Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেমন কাটে চা শ্রমিকদের জীবন

জাফর হোসেন জাকির
২৩ আগস্ট ২০২২ ২১:০৪

কারো সকাল শুরু হয় চা পানের মধ্য দিয়ে; অথবা কারো অফিস শুরু হয় চায়ের কাপে চুমু দিয়ে; কিংবা সকাল থেকে একাধার কাজ করার জন্য শরীর ক্লান্ত হয়ে যায় ফলে শরীরকে কাজে ফেরানোর জন্য, সতেজ করার জন্য চায়ের আশ্রয় নিয়ে থাকি। এতো গেল কাজের কথা! অবসর কিংবা কর্মবিরতির সময়টা কাটানোর জন্য চায়ের কোনো বিকল্প কি আমরা এখনো খুঁজে পেয়েছি? না। পাইনি। রাজনৈতিক আড্ডা থেকে শুরু করে প্রিয়জনের সাথে অবসর সময় কাটানোর কথা চা ছাড়া জমেই ওঠে না। শহরের হোটেল থেকে শুরু করে গ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলে রাতে আধারে মোমবাতি জ্বালানো দোকানসহ সর্বত্র চা পাওয়া যায়। কারণ চা সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পানীয়রূপে পরিনত হয়েছে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যারা এই চা উৎপাদন করে সারাদেশের মানুষে শরীরে তৃপ্তি জোগায়, সতেজ করে তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা কি সতেজ আছে? তাঁরা যে বেতন পান তাতে কি তাঁদের সংসারের খরচ থেকে শুরু করে চিকিৎসা, বস্ত্র এবং সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে তৃপ্তি পান? নিঃসন্দেহে উত্তর না। না বলেই চা শ্রমিকদের চা-বাগান থেকে বেড় হয়ে রাজপথে আন্দোলনে নামতে দেখা যায়, যাচ্ছে। এই আন্দোলন রাষ্ট্র দখলের আন্দোলন নয়; এই আন্দোলন বেঁচে থাকার আন্দোলন, খেয়ে পড়ে বাঁচার আন্দোলন, নিজের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন। কোনো বিবেকবান মানুষ এমন আন্দোলনে সংগতি না জানিয়ে চুপ থাকতে পারে না, পারেনি কখনো।

বিজ্ঞাপন

চা মৌসুমী অঞ্চলের পার্বত্য ও উচ্চভূমির ফসল। একপ্রকার চিরহরিৎ বৃক্ষের পাতা শুকিয়ে চা প্রস্তুত করা হয়। চীন দেশই চায়ের আদি জন্মভূমি। বর্তমানে এটি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পানীয়রূপে গণ্য করা হয়।

১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। আর ভারতবর্ষে এর চাষ শুরু হয় ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা সিলেটে সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়। এরপর ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় শুরু হয় বাণিজ্যিক চা-চাষ। বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধনকৃত মোট চা-বাগানের সংখ্যা ১৬৭ টি। নিবন্ধন ছাড়াও আরো অনেক চা-বাগান বিদ্যমান। গত ৯ আগস্ট দেশের ২৪১ টি চা-বাগানের দেড় লাখের বেশি শ্রমিক কর্মবিরতির মধ্য দিয়ে আন্দোলনে নামে। কেন কিসের জন্য তাঁদের আন্দোলন? আন্দোলন তাঁদের বেতন বৃদ্ধির জন্য। কত বেতন পায় যার জন্য আন্দোলনে নামলো? দৈনিক সর্বোচ্চ মজুরি ১২০ টাকা। সপ্তাহে তিন কেজি আটা পায় দুই টাকা কেজি দরে।

পরিবারে যদি ছয়জন সদস্য থাকে তবে তিন কেজি আটা কতদিন খেতে পারবে? আর ১২০ টাকা দিয়ে কি পরিমাণ চাল, ডাল, তেল-সহ নিত্যপ্রযোজনীয় দ্রব্য কিনতে পারবে? চিকিৎসা আর শিক্ষা ফ্রি পাওয়ার কথা। তবে সেগুলো কি তাঁদের কপালে জুটে? না জুটলে চা শ্রমিকেরা তাঁদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা সহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটাবেন কেমন করে? এসব প্রশ্নের উত্তর জেনে বুঝে চা-বাগানের শ্রমিকেরা বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনে নামে। তাঁদের দাবি পরিস্কার। দৈনিক বেতন ৩০০ টাকা করে দিতে হবে।

দুই বছর অন্তর চা বাগানের শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির নীতি আছে। কিন্তু ২০১৮ সালের পর আর মজুরি বাড়ানো হয়নি। দিনে দিনে লাফিয়ে লাফিয়ে সমস্ত জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। যে পরিমাণে তাঁরা মজুরি পেয়ে আসছেন তাতে তাঁদের বেঁচে থাকাই মুশকিল। সন্তানদের পঞ্চম শ্র্র্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ থাকলেও পরবর্তী শ্রেণিতে আর পড়াতে পারেন না। কারণ এক সন্তানকে পড়াতে গেলে এনজিওর কাছে ঋণ নিতে হয়। কিন্তু বাকি সন্তানগুলো আর পড়ার সুযোগ পায় না। দৈনিক যে মজুরি তাতে ঋণ পরিশোধ করবেন কেমন করে। ফলে তাঁদের সন্তানেরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সকলের চোখের দৃষ্টির সামন দিয়েই। শিক্ষা যেখানে মৌলিক অধিকার সেখানে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার দায়ভার কি রাষ্ট্র এড়াতে পারেন? পঞ্চম শ্রেণি পাস করা একজন ছেলে কিংবা মেয়ের জীবন কেমন হবে এবং সে কোনো চাকরিতে সুযোগ পাবেন কি না উত্তরটা রাষ্ট্রের পরিস্কারভাবে জানা আছে। কারণ এসব প্রশ্ন তাঁদেরেই তৈরি। চা শ্রমিকদের সন্তানের জীবনের দিকে তাকালেই বিবেকবোধযুক্ত মানুষ স্বচ্ছ কাচের মতো তাঁদের ভবিষৎ দেখতে পাবেন। আর তা হলো বাবা মায়ের মতো চা বাগানের শ্রমিক হওয়া। চা বাগানের শ্রমিক দয়াল আমলিক গণমাধ্যমকে বলেন,“আমরা মাছ মাংস বছরে এক-দুইবার খেতে পারি কোনো উৎসবের সময়। আর সারা বছর ঘরের পাশে লাগানো শাক সবজি দিয়ে চালিয়ে নিই। আর সব বেলায় খেতে পাই না।”

বিজ্ঞাপন

এক পর্যায়ে তিনি বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলেন,“বিশ্বাস করুন আমরা না খেয়ে থাকি। আমাদের সন্তানদের পড়াশুনা করাতে পারি না। এনজিওর যে স্কুল এখানে আছে তাতে পঞ্চম শ্রেণির পর আর পড়ানো হয় না।”

চা শ্রমিকদের শ্রম যারা শোষণ করে তাঁদের প্রতিবার খাবারের প্লেটে কত রকমের মাংস আর অন্যান্য তরকারি থাকে তার মেনু দেখলে চোখ ক্রান্ত হয়ে যায়। অপরদিকে চা শ্রমিকেরা বছরে দুইবার মাংস খেতে পায় তাও আবার বিশেষ দিন ছাড়া জুটে না। বাড়ির আশপাশে চাষ করা সবজি খেয়েই তাঁদের দিন পার করতে হয়। কোনো কোনো দিন তাঁদের মুখে খাবার ওঠে না। ফলে দিনে দিনে চা শ্রমিকের পরিবার পুষ্টিহীনতায় ভুগে। পুষ্টিহীনতার কারণে সন্তানদের শারীরিক থেকে মানসিক বিকাশে বাঁধাগ্রস্থ হয়।

চা-বাগানের শ্রমিকদের নতুন প্রজন্ম যেন চা গাছে পাতা কুড়ানোর জন্যই পৃথিবীতে আসে। তাঁদের অগ্রগতি থেকে প্রগতি কিছুই নাই। যা আছে তা খুবই নগন্য। এভাবে কত দিন চলবে? অনেকদিন ধরেই তো চলে আসতেছে। তবে কি চা শ্রমিকদের জীবনের কোনো উন্নতি হবে না? তাঁরা কি জীবনকে জীবনের মতো গড়ে তুলতে পারবেন না? গতানুগতিকভাবে কি তাঁরা শোষণের জাতাঁকলে পিষ্ট হতেই থাকবেন?

দেশের ১৬২টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৭টিই রয়েছে সিলেট বিভাগে এবং এখানে কর্মরত চা-জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। স্বল্পমজুরি ও সব ধরনের নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত থাকায় জীবনমানের সব সূচকেই পিছিয়ে রয়েছেন চা শ্রমিকরা। প্রতি বছর নতুন মজুরি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও বিগত ১৯ মাসেও নতুন মজুরি নির্ধারণ হয়নি চা শ্রমিকদের। সরকার ও বাগান কর্তৃপক্ষ শুধু আশ্বাস দিয়ে এতদিন পার করেছে। বস্তুত এ অঞ্চলে চা শিল্পের শুরু থেকেই বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছেন শ্রমিকরা। দূরদূরান্ত থেকে নিয়ে আসা শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমে বুনো টিলায় চা বাগানগুলো গড়ে উঠলেও শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি মেলেনি তাঁদের। দেশ স্বাধীনের একান্ন বছরে এসেও চা শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাদের ঘরবাড়ি খুবই নিম্নমানের। কারোরই ভূমির অধিকার নেই। তাদের খাটানো হয় অত্যধিক; কিন্তু মজুরি দেওয়া হয় খুবই সামান্য। অশিক্ষা, অপুষ্টি, দারিদ্র্য এসবের সঙ্গে তাদের নিত্য বসবাস।

দৈনিক মজুরি ১২০ টাকার সাথে ১৫ কিংবা ২০ টাকা যুক্ত করলে অঙ্কের যে পরিমাণ দাঁড়ায় তা দিয়ে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির লাগামহীন ঘোড়াকে ছুঁয়ে দেখাও অসম্ভব প্রায়। এই সমস্যা শুধুমাত্র চা শ্রমিকদের বললে নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে দরিদ্র, হতদরিদ্র ও কম আয়ের সাধারণ মানুষের প্রতি অবিচার করা হবে।

চা-বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের সকল ন্যায্য দাবি মালিক ও সরকার উভয়কে সম্মিলিতভাবে আলোচনার মাধ্যমে মেনে নিতে হবে। শুধু মেনে নিলেই হবে না তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। চা শ্রমিকসহ দেশের সকল শ্রমিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, কর্মস্থলে নিরাপত্তাসহ জীবনমান উন্নয়নে সকল পদক্ষেপ গ্রহন করে তার বাস্তব রূপ দিতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

কেমন কাটে চা শ্রমিকদের জীবন জাফর হোসেন জাকির মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর