Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাটশিল্প ও পাটশিল্পের সম্ভাবনা

রিফাত আমিন রিয়ন
২৪ আগস্ট ২০২২ ১১:৪৩

বাংলাদেশে বিরাজ করছে তীব্র তাপদাহ। আকাশে জ্বলজ্বল করছে সূর্য। মনে হচ্ছে জ্বলন্ত একটা অগ্নিকুণ্ড মাথার ঠিক উপরেই। মানুষ ঘনঘন আকাশপানে তাকাচ্ছে। কখন নামবে স্বস্তির বৃষ্টি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। না বৃষ্টি, না শীতল পরিবেশ। অনেকেই এর কারণ খুঁজছেন। কেন হচ্ছে না বৃষ্টি। জানা গেছে, এমন তাপদাহ শুধু বাংলাদেশেই নয়, প্রায় অর্ধেক পৃথিবীজুড়েই বিরাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যেন কারখানার ব্রয়লার চেম্বারের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দিনে দিনে। তীব্র তাপদাহ এবং বৃষ্টি না হওয়ার কারণে পাট নিয়ে বিপাকে পরেছেন কৃষকরা।

জেনে রাখা ভালো, পাট একটি বর্ষাকালীন ফসল। এর জীবনকাল ১০০ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত। চৈত্র-বৈশাখ থেকে আষাঢ়-শ্রাবণ। পাট বৃষ্টি নির্ভর ফসল। বায়ুর আদ্রতা ৬০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ এর পছন্দ। পাট চাষে কোনো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। গড় ফলন হেক্টর প্রতি প্রায় দুই টন। পাটের আঁশ নরম উজ্জ্বল চকচকে এবং ১ থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। তবে একক আঁশ কোষ ২ থেকে ৬ মিলি মিটার লম্বা এবং ১৭ থেকে ২০ মাইক্রণ মোট হয়। পাটের আঁশ প্রধানত সেলুলোজ এবং লিগনিন দ্বারা গঠিত। সাধারণত পাট গাছ জৈব প্রক্রিয়ায় পানিতে জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়ানো হয়।

বাংলাদেশে পাটকে সোনালী আঁশ বলা হয়ে থাকে এবং পাট বাংলার শত বর্ষের ঐতিহ্য। সোনালি আঁশ খ্যাত পাটের কথা এখন তেমন শোনা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকায় এক সময় ধান ও পাটের চাষ বেশি হতো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী আমল থেকে বহু বছর পর্যন্ত পাট উৎপাদনে আমাদের দেশ পৃথিবীতে প্রথম স্থানে ছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পাট উৎপাদনে আমরা দ্বিতীয় স্থানে নেমে আসি। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা চক্রান্তে এ শিল্প বর্তমানে চরম অবহেলায় নিপতিত। সরকারি কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে পাটচাষির সংখ্যা ৪০ লাখ। দেশের জিডিপিতে পাট খাতের অবদান দশমিক ২৬ শতাংশ ও কৃষি জিডিপিতে ১ দশমিক ৪ শতাংশ অবদান রাখছে এই খাত।

পলিথিন বা সিনথেটিক আঁশের ক্রমাগত বিস্তারে পাটের কদর অনেকটা কমে গেছে। অনেক পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। লোকসান ও নানা জটিলতার কারণে শেষ পর্যন্ত সরকার পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল আদমজীকে বন্ধ কর দেয়। যে কয়টি পাটকল এখনো চলছে, সেগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের প্রায় রাস্তায় দেখা যায়।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের জন্য যেসব উপাদানকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়, তার মধ্যে পলিথিন অন্যতম। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পলিথিন চরম হুমকি ও বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ কারণে প্রায় দুই দশক আগে বাংলাদেশ সরকার ১ জানুয়ারি ২০০২ ঢাকা শহরে এবং ১ মার্চ ২০০২ থেকে সারা দেশে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তখন কিছুদিন পাটের (চটের) ও কাগজের ব্যাগের ব্যবহার সাময়িক সময়ের জন্য লক্ষ্য করা গেলেও প্রচার-প্রচারণা এবং মানুষের অসচেতনতার অভাবে আবার পলিথিনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

পাট পরিবেশ বান্ধব, বহুমুখী ব্যবহার যোগ্য আঁশ। শিল্প বিপ্লবের সময় ফ্লাক্স এবং হেম্প এর স্থান দখল করে পাটের যাত্রা শুরু। বস্তা তৈরির ক্ষেত্রে পাট এখনও গুরুত্বপূর্ণ। পাটের আঁশের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য অনেক আঁশের সঙ্গে মিশ্রণ করে ব্যবহার করা যায়। প্রচলিত বয়ন শিল্পে পাটের উল্লেখযোগ্য ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে সুতা, পাকানো সুতা, বস্তা, চট, কার্পেট ব্যাকিং ইত্যাদি। পর্দার কাপড়, কুশন কভার, কার্পেট, ইত্যাদি পাট থেকে তৈরি হয়। গরম কাপড় তৈরীর জন্য উলের সঙ্গে মিশ্রণ করা হয়।

কৃষি পণ্য এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি বস্তাবন্দি ও প্যাকিং করার জন্য ব্যাপকভাবে পাট ব্যবহার করা হয়। পাট খড়ি পাট চাষের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ। পাট আঁশের দ্বিগুণ পরিমাণ খড়ি উৎপাদিত হয়। ঘরের বেড়া, ছাউনী এবং জ্বালানী হিসাবে খড়ির ব্যবহার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পাটের আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে প্রসাধনী, ওষুধ, রং ইত্যাদি। বাঁশ এবং কাঠের বিকল্প হিসাবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মন্ড ও কাগজ তৈরিতেও পাট খড়ি ব্যবহৃত হয়।সম্প্রতি পাট থেকে জুট পলিমার তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন ড.মোবারক আহমেদ খান যা “সোনালি ব্যাগ” নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের অনেক এলাকায় পাটের কচি পাতাকে শাক হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয়। চট্টগ্রামে অঞ্চলে এটি ” নারিস শাক ” হিসেবে খুবই পরিচিত।

বাংলাদেশের ভূমি ও আবহাওয়া পাট চাষের জন্যে খুবই উপযোগী। এদেশের সব জেলাতেই কমবেশি পাট উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে ফরিদপুর, যশোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, জামালপুর এবং ঢাকা জেলায় অধিক পরিমাণে পাট উৎপাদিত হয়ে থাকে। ৯০ দশকে এদেশে পাট উৎপাদন হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। ক্রমশ সেই পাটের জমির পরিমাণ কমতে কমতে ৩০-৪০ বছর ধরে ৪ বা সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। পরবর্তীতে পরিবেশ সচেতনতা, প্রাকৃতিক আঁশের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির কারণে সেই জমির পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে ৭-৮ লাখে এসেছে। তবে অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে তার উৎপাদন পূর্বের তুলনায় বেড়েছে। যেখানে আগে ১২ লাখ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৬০-৬৫ লাখ বেল পাট পাওয়া যেতো, সেখানে বর্তমানে মাত্র ৭-৮ লাখ হেক্টর জমিতেই প্রায় ৮৪ লাখ বেল পাট পাওয়া যাচ্ছে। একসময় এদেশের কাঁচা পাট ছিলো বিশ্বের কাছে সর্বাধিক সমাদৃত। বাংলাদেশি কাঁচাপাট প্রধানত ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইউরোপ, আইভরিকোষ্ট, থাইল্যান্ডে রপ্তানি করা হয়। তবে পাট অধিদপ্তরের তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে কাঁচা পাট নয়, বরং পাট খাত থেকে রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগ আসে পাটজাত পণ্য থেকে যা ইউরোপ, তুরস্ক, ইরান, আমেরিকা, সিরিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, জাপান, সুদান, ঘানাসহ আরো কিছু দেশে রপ্তানি করা হয়।

২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথম দু মাস জুলাই-আগস্টে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে ১৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার আয় করে বাংলাদেশ। এই সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমত্রার চেয়ে প্রায় ১ শতাংশের মতো বেশি। গত অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করে চামড়া খাতকে পিছনে ফেলে তৈরি পোশাক শিল্পের পরের স্থান দখল করে নেয় পাট খাত।

এদিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৬৮৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার আয় করেছে। এর মধ্যে ১৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার এসেছে পাট ও পাট পণ্য রফতানি থেকে। এই দুই মাসে পাটসুতা (জুট ইয়ার্ন) রফতানি হয়েছে ১৪ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার ডলারের; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৭ শতাংশ। কাঁচাপাট রফতানি হয়েছে ১ কোটি ৯৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার; আয় বেড়েছে ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রফতানি হয়েছে ২ কোটি ৭ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। আয় বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পাট ও পাট সুতা দিয়ে হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। এছাড়া পাটের তৈরি অন্যান্য পণ্য রফতানি হয়েছে ১ কোটি ৩২ লাখ ৮০ হাজার ডলারের।

২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ মোট ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছিল। ওই অঙ্ক ছিল আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি এসেছিল ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে পাটসুতা রফতানি থেকে ৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। অর্থাৎ মোট রফতানি ৬৪ শতাংশই এসেছিল পাটসুতা রফতানি থেকে। কাঁচাপাট রফতানি থেকে আয় হয়েছিল ১৩ কোটি ডলার। পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রফতানি হয়েছিল ১০ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের। এছাড়া পাটের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য রফতানি হয়েছিল ১৯ কোটি ডলারের।

আমাদের সংস্কৃতির সাথে পাট শিল্পের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। এই শিল্প আমাদের অর্থনীতির চাকার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এদেশের লক্ষ লক্ষ কৃষকের অবলম্বন এই পাট। কর্মসংস্থান, অর্থ উপার্জন, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সর্বোপরি এই দেশের ঐতিহ্য ও নিজস্বতা রক্ষায় পাট শিল্পের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আধুনিকতার পদতলে নিষ্পেষিত যখন পুরো পৃথিবী, দূষণের ফলে বিশ্ব পরিবেশ যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তখন পাট শিল্পের যথাযথ ব্যবহার আমাদের বাঁচাতে পারে অদূর ভবিষ্যতের অনেক ভয়াবহতা থেকে। এ শিল্প আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। এ শিল্প বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পরিচায়ক। সরকারের সজাগ দৃষ্টি ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করতে হবে আমাদের এই শিল্পকে এবং ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদের গৌরবান্বিত ঐতিহ্য, নিজস্বতার ধারক এই পাট শিল্পকে।

প্রতিবেশী দেশ ভারত পাট উৎপাদনে পৃথিবীতে প্রথম এবং পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও রফতানিতেও প্রথম স্থানে রয়েছে। আমাদের সংস্কৃতির সাথে পাট শিল্পের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। এই শিল্প আমাদের অর্থনীতির চাকার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। পাট খাতকে বাঁচাতে হলে, পাট শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। পাট উৎপাদন বাড়াতে হবে, কৃষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা পাটের নায্য দাম পায়। বৃহত্তম পাটপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জুটমিলস করপোরেশনকে (বিজেএমসি) কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সর্বোপরি পাটকলগুলোর মানোন্নয়নে সরকারকে মনোযাগী হতে হবে। তবেই পাটের অর্থনীতি তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে। আধুনিকতার পদতলে নিষ্পেষিত যখন পুরো পৃথিবী, দূষণের ফলে বিশ্ব পরিবেশ যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তখন পাট শিল্পের যথাযথ ব্যবহার আমাদের বাঁচাতে পারে অদূর ভবিষ্যতের অনেক ভয়াবহতা থেকে। এ শিল্প আমাদের গর্ব, আমাদের আহংকার।

লেখক: শিক্ষার্থী

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

পাটশিল্প ও পাটশিল্পের সম্ভাবনা মুক্তমত রিফাত আমিন রিয়ন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর