Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিক্ষা ও মনুষ্যত্বে ব্যারাম: ঔষুধ দিবে কে

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
২২ আগস্ট ২০২২ ১৫:১৫

উন্নযনশীল আলোকিত দেশ ও মনুষ্যত্ববোধের মানুষ তৈরীর প্রধান হাতিয়ার শিক্ষা। জাতির অন্ধকার দূর করার বাহক হিসাবে কাজ করে শিক্ষা। আর সেই শিক্ষার অর্জনের মাধ্যমে মানুষ বিবেকবান হয়ে গড়ে ওঠে। দেশমাতৃকার সংকট মোকাবেলায় নিরলস পরিশ্রম করে দেশকে নিজের প্রিয় মানুষের মত আগলায় রাখে। কেমন আছে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। আমরা কি আলোকিত দেশ ও মনুষ্যত্ববোধের মানুষ তৈরী করতে পারতেছি। পৃথিবীতে এক বৃহত্তম যন্ত্র আছে সে যন্ত্রের নাম রাষ্ট্রযন্ত্র। এ যন্ত্র যদি এক কেন্দ্রীক চিন্তার পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পরিচালিত হয় তাহলে সেই যন্ত্র শুধু যন্ত্র মানব তৈরী হবে বাস্তবে মনুষ্যত্ববোধের মানুষ তৈরী হবে না। তাহলে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসে যে রাষ্ট্র স্বাধীন হওয়ার জন্য এক সাগর রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করলো সেই রাষ্ট্রের শিক্ষা কি মৌলিক অধিকার হিসাবে গড়ে ওঠেছে। প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে না শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসাবে আমরা গড়ে উঠাতে পারিনি কারণ শহর থেকে গ্রাম ব্যাঙের ছাতার মত বাণিজ্যিক ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেখানে টাকার বিনিময়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। অর্থাৎ বাজারের পণ্যের মত শিক্ষা হয়েছে। আবার শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন এক বাজার তৈরী হয়েছে। সে বাজারের নাম চাকরির বাজার। সৎ সাহস নিয়ে রাষ্ট্র কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারে শিক্ষা শেষে কাজ দিব? না কখনও বলতে পারে নি ভবিষ্যৎ বলার আগ্রহ কতটুকু আছে তা আমার জানা নেই। রাষ্ট্র আমাদের কোন শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষা দিচ্ছে? শিক্ষার উদ্দেশ্য কি সার্টিফিকেট তৈরীর মাধ্যমে নিত্য নতুন বেকার করা? যত ‍দিন যাচ্ছে ততই কেন মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে? আর শিক্ষা গুরুর প্রতি কেন শ্রদ্ধা কমে যাচ্ছে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতির আলোকবর্তিকা কিন্ত সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন শিক্ষক নির্যাতনের খবর আসে, গণরুমে ও হল রুমে শিক্ষার্থী নির্যাতনে শিক্ষার্থীদের আর্তনাদে উদ্বিগ্ন হতে তখন রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার জায়গায় বড় হয়ে উঠে। সম্প্রতি গত কয়েক দিনে দেশের নামকরা তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দেশের গণমাধ্যমের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নারী শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি করা হয়েছে। তাঁকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। আশ্চর্যজনক ভাবে বলতে হয় শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করা হয়েছে তা ঐ ক্যাম্পাসে প্রত্যেকটি মানুষ জানে অথচ অপরাধী গ্রেফতার করা হচ্ছিলো না। শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে রাজপথে এসে দাবি জানায় অপরাধী গ্রেফতার করার জন্য। একবার ভাবুন তো অপরাধী সবার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ গ্রেফতার করা হচ্ছে না। এর কারণ কি? নারী ও শিক্ষা পণ্য হিসাবে থাকবে? “তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি দেবো ।” এ কথা বলে গেছেন বিশ্ব বিখ্যাত সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। তিনি জাতিকে শিক্ষিত করতে শিক্ষিত মা’এর প্রয়োজনবোধ দেখিয়েছেন। ঠিক বলছেন তবে শিক্ষার আয়োজন যদি থাকে সংকট তাহলে শিক্ষিত জাতি কী করে তৈরী হবে? শিক্ষায় জাতির মেরুদণ্ড।তবে জাতির মেরুদণ্ড ভাঙতে শুরু করেছিল যখন কোভিড ১৯-এর কারণে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় দুই বছর অচল অবস্থায় ছিল।

শিক্ষামন্ত্রণালয় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালু রাখার জন্য অনলাইন ভিত্তিক “আমার ঘরে, আমার স্কুল” চালু রেখেছিল । কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার যে নিদারুন সংকট তা স্পষ্ট হয়েছিল করোনা কালীন সময়ে সাধারণ মানুষের ঘরে খাবারের সংকট ছিল তীব্র। যার ফলে আমরা দেখেছি ক্ষুধায় জ্বালায় মানুষের হাহাকার। কর্মহীন, অসহায়, ছিন্নমূল মানুষ জীবন যাপন থমকে যায়। ওই সব অসহায় মানুষের সন্তান-সন্ততি শিক্ষার মধ্যে থাকা যেন আকাশ কুসুম চিন্তা করা। গ্রামে গ্রামে করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক। তার মধ্যে পেটের দায়ে বইপুস্তক রেখে লকডাউনে ভয়কে জয় করে বেড়িয়ে গিয়েছিল পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য কাজের সন্ধানে। যার ফলে শিক্ষার আয়োজন থেকে শিক্ষার্থীরা ছিটকে পড়ে। এর প্রধান কারণ হিসাবে ছিল ইন্টারনেটের ডিভাইস কিংবা টেলিভিশনের ক্রয় করার আর্থিক সংকট যার কারণে গ্রামের অধিকাংশ লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়ে যায়।গণমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আর কখনোই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরতে পারবে না। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরার দায়িত্ব কার? জাতির শিক্ষার মেরুদণ্ড ঝাঁকুনি কবে বন্ধ হবে? অতীতে ধারাবাহিক ভাবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীরণের কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতির দুর্দশার চিত্র করোনাকালীন সময়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ফলে যাদের টাকা ছিল তারাই তাদের সন্তান-সন্ততিদের লেখাপড়া করতে পেরেছেন। অপর দিকে যাদের টাকা নেই। তারা এন্ড্রয়েড ফোন অথবা হোম টিউটর রেখে পড়াতে পারে নি তাদের সন্তানদের। অনেকে গেছে কলে কারখানায় শিশু শ্রম হিসাবে। আবার অনেকে বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে আজীবন কষ্টের ঘানি টানবে।

এমন ভয়াবহ পরিস্থিতে শিক্ষাবীদ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ শিক্ষানুরাগী মানুষের উদ্বিগ্নতা বেড়ে গেছে। সবাই মতামত প্রকাশ করেছিল স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে। অন্য দিকে রাজপথে শিক্ষার্থীদের প্রতীকী ক্লাস ও আন্দোলন চলছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে। শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে নতুন স্লোগান তৈরী হয় “সব যখন সচল তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন অচল? এমন স্লোগানের মুখে রাষ্ট্র সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শর্ত সাপেক্ষে খুলে দিল রাষ্ট্র। তারপর একের পর এক খবর আসতে শুরু করে পত্র পত্রিকায় শুরু করে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি সংখ্যা খুবেই কম। তবে আশার আলোর কথা করোনা ভাইরাসের দাপট যখন কমতে শুরু করেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়েছে।

কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে গত ৯ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যা জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থাকবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বাজেটে প্রাধান্য পেয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কৃষি খাত, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ ও কর্মসংস্থানসহ বেশ কিছু খাত। তবে এবারের সবচেয়ে বেশি চিন্তার বিষয় শিক্ষাখাত নিয়ে বাজেট নিয়ে জাতীয় সংসদেও শিক্ষাখাত নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হয়েছিল। বাজেট প্রস্তাবনার আগে শিক্ষামন্ত্রী তার বক্তব্যে ইউনেস্কো’র সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষাখাতে জিডিপি’র ৬ ভাগে বরাদ্দের আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আকাঙ্খা শুধু আকাঙ্খায় রয়ে গেল। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের প্রায় ১২০ মিনিট পরে শিক্ষাখাতে বাজেট প্রস্তাবিত হয়, তাতে ২০২২-২৩ সালের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট বাজেটের ১১.৯৪ শতাংশ, যা গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট বাজেটের ১১.৯১ শতাংশ । এবারের শিক্ষা বাজেট গত অর্থবছরের তুলনায় টাকার অঙ্কে মোট ৯ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা বেড়েছে, যা আনুপাতিক হারে ০.৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২-২৩ সালের এই বাজেট ২০১৬-১৭ বাজেটের তুলনায় ২.৪৮ শতাংশ ও ২০১৭-১৮ বাজেটের তুলনায় ০.৮০ শতাংশ কমেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ২০২২-২৩ সালে ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য এবার ২০২২-২৩ সালের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য এবার ২০২২-২৩ সালের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। তা গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে মাদরাসা ও কারিগরি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১.৫৯ শতাংশ এবং মোট শিক্ষা বাজেটের ১২ শতাংশ, যা গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১.৫১ শতাংশ এবং মোট শিক্ষা বাজেটের ১২.৭২ শতাংশ। অর্থাৎ করোনা পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার নানা গালগল্প শুনে এসেছি কিন্তু বাস্তবে চলতি শিক্ষা বাজেটে কোন মৌলিক পরিবর্তনই লক্ষিত হয়নি। বরং শিক্ষা খাত অবহেলিতই রয়ে গেল। প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে, তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অতি নগন্য। বিগত কয়েক দশক ধরেই ১২% এর কাছাকাছিই ছিল এই বরাদ্দ, তাই এই বছরের বাজেটেও শিক্ষাখাতে সনাতন পদ্ধতিতে শিক্ষা বাজেট হয়েছে। শিক্ষা বাজেটে ছাত্রসমাজের কবে স্বস্তির নিঃশ্বাস মিলবে? শিক্ষিত জাতি কেমন করে তৈরী হবে? চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে দক্ষ ও সৃজনশীল মানবসম্পদ তৈরীর জন্য শিক্ষায় পর্যাপ্ত বাজেট অপরিহার্য। ফলে রাষ্ট্রের বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া উচিত বিজ্ঞান শিক্ষার প্রচার ও প্রসার ঘটিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত, নৈতিক শিক্ষায় বলীয়ান, দক্ষ, কর্মঠ, সৃজনশীল, প্রগতিশীল ও উদ্ভাবনী চেতনায় জনবল তৈরী করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। শিক্ষা ও মনুষ্যত্বে যে ব্যারাম ধরেছে তার ঔষুধ হিসাবে শিক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ শিক্ষা ও মনুষ্যত্বে ব্যারাম: ঔষুধ দিবে কে


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর