করোনা পরবর্তী বিশ্ব: কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য দেখতে হবে
১১ আগস্ট ২০২২ ১৮:১২
আমরা দশম শ্রেণিতে উঠলাম। সামনে বোর্ডের পরীক্ষা, স্কুলের সবচেয়ে সিনিয়র ক্লাসের পড়ুয়া হওয়া মানে আলাদা কিছু দায়িত্বও বটে। সদ্য ক্লাস শুরু হয়েছে, একদিন অনেক রাতে আমাদের বাবা বাড়ি ফিরে বললেন, চীনের ইউহান প্রদেশে নতুন একটা ভাইরাসের দেখা মিলেছে। আমরা শুনলাম, কিন্তু তখন একবারও ভাবিনি এটি আমাদের দেশে এসে হাজির হতে পারে। এমনকি আমাকেও দুই দফা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে হবে।
সেই সময় একে একে খবরের কাগজ, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, টেলিভিশন সবকিছুর দখল নিতে থাকলো করোনা ভাইরাসের সংবাদ। লকডাউন শব্দটির সাথে একটা হাড় হিম করা ভয় উপকথার অ্যানাকন্ডার মতো হা করে এগিয়ে আসছিলো। মার্চ মাসে বাংলাদেশে প্রথম কোভিড সংক্রমণ সনাক্ত হলো— একটা ঝড়ের হাওয়ায় পাল্টে গেলো সবার জীবন।
মা ওয়ার্ক ফ্রম হোমে আর বাবা সাংবাদিকতার পেশার কারণে প্রতিদিন অফিসে যাচ্ছেন। অফিস যাওয়া আসার পথে বাবার ফোনে করা ভিডিওতে অথবা টেলিভিশনের খবরে লকডাউনের শহরটা দেখি— সেই শহরটা আমি চিনি না, আমাদের প্রজন্ম চিনে না।
আমাদের স্কুল বন্ধ, বাবার আসা যাওয়া ছাড়া বাসার সদর দরজা সারাদিন বন্ধ। বন্ধুদের সাথে সামনা-সামনি দেখা হওয়া বন্ধ। আমরা সবাই রবিনসন ক্রুসো হয়ে গেলাম। সকালে ওঠা নেই, স্কুল যাওয়া নেই।
এতোদিনের জীবন যাপনের সব রুটিন হাওয়ায় উড়ে গেলো। সংক্রমণ, মৃত্যু, অক্সিজেন সিলিন্ডার খোঁজা, পরিচিত মানুষের চাকরি হারানোর খবর পেতে পেতে দিনগুলো বিষন্ন হয়ে উঠলো। বড়রা ব্যাস্ত-জীবন জীবিকা সংক্রামন রোধের পথ খোঁজা নিয়ে। ছোটরা ব্যস্ত বড়দের মোবাইলের স্ক্রিনে গেম খেলা নিয়ে, বয়স্করা সংকিত নিজেদের জীবন নিয়ে।
কিন্তু আমাদের প্রজন্ম যাদের বয়স ১৫ থেকে ১৮, আমরা কী করবো? আমরা না পারছি ছোটদের মতো ভিডিও গেম খেলে সময় পার করতে, বড়দের মতো সংকিত থাকতে অথবা বয়োজ্যেষ্ঠদের মতো সারাদিন অসুখ চিন্তা করতে।
দিনে হয়তো দুটো মুভি দেখা যায়, কিছু সময় চোখ বন্ধ করে গান শোনা যায়, বই পড়েও সময় কাটানো যায় কিন্তু আমাদের হঠাৎ এই যে বিচ্ছিন্নতা—স্কুল বন্ধ, পনেরো হাজার স্কয়ার ফিটের মধ্যে আটকে থাকা, আত্মীয়স্বজন বন্ধুদের সাথে সামনা-সামনি দেখা না হওয়া, অনলাইন ক্লাস শুরুর আগে সময় গুলোতে নিয়মিত লেখা পড়ার থেকে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় দুরে সরে যাওয়া সবই ছিলো ভাবনার বাইরের ঘটনা।
আমরা দেখলাম প্রান্তিক মানুষদের জন্য নানারকম কর্মসুচী, আক্রান্তদের জন্য অক্সিজেন সার্ভিস কিন্তু আমাদের বয়সীরা যে হঠাৎ পরিবর্তন হওয়া এই পরিস্থিতির কারণে যে একটা মানসিক শূন্যতার মধ্যে পড়লো সেটি আমাদের অধিকাংশ অভিভাবক, পরিবার পরিজন, শিক্ষকেরা, নীতিনির্ধারকরা গুরুত্বে সাথে কি নিয়েছিলেন?
যে বয়সটা আমাদের কাটার কথা ছিলো নিয়মিত স্কুল, যার যা পছন্দের শখ বা বিভিন্ন সংঠনের সাথে কাজ করে কাটানোর তখন এই হঠাৎ ঘরবন্ধি হওয়ায় আমাদের দিন আর রাত গুলো অনেক বেশি লম্বা হয়ে গেলো। আমাদেরকে কোভিড মোকাবেলায় সুস্বাস্থের জন্য অনেক নিয়ম, ব্যায়ামের পাশাপাশি ওষুধ খাওয়ানো হলো।
কিন্তু আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিবর্তিত অবস্থার কারণে যে অবনতি ঘটলো আজব হলেও সত্য যে তা কারোই হিসাবে থাকলো না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে কোভিডকালীন লকডাউনের পর আমাদের বয়সীরা অধিকাংশই নানাবিধ মানসিক সংকটে ভুগেছে। কিন্তু কুৎসিত হলেও সত্য যে আমাদের চারপাশের অনেক বড় মানুষ থেকে শুরু করে একদম প্রান্তিক মানুষে পর্যন্ত অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি বুঝেন না। তারা মনে করেন ধমক বা শাসনই সমাধান। কিন্তু এতে একটা পুরো প্রজন্ম হুমকির সামনে পড়ছে।
এটি তো অতি সত্য কথা—একটি প্রজন্মের এতো বেশি স্বাস্থ্যহানী আগামী দিনের বাংলাদেশের জন্য শুধুমাত্র হুমকি নয় বিপদ ডেকে আনছে।
এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভাবা দরকার রাষ্ট্রের, অভিভাবকদের, শিক্ষকদের এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর। কেননা পনেরো থেকে আঠারো বছর বয়সী কিশোর কিশোরীদের বড় একটা সংকট তাদের সাহায্য ছাড়া এই সংকট গুলো থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবেনা।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এজেডএস