সাধারণ মানুষের কথা ভাবার কেউ নেই!
১৭ আগস্ট ২০২২ ১৩:৫২
করোনার ধাক্কা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল। সম্প্রতি (৫ আগস্ট ২০২২) সরকার সব ধরনের জ্বালানি তেলের মূল্য ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। এ অছিলায় পরিবহনের শ্রমিকরা যে যেভাবে পারছে, যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে। মূল্যবৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত জনজীবনে ডেকে এনেছে চরম বিপর্যয়। বৈশ্বিক মহামারির কারণে এমনিতেই দেশে মৃত্যু, উৎপাদন বন্ধ, বেকারত্ব চরম আকার ধারণ করছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যসংকটসহ নানা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আমাদের দেশেও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে মানুষ নানা সমস্যায় জর্জরিত। অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন, এ সংকটাপন্ন অবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ন্যূনতম যৌক্তিকতা থাকলেও হঠাৎ করে পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন, কেরাসিনের মূল্যবৃদ্ধি দেশে নৈরাজ্য ডেকে আনবে। মানুষ আরও চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। সমাজে অশুভ শক্তির তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের অগ্রযাত্রা ও স্থিতিশীলতায় বিঘ্ন ঘটবে।
বেঁচে থাকার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা অপরিসীম। অথচ বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। কিছুদিন আগে সয়াবিন তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা আমাদেরকে একটা ধাক্কা দিয়ে গেল। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন পণ্য মজুদের খবর যেন আমাদের আরও বিস্মিত করে তোলে। বিভিন্ন প্রশ্ন মনে ঘোরপাক খায়। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানেই বাড়ে সরিষার তেল, ডাল, আটা, ময়দা, সাবান, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট ইত্যাদির দাম! যদিও কিছুদিন আগে এসবের দাম এক দফা বাড়ানো হয়েছিল। নিত্যপণ্যের এভাবে যখন-খুশি মূল্যবৃদ্ধির স্রোতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? একটি পণ্যের দাম বৃদ্ধি করলে পাশাপাশি যেন আরেকটি পণ্যের দাম বৃদ্ধির সুযোগ পেয়ে যায় সবাই! যে যেভাবে পারছে, তেমন করে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে লাভবান হচ্ছে। ফলে একশ্রেণির মানুষ আর্থিকভাবে চরম শিখরে অবস্থান করছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ মাথায় হাত দিয়ে ভাগ্যকে দোষারোপ করছে। দেশের একটি বিরাট অংশ সাধারণ মানুষ। আজ তারাই বর্তমানে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে। তাদের কথা ভাবার যেন কেউ নেই!
বাজারে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এ দাম বাড়ার একটা সহনশীয় মাত্রা তো অবশ্যই থাকা উচিত। কোনো জিনিসের দাম বাড়ানোর আগে দেখতে হবে মানুষের ক্ষমতা বা সাধ্য। দেশের একটি বিরাট সংখ্যার মানুষ দিন এনে দিন খায়। রয়েছে নিম্ন আয়ের অসংখ্য মানুষ। নিম্ন মধ্যবিত্তদের কথাও এক্ষেত্রে বাদ দেওয়া যাবে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যখন-তখন ইচ্ছেমতো বাড়ালে এবং ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেলে তা সবার জন্যই কষ্টকর। ভাবতে সত্যিই লজ্জা হয়, আমাদের দেশের বাজারগুলোতে জিনিসপত্রের দাম খুব সহজেই লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটে বেড়ায়। ব্যাপারটি এরকম যে, কেউ শুধু একটিবার যেকোনো জিনিসের দাম বাড়ানোর ইচ্ছেটা করলেই হলো, সে সহজেই তা করে ফেলতে পারে। অন্যদিকে, দাম বৃদ্ধির কৌশল হিসেবে ব্যবসায়ীদের নির্বিঘ্নে পণ্য স্টক বা সিন্ডিকেটের ব্যাপারটি তো আছেই! এমন একটি চাকাকলের মধ্যে চলছে গোটা দেশ। প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে কি বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই এখানে? কেউ কি তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে না? কঠিন শাস্তির বিধান কি করা যেতে পারে না এসব শক্তিশালী ও সুবিধাবাদী চক্রের জন্য? আমরা কি তবে ধরে নিব, এসব শক্তিশালী চক্রের কাছে সবার হাত-মুখ বাঁধা? সবাই চোখে কালো কাপড় জড়িয়ে চুপটি করে বসে আছে? খেয়ে-পরে একটুখানি বাঁচার স্বপ্ন তো সবাই দেখে! সবাই আশা করে, নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকুক। কিন্তু আমরা দেখি, বিভিন্ন সিন্ডিকেটের বেড়াজালে প্রায়ই আবদ্ধ থাকি সবাই। ভাবতে সত্যিই কষ্ট লাগে, সাধারণ মানুষের কথা ভেবে বাস্তবভিত্তিক কার্যকরী পদক্ষেপ কেন কেউ গ্রহণ করে না!
কত বাধা-বিপত্তি এবং সমস্যাকে সঙ্গী করে যে বেঁচে আছে সাধারণ মানুষ, তার হিসাব কে রাখে! সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে জানে না! গরিব এবং সাধারণ হয়ে জন্ম নেওয়াটা কি তাদের পাপ? প্রশ্ন হচ্ছে, সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করার বা ভেবে দেখার কি কেউ নেই? দেশ উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। কিন্তু এদেশের জনগণ, বিশেষ করে যারা সাধারণ মানুষ- তাদেরকে বাদ দিয়ে, তাদের সুযোগ-সুবিধা এবং সমস্যার কথা চিন্তা না করে সত্যিকার উন্নয়ন কি সম্ভব? বিশেষজ্ঞমহল মনে করেন, জনগণের উন্নয়নই দেশের উন্নয়ন। আর তাই জনগণকে সুবিধাবঞ্চিত করে, তাদের কষ্ট লাঘব না করে উন্নয়ন কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের এ দরিদ্র দেশটি আজ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। বিশ্বসমাজে আজ আমাদের দেশটির পরিচিতি ও প্রশংসায় আমরা গর্বিত হই; বুক ফুলিয়ে ভিনদেশিদের কাছে এখন বলতে পারি আমাদের দেশের কথা। দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি তাই দেশের সাধারণ মানুষদের কথা রাষ্ট্রকে অবশ্যই ভাবতে হবে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে কোনোভাবেই সমস্যার মুখে ফেলা যাবে না; অর্থনৈতিক কিংবা যেকোনো চাপে তারা যেন কোনোভাবে জর্জরিত না হয়, সেদিকে রাষ্ট্রকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। তাছাড়া দ্রব্যমূল্যের এমন লাগামহীন বৃদ্ধির অশুভ শক্তিশালী চক্রকে প্রতিহত করে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে রাষ্ট্রকে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দিন দিন বেড়েই চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম। সাধারণ মানুষের জীবন আজ বিপন্ন-বিপর্যস্ত। উলট-পালট করে দিয়েছে তাদের সহজভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। তারা কোথাও কিছু বলতে পারে না, কোনো প্রতিবাদ বা আন্দোলন করতে পারে না। নীরবে অসহায়ের মতো সবকিছু তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়। সাধারণ মানুষের সমস্যার কথাগুলো গভীরভাবে ভাবতে হবে বৈকি! তাদের সমস্যার কথা অবশ্যই রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে এবং সমস্যা সমাধানে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ মানুষ যেন সহজে দু’মুঠো খেতে পারে, তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারে- এ প্রত্যাশা কি আমরা রাষ্ট্রের কাছে করতে পারি না?
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি