স্নায়ুযুদ্ধ থেকে বিশ্বযুদ্ধে: বিশ্বশান্তি হুমকিতে
২২ আগস্ট ২০২২ ১৬:১৭
স্নায়ুযুদ্ধ থেকে বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে পারে; এ কথা সবার মুখে মুখে। পূর্ব-পশ্চিম ডিভাইড এখন আর কোনো তাত্ত্বিক বিমূর্ত ধারণা নয়। স্নায়ুযুদ্ধোত্তর পশ্চিমা ন্যাটোর সামরিক আগ্রাসন নতুন করে এই বিভক্তিকে তুলে ধরেছে। ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে একটি একচেটিয়া বিশ্ববাণিজ্য ও পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা চালু হওয়ার আগেই এশিয়া, আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলোতে ইউরোপীয়দের অর্থনৈতিক উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। সেই থেকে শুরু হওয়া সম্পদ লুণ্ঠনের প্রক্রিয়া, অস্থিতিশীলতা এবং কৃত্রিম নিরাপত্তাহীনতা এখনো চালু রয়েছে। অষ্টাদশ শতকে মধ্যভাগে ইউরোপ এবং ভারতের মুঘল সাম্রাজ্য অথবা উসমানীয় খেলাফতের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে কারা বেশি এগিয়ে ছিল তা নিরূপণ করা খুব কঠিন কিছু নয়। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরাই সাক্ষ্য দিয়েছেন, সে সময় ভারতে অতি দারিদ্র্যের হার অনেক কম ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ফলাফল এবং পরিবর্তিত নতুন বিশ্বব্যবস্থার রূপরেখা ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন নয়া অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক আধিপত্য বাকি বিশ্বের উপর বহাল রাখার সর্বাত্মক প্রয়াস। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্বের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নস্যাৎ করে বিগত শতকের শেষদিকে বিশ্বকে একটি একচেটিয়া ইউনিপোলার বিশ্বে পরিনত করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমা একচেটিয়া আধিপত্য বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর সামরিক জোট ভেঙে গেলেও পশ্চিমা ন্যাটো জোট আরো সম্প্রসারিত, শক্তিশালী ও আগ্রাসি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
জ্বালানি নিরাপত্তাকে টার্গেট করে নানা মিথ্যা অজুহাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে একের পর এক যুদ্ধ ও সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে মূলত পুরো বিশ্বকেই অস্থিতিশীল করে তুলেছে। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য ন্যাটো সামরিক জোট দায়ী। রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি এড়াতে রাশিয়ার প্রতিবেশী ইউরোপীয় দেশগুলোকে ন্যাটোভুক্ত করাসহ ইউরোপ-আমেরিকার উস্কানিমূলক তৎপরতাকে রাশিয়া বরাবরই কঠোর নজরদারিতে রেখেছে। বিশেষত ইউক্রেনে ইসরাইলী জায়নবাদ ও পশ্চিমা শাসক বসিয়ে রাশিয়ার জন্য একটি বড় হুমকি সৃষ্টির পশ্চিমা তৎপরতার জবাবে ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের দক্ষিশাংশের ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। রাশিয়ার এই ভূমিকার বার্তা বুঝতে ব্যর্থ হয়ে পশ্চিমা ইউক্রেনীয় শাসকরা রাশিয়ার জন্য উস্কানিমূলক ও হুমকিসুলভ ভূমিকা অব্যাহত রাখায় ইউক্রেনে রাশিয়ান সামরিক অভিযান অনেকটা অনিবার্য হয়ে উঠে। ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনা অভিযানের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো ও মার্কিন নেতারা ইউক্রেনের পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়ানোর ‘লিপ সার্ভিস’ দিলেও তারা এখন ইউক্রেনের পতনের নীরব দর্শক হয়ে দূর থেকে হুমকি-ধামকি ও নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পাশাপাশি ইউক্রেনে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে শুধু যুদ্ধকে প্রলম্বিত করতে ভূমিকা পালন করছে। তাদের এই ভূমিকার কারণে উভয়পক্ষে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ালেও ইউক্রেনের আত্মরক্ষায় তেমন কোনো কাজে আসছে না। ইউক্রেনের স্বাধীনতা, ইউক্রেনীয়দের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে পশ্চিমাদের তেমন কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
ইউক্রেনে একের পর এক নতুন নতুন এলাকা রাশিয়ান সেনারা দখল করে নিচ্ছে। সেখানে পশ্চিমারা গ্রহণযোগ্য কূটনৈতিক-রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টার বদলে যুদ্ধকে প্রলম্বিত করার জন্য রসদ যোগান দিচ্ছে। ইরাক-আফগান রনাঙ্গণে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও মার্কিনীরা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে। তবে বিশ্বের শতকোটি মানুষের সম্পদ লুন্ঠন করা টাকায় অস্ত্র, যুদ্ধবিমান কিনে পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাস্ট্র্রিয়াল কমপ্লেক্স আর ওয়ার কণ্ট্রাক্টরদের কর্পোরেট মুনাফা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সেই সত্তরের দশকে মার্কিন ডিপ্লোম্যাট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সারাবিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখতে হলে বিশ্বের জ্বালানি সম্পদ তথা পেট্টোলিয়াম, খাদ্য নিরাপত্তা এবং বাণিজ্য ব্যবস্থাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার উপর জোর দিয়েছিলেন। তবে কিসিঞ্জারের বক্তব্যের অনেক আগে থেকেই পশ্চিমা নীতিনির্ধারকরা পেট্রোলিয়াম ও বাণিজ্য আধিপত্য নিরঙ্কুশ রাখতে সচেষ্ট ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নয়া বিশ্বব্যবস্থায় বৃটিশ পাউন্ডের আধিপত্য খর্ব হয়ে মার্কিন ডলারের যুগ শুরু হয়। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের সাথে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ডলার ও সুইফট কোডের অভিন্ন ব্যবস্থা বিশ্বকে ইউনিপোলার বিশ্বে পরিণত করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রথম ও একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এর অভাবনীয় ধ্বংস ক্ষমতা প্রমান করে সামরিক প্রতিযোগিতায় মার্কিনীরা একধাপ এগিয়ে থাকলেও আয়তন ও প্রভাব বলয়ে অনেক বড় দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমানবিক সমরাস্ত্র উৎপাদন, আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিযোগিতার পাল্লা নিজেদের পক্ষ ভারী করেই চারদশক ধরে চলা স্নায়ুযুদ্ধে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। সামরিক ভারসাম্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে।
গত তিন দশকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করে ইরাক-আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আগ্রাসন ও প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে সামরিক ও কৌশলগতভাবে পরাজিত হওয়ার পরও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এখনো টিকে থাকার মূল শক্তি হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন ডলারের আধিপত্য। যে মার্কিন ডলার নির্ভরতা ও নিশ্চয়তার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, গত তিন দশকে মার্কিন শাসকরা তার বিশ্বস্ততা, আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতাকে নষ্ট করে দিয়েছে। ইরাক, আফগানিস্তান, ইরান, সিরিয়া, রাশিয়া, ভেনিজুয়েলাসহ বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক-কৌশলগত কারণে এসব দেশের উপর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা সম্পদ আটক এবং সুইফ্ট কোডের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে মার্কিনিদের একচেটিয়া মনোপলি ব্যবস্থায় পরিনত করে তার উপর মানুষের আস্থা ও নির্ভরতাকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই কোনো প্রকার কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়াই রাশিয়ার উপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং রাশিয়ার সম্পদ আটকে দেয়ার পশ্চিমা সিদ্ধান্ত বিষয়টিকে নতুনভাবে বিশ্বের সামনে তুলে আনার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
বিশ্বের শত শত কোটি মানুষের মৌলিক স্বার্থ এবং হাজার বছরের সভ্যতার নৈতিক ভিত্তিকে অগ্রাহ্য করে কয়েক মিলিয়ন জায়নবাদী ইহুদির ফ্যাসিবাদী খায়েশ ও নীলনক্সা চরিতার্থ করতেই মার্কিন শাসকশ্রেণীকে বেশি তৎপর থাকতে দেখা যায়। ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমির জন্য আমেরিকার জাতিগুলো পশ্চিমাদের বিশ্ববাসী দায়ী করছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর বেশিরভাগ দেশ ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে দায়ী করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এপ্রিলে ইউক্রেনের বুচা শহরে রাশিয়ান বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে রাশিয়াকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্যপদ থেকে বহিষ্কারের প্রশ্নে ভোটাভুটিতে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল অঞ্চল দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত ৮টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলো মার্কিন প্রভাব বলয়ে থাকা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ এই ভোটাভুটিতে মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে ভোটদান থেকে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে একটি নতুন বার্তা দিয়েছে। চীন-রাশিয়ার পাশে হোক কিংবা দক্ষিণ আমেরিকা বা ল্যাটিন আমেরিকা হোক অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও উন্নয়নশীল দেশগুলো পশ্চিমা সব প্রলোভন ও ভীতি ডিঙ্গিয়ে একচেটিয়া আধিপত্যবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন চায়। একদিকে রাশিয়া অন্যদিকে চীনের দিকে আগ্রাসি থাবা বিস্তারের হুমকি দিয়ে মূলত আরেকটি মহাযুদ্ধের সূচনা করতে চাচ্ছে। চীন-ভারত-পাকিস্তান ডিস্কর্ট ভুলে গিয়ে ব্রিক্স, সাংহাই কোপারেশনের আওতায় রাশিয়া, ইরান-তুরস্কসহ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও ল্যটিন আমেরিকার দেশগুলোকে একটি আস্থাপূর্ণ ও ভারসাম্যমূলক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে জোরালো, ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা নিতে হবে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মুক্তমত রনি অধিকারী স্নায়ুযুদ্ধ থেকে বিশ্বযুদ্ধে: বিশ্বশান্তি হুমকিতে