ফরাসি পারফিউম হারমোনিস্ট ও একজন বাংলাদেশি উদ্যোক্তা
১৮ আগস্ট ২০২২ ১৪:৩০
মানুষের ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিগত ইমেজ, অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা আর নিজের সম্পর্কে একটা ধারনা দেওয়ার ক্ষেত্রে পারফিউম একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সময় থেকে পারফিউম বা সুগন্ধির ব্যাবহার হয়ে আসছে। সময়ের পরিক্রমায় পারফিউমের ব্যাবহার, নানা রূপ-গন্ধ নিয়ে ব্যাপক নিরীক্ষা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে কোম্পানির সংখ্যা আর বাজার। সাম্প্রতিক এক পরিসংখানে দেখা যায় বিশ্বব্যাপী পারফিউমের বাৎসরিক কেনাবেচার পরিমাণ ৪২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
পারফিউমের প্রতি আমার দুর্বলতা বহু পুরনো, সেই কলেজ জীবন খেকে। কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে পারফিউম কিনতাম। ডেনিম, জোভান আর চার্লি ছিল মধ্যবিত্তদের নাগালের মধ্যে। সে সময় ডিওর, আরমানি, শ্যানেল ফাইভ, ওপিয়াম, লুইস ভুইটন, টমি, হুগো বস, ডানহিল, জারা, কেনেথ কোল ব্ল্যাক, পোলোসহ বর্তমান সময়ের অসংখ্য ও জনপ্রিয় পারফিউম অনেকের কাছেই ছিল অজানা, ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পারফিউমের প্রতি আমার আগ্রহও বেড়েছে দিনেদিনে। বিদেশ থেকে আসার সময় ভাই, বোন বা অন্য কেউ পছন্দের জিনিসের কথা জানতে চাইলে আমি সরাসরি বলে দেই পারফিউম আর প্রিয় ব্রান্ডের কথা। বিদেশে গেলে নিজের জন্য একটা জিনিসই কিনি আর তা হলো পারফিউম।
ফরাসি পারফিউমের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। যখনই কেউ শোনে আমি প্যারিস যাচ্ছি তখনই বলে, ভাই, আমার জন্য পারফিউম নিয়ে আইসেন। ম্যাসেঞ্জারে পারফিউমের অনুরোধ তো থাকেই। যদিও অনেকবার ফ্রান্সে গিয়েছি, কিন্তু সেখানকার বিখ্যাত ‘দ্য হারমোনিস্ট’ পারফিউম দেখা বা সংগ্রহ করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে শেষবার প্যারিসে গিয়ে হারমোনিস্ট পারফিউমের প্রধান শোরুম দেখার সুযোগ আর হাতছাড়া করিনি। এই পারফিউমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একজন বাংলাদেশির নাম। তিনি হলেন এই কোম্পানির এমডি কাজী এনায়েত উল্লাহ, যিনি চার দশকের বেশি সময় ধরে প্যারিসে আছেন, নিজেকে জড়িয়েছেন ফ্রান্সকেন্দ্রীক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানামুখী ব্যাবসা, সামাজিক ও কমিউনিটিভিত্তিক কাজের সঙ্গে।
একদিন দুপুরের পর ওনার রেস্টুরেন্ট ক্যাফে দ্যু লুনায় বসে গল্প করছিলাম। কথা প্রসঙ্গে বললাম, হারমোনিস্টের শোরুম দেখিনি এখনো। সন্ধ্যায় প্যারিস থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে উনার জরুরি মিটিং ছিল। তিনি বললেন, চলেন যাই হারমোনিস্টের শোরুমে। সময় বাঁচানোর জন্য নিজের গাড়ি না নিয়ে ট্যাক্সি নিলেন। আইফেল টাওয়ারের পাশে পশ এলাকার জর্জ জিভ অ্যাভিনিউতে এর প্রধান শোরুমে ঢুকতেই হারমোনিস্ট পারফিউমের গন্ধটা নাকে লাগল। সম্পূর্ণ অচেনা গন্ধ কিন্তু একটা ভালো লাগার মোহনীয়তায় ডুবে গেলাম আমি। শোরুমের ইন্টেরিওর ডেকোরেশন, ডিসপ্লে এরিয়া, টেস্টার এর নতুনত্ব, লাইটিং, রং আর ভিডিও স্ক্রিনগুলো যেন রুচি আর শৈল্পিকতার এক অপূর্ব সম্মিলন! তিনি আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন পুরো শোরুম।
দ্যা হারমোনিস্ট নামে ফরাসি ব্রান্ডের এই পারফিউম বাজারে এসেছে এক দশকও হয়নি। এরই মধ্যে হারমোনিস্ট একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছে পারফিউম প্রেমীদের কাছে। নিজস্ব শোরুম বা ডিসপ্লে এরিয়া ছাড়া অন্য কোন কোম্পানি বা ব্রান্ডের পারফিউমের সঙ্গে এই পারফিউম রাখা হয় না। বিগত সাত বছরে ২৯টি দেশে হারমোনিস্ট এর শোরুম/ডিসপ্লে সেন্টার করা হয়েছে।
পারফিউমের দুর্গ বলে খ্যাত ফ্রান্সে বসে পারফিউমের নতুন একটা ব্র্যান্ড বাজারে আনার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে কঠিন এবং সময় ও ব্যায়সাপেক্ষ। নিজের কৌতূহল থেকেই জানতে চাইলে কাজী এনায়েত উল্লাহ বলেন, প্যারিসে বসে একটা নতুন পারফিউম তৈরি আর মেইনস্ট্রিমে জায়গা করে নেওয়া শুধু সাহসের ব্যাপার না, চ্যালেঞ্জের ব্যাপারও। আর আমি সেই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছি। এটা একটা রিস্কি ব্যাবসা। অনেক বড় একটা ইনভেস্টমেন্ট আর এই ব্যাবসার বাণিজ্যিক সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বছর পরে, কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ বছর।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আর প্রতিষ্ঠিত ব্রান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, অনেক গবেষণা আর পরিকল্পনা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হচ্ছে। আমরা টার্গেটেড কাস্টমার নিয়ে কাজ করছি। যারা সচ্ছল এবং নতুন কিছু পেতে চান তাদের জন্য এই পারফিউম। তিনি বলেন, আমরা মাত্র সাত থেকে সাড়ে সাত বছর পার করেছি। ১৫ বছরের আগে আমরা বড় রকমের কোন ব্রেকথ্রু আশা করছি না।
কাজী এনায়েত উল্লাহ বলেন, দিন দিন হারমোনিস্টের চাহিদা আর জনপ্রিয়তা একইসঙ্গে আমাদের যে বাণিজ্যিক লক্ষমাত্রা সেটাও বাড়ছে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী ফরাসি পারফিউমের যে খাতি তার সঙ্গে সঙ্গে একজন বাংলাদেশি হিসেব জড়িত থাকতে পেরে আমি গর্বিত। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ইচ্ছা আছে বাংলাদেশেও একটা শোরুম করার সেন বাংলাদেশিরাও এই পারফিউমের সুবাস নিতে পারেন, যে সুবাস ছড়াচ্ছে বিশের ২৯টি দেশে। ২০২২ সালের মধ্যে আরও ১০টি দেশে শোরুম খোলার পরিকল্পনার কথা তিনি জানান।
এতো কথা যে পারফিউম নিয়ে বলা হলো কি তার বৈশিষ্ট্য! কেন এই পারফিউম সুগন্ধীপ্রেমীদের কাছে দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে! দুস্প্রাপ্প্য সব উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয় হারমোনিস্ট পারফিউম। চীনা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, জন্মের দিন ও স্থান এসব বিবেচনা করে ক্রেতাদের পরামর্শ দেওয়া হয় কোন পারফিউম তাদের জন্য ভালো হবে। তাদের চয়েস আছে আগে থেকে তৈরি পারফিউম কেনারও। বিভিন্ন সৌরভের পারফিউম আছে সেখানে। মানুষের রুচি, ভালোলাগা, ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী পারফিউম তৈরি করে দেওয়ার ব্যাবস্থা আছে। মাটি, পানি, আগুন, কাঠ আর ধাতু এই পাঁচটি মৌলিক উপাদানের সংমিশ্রনে তৈরি হয় হারমোনিস্ট।
বর্তমান সময়ের অভিজাত ব্র্যান্ড দ্য হারমোনিস্টে রয়েছে দুই ধরনের সুগন্ধির সমাহার— মৃদু ও কড়া। সাদা রঙের পারফিউমগুলো মূলত মৃদু টোনের, এগুলোর নাম মুন আর কালো রঙের সুবাসগুলোর ধরন কড়া, এর নাম সান। এই সুগন্ধিগুলোর রয়েছে পাঁচটি করে টোন, গাইডিং ওয়াটার , মেটাল ফ্লাওয়ার, মুন গ্লোরি, গোল্ডেন উড ইত্যাদি। বিশ্বের প্রাচীনতম দর্শন কাজে লাগিয়ে এমন সব উপাদানে হারমোনিস্ট পারফিউম তৈরি করা হয়েছে, যা বিশ্বের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে খুবই পছন্দ ও আকর্ষণীয় সুগন্ধি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। ফরাসি দর্শন আর এশীয় দর্শনের মিশ্রনে তৈরি এই পারফিউমের খরচ একটু বেশি। হারমোনিস্টের দাম ২৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে গন্ধ ও পরিমাণভেদে তার মূল্য এক লাখ টাকারও বেশি।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসএসএ/এএসজি
তানবীর সিদ্দিকী ফরাসি পারফিউম হারমোনিস্ট ও একজন বাংলাদেশি উদ্যোক্তা মুক্তমত