবির সম্পর্কে পেতে থাকি অনেক অজানা তথ্য, ক্রমশ খুলতে থাকে আমার মগজে সঞ্চিত প্রশ্নজট।
সেসময়ে আমি সস্তা একটা বাটন ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করতাম। তখন গ্রাম পর্যায়ে স্মার্টফোন খুব একটা প্রচলন ছিলো না বললেই চলে । তৌফিক ভাইয়ের কথার সত্যতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে আমি গুগলে সার্চ করতে থাকি ‘শিবির’ সম্পর্কে। মিলতে থাকে সমস্ত প্রশ্নোত্তর, পেতে থাকি নিত্যনতুন অজানা সব তথ্য। ধিরে ধিরে বুঝতে পারলাম, ‘নিশ্চিত ব্রেন ওয়াশড জোম্বি হওয়া থেকে বেঁচে ফিরলাম।’ শিবিরের এই প্রশিক্ষিত সুকৌশলী ফাঁদ থেকে খুব অল্পই ফিরে আসতে পারে, বাকিরা যেতে থাকে অন্ধকার ঘোর অমানিশার অন্ধকারের দিকে।
একটিবার চিন্তা করুন, ওসামা বিন লাদেনের মতো একটা বিশ্ব স্বীকৃত জঙ্গিকে আমাদের কাছে ‘বীর’ পরিচয়ে পরিচিতি পাইয়ে দিচ্ছে! মসজিদ উপসনালয়ে বসে তারা রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে, আমাদের মতো শিশু-কিশোরদের ব্রেন ওয়াশ করছে। মানুষের সাথে তো বটেই, এটা তো রীতিমতো ধর্মের সাথে বেইমানি।
এইবার আসি ‘কিশোরকণ্ঠ’র পর্বে। প্রিয় পাঠক, প্রথমেই আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি এটাকে ‘বই’ সম্মোধন করায়। এটাকে বই বললে মারাত্মক ভুল বলা হবে। এটি বই নয়, এটি চক্রান্তের পাণ্ডুলিপি। যার মাধ্যমে সুকৌশলে একটি প্রজন্মকে জ্ঞানান্ধ ও খোঁড়া করে দেওয়ার পায়তারা চলেছে। উৎসুক পাঠক হওয়াতে ওটার প্রতিটা পৃষ্ঠা আমি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়তাম। খেয়াল করতাম, কিশোরকণ্ঠে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে ছিলো একেবারে নিশ্চুপ। স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাসের সংখ্যায় ওরা ছাপাতো বখতিয়ারের ঘোড়ার কাহিনী, পলাশীর যুদ্ধ, কিংবা তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার কাহিনী । এদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, বাঙালির যে একজন মহান নেতা ছিলেন, দীর্ঘ ২৪ বছরের পাকিস্তানি দুঃশাসনকাল পার হয়েছে, কোন কোন দল স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, এগুলো তারা সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে। শিশু-কিশোরদের জানতে দেওয়া হয়নি এই ইতিহাস। এমনকি যুদ্ধাপরাধী ও ভাষা আন্দোলনের বিরোধীতাকারী গোলাম আজমকে এই কিশোরকণ্ঠ ‘ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক’ হিশেবে পরিচয় করিয়ে প্রজন্মের কাছে মিথ্যা তথ্য পর্যন্ত দিয়েছে। অর্থাৎ একাত্তরের ভয়ংকর যুদ্ধাপরাধীদেরকে কিশোরদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার এমন কোনো ব্যবস্থা নেই, যা শিবির করেনি।
১৯৮৪ সাল থেকে এই কিশোরকণ্ঠ শিবির দ্বারা প্রকাশিত হয়ে আসছে। মাঝে শুনেছিলাম কিশোরকণ্ঠ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা যদি এখনো চলমান থাকে, তাহলে সাধুবাদ জানায় রাষ্ট্রের সেবকদের।
হিতাহিতজ্ঞান বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আমি শিবির তথা কিশোরকণ্ঠের সাথে সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন করেছি। আমি চাই না আমার প্রজন্মের কিংবা আমার ভবিষ্যতে প্রজন্মের কেউ এই কিশোরকণ্ঠ নামক শিবিরের মিথ্যাচারের আঁতুড়ঘর পাঠ করে বিভ্রান্ত হোক। একইসাথে এটাও চাই না এই যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের সাথে কেউ সম্পর্ক রাখুক। মুক্তিযুদ্ধে আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী গঠন করা হয় এই ছাত্রসংঘ তথা ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে । বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম নীলনকশা এরাই প্রণয়ন করে। শিবির গোপনে এখনো সুসংগঠিত। শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে এরা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে, নামমাত্র দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে নিজেদের রাজনীতির মাঠ বৃদ্ধির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অবাক করা বিষয়, শিবিরের নতুন টার্গেট আওয়ামীপন্থী ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানকে নিজেদের দলে ভেড়ানো। এমনকি শিবির একাজে সফলতাও পেয়েছে। এটা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটা অশনিসংকেত। শুধু প্রজন্ম নয়, অশনিসংকেত বাংলাদেশের জন্যও।
রাষ্ট্রযন্ত্রকে এব্যাপারে আরো কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। শিবির তথা ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতিকে-রাজনৈতিক দলকে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু যে ‘ধর্মনিরেপক্ষ’ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটার বাস্তবায়ন করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এজেডএস