Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দেড় শতাব্দি পেরিয়ে আসা চা শিল্প

রেদ্বওয়ান মাহমুদ
২২ আগস্ট ২০২২ ১৬:৪৫

সময়কাল ১৯১৯। বাংলার রাষ্ট্র সীমানার বাইরে থাকা সিলেট তখনও আসামের সঙ্গে সংযুক্ত। সে বার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট ভ্রমণে এসে লিখেছিলেন ‘মমতাবিহীন কালস্রোতে/ বাংলার রাষ্ট্র সীমা হোতে/ নির্বাসিতা তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি…।’

সিলেটের সৌন্দর্য কবির মনে কতটা দাগ কেটেছিল তা এই কয়েক পংক্তিতেই সহজে অনুমেয়। সিলেটের সৌন্দর্য কিংবা বিশেষত্বের প্রশ্নে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তর ‘চা’। সিলেটকে আলাদা পরিচয়ে বিশ্বমন্ডলে পরিচিতি এনে দিয়েছে, এমন তালিকার সর্বাগ্রেও চা-এর নাম আসাটাই যৌক্তিক। দেশ তথা বহির্বিশ্বে সিলেটের নাম-পরিচয় দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ হিসেবে। ১৬৮ বছর আগে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়েছিল এই সিলেটেরই মালনীছড়া চা বাগানের হাত ধরে। দেশের মোট চা বাগানের ৯০ শতাংশেরও অধিক সিলেটে অবস্থিত। ফলে সিলেট এবং চা এই দুই শব্দকে আলাদা করার সুযোগ নেই।

বিজ্ঞাপন

কাগজ-কলমের হিসেবে চায়ের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হওয়ার দেড় শতাব্দি পেরিয়েছে। নানা সংকট মোকাবেলা করে দেশের অর্থনীতিতে চা শিল্প অধিষ্ঠিত হয়েছে অনন্য জায়গায়। কিন্তু এই শিল্পের সাথে জড়িত চা শ্রমিকদের জীবনমানে আদতে কোন পরিবর্তন হয়নি। নামমাত্র যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে সামগ্রিক প্রেক্ষাপট তা ম্লান করে দিয়েছে পুরোটাই। চা শিল্পের বার্ষিক বাজার মূল্য মোট জিডিপির এক শতাংশের সমান। যাদের পিঠে চড়ে এই শিল্পের ভার হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে গেল, শতাব্দির বদলেও তাদের বঞ্চনার কাহিনী পিছু ছাড়লো না। এই বিষয়টি আমাদের জন্য কতই না লজ্জার! প্রতিদিন ধূমায়িত চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমরা যখন কাজের গভীর মনোযোগে ডুবে যাই, তখন আড়ালে পড়ে যায় এর পেছনে শ্রম, মেধা আর ঘাম ঝরানো মানুষগুলোর ত্যাগের গল্প।

বিজ্ঞাপন

সিলেটের খাদিম চা বাগান ঘেঁষে আবাসস্থল হওয়ায় দিনভর চা শ্রমিকদের খাটুনির দৃশ্য দেখে দেখে আমরা অভ্যস্ত। তাদের জীবনপ্রণালি অনেকটা অস্বাভাবিক। সাজ সকালে যে কর্মব্যস্ততা শুরু হয় দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত অবিরামভাবে তা চলে। চা শ্রমিকরা মৌলিক চাহিদা নিবারণের নামমাত্র সুযোগ পেলেও প্রকৃত অর্থে তারা বঞ্চিতই থাকেন। দেশে চলমান দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাস্তবতায় চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি যে কতটা অযৌক্তিক এবং যৎসামান্য তা শ্রমিকদের জীবন প্রবাহের কাছে যাওয়া ছাড়া আঁচ করা সম্ভবপর নয়। বুরজান চা বাগানের শ্রমিক পঞ্চাশোর্ধ কাকলির সাথে কথা হয় সেদিন। তিনি বলেন, ‘রোজ যে ১২০ টাকা পাই তা দিয়ে তো পরিবারের সবার পাতে ডাল ভাত জুটানোও সম্ভব হয় না। অসুস্থ হলে ভালো চিকিৎসা করানো আমাদের কাছে কল্পনার মত। সন্তানদের ভালোমত লেখাপড়া করাবো, ভালো খাবার-পোষণ যে দেবো মজুরির টাকায় সেই সামর্থ্য কই।’

চা শ্রমিকদের প্রত্যেকের জীবনেই এমন আলাদা আলাদা গল্প রয়েছে। কেউ কাকলির মত, কেউ আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েই জীবন এগিয়ে নিচ্ছেন।

সম্প্রতি মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে তাদের যে আন্দোলন তা সময়োপযোগী বটে। বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং তাদের দাবির বিষয়টি এখনই যথাযথভাবে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন। বৈশ্বিক নানা দুর্যোগ যখন আন্তর্জাতিক বাজারে শিল্পখাতগুলোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে তখন চা শিল্পকে রক্ষা করতে শ্রমিকদের প্রতি মানবিক আচরণ প্রদর্শন অতীব জরুরি।

চা বাগানে প্রতিদিন পাতার উপর পাতা গজিয়ে কুঁড়ি নষ্ট হচ্ছে। বিবর্ণ রুপধারণ করেছে সবুজ পাতাগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড় লাখেরও বেশি শ্রমিকের কর্মবিরতিতে দৈনিক ২০ কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের চা পাতা নষ্ট হচ্ছে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতায় আমাদের প্রত্যাশা, স্থবির হয়ে যাওয়া এই কর্মযজ্ঞে ফের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরুক। সমঝোতার মাধ্যমে শ্রমিকদের পদচারণায় প্রাণ ফিরে পাক চা বাগানগুলো। এগিয়ে যাক চা শিল্প, সমৃদ্ধ হোক আমাদের অর্থনীতি।

লেখক : কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

দেড় শতাব্দি পেরিয়ে আসা চা শিল্প মুক্তমত রেদ্বওয়ান মাহমুদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর