Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আধুনিক ক্রীতদাস প্রথা এবং চা শ্রমিকদের শ্রমের মর্যাদা

ইমরান ইমন
২৫ আগস্ট ২০২২ ১৩:২৮

সম্প্রতি চা শ্রমিকরা তাদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে মাঠে নেমেছে। তারা যে পরিমাণ শ্রম দেয় এবং সে শ্রমের বিপরীতে যে মজুরি পায় তা এ সময়কালের জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে অত্যন্ত অপ্রতুল। তাদের বেতনের পরিমাণ শোনে অনেকের বিশ্বাস নাও হতে পারে! একজন চা শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করে ২৩-২৪ কেজি চায়ের পাতা সংগ্রহ করলে পান ১২০ টাকা। এর মধ্যে যদি দুটি পাতা আর একটি কুড়ি ছাড়া অন্য চা পাতা থাকে তাহলে সেটা গণনা হবে না। মানে গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা যদি দৈনিক ১২০ টাকা হারে তাদের মাসিক আয় হিসেব করি তাহলে মাসিক আয় দাঁড়ায় ১২০x২৬= ৩১২০ টাকা। তাও যদি প্রতিদিন ন্যূনতম ২৩ কেজি পাতা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।

এই ৩১২০ টাকাতেই চলে একজন চা শ্রমিকের পুরো পরিবারের এক মাসের খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা খরচসহ অন্য সব ধরনের সাংসারিক খরচ। মাসিক মাত্র এই ৩১২০ টাকা দিয়ে কোন ধরনের মানবেতর জীবনযাপন করা যায় তা সহজেই অনুমেয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাদের দৈনিক খাবারের খবর দেখলে রীতিমতো গা শিউরে ওঠে। চা শ্রমিকদের সকাল শুরু হয় লবণ চা আর দুটি বনরুটি দিয়ে। দুপুরের চা পাতা ভর্তা আর ভাত। সন্ধ্যায় সেই লবণ চা আর বনরুটি। রাতে আবার সেই চা পাতা ভর্তা আর ভাত। স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও আমাদের এমন দৃশ্য কি দেখার কথা ছিল?

চা শ্রমিকদের একনিষ্ঠ শ্রমের বিনিময়েই হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক এসব চা বাগানের মালিকরা। অথচ এ শ্রমজীবী মেহনতি মানুষদের শ্রমের ন্যূনতমও মর্যাদা নেই। চা এদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানীমুখী শিল্প। চা রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। আর এ অর্জিত অর্থে সচল থাকে দেশের অর্থনীতির চাকা। বিশ্বে বর্তমানে চা রপ্তানীকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬৮টি বাণিজ্যিক চা বাগান রয়েছে। যেখানে দেড় লাখেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ বিশ্বের ৩ শতাংশ চা উৎপাদন করে। ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী চায়ের বাজার মূল্য প্রায় ৩ হাজার ৫শ কোটি টাকা। জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ।

চা এদেশের ধনী, গরীব, মধ্যবিত্ত সকলেরই পছন্দের পানীয়। যে দেশের মানুষের সকাল শুরু হয় এক কাপ চা পানের মধ্য দিয়ে, চা যে দেশের মানুষের ক্লান্তি দূরীকরণের হাতিয়ার সেদেশে চা শ্রমিকরা আজ আন্দোলনে নেমেছেন মাত্র ১৮০ টাকা বৃদ্ধি করে ৩০০ টাকা বেতন নির্ধারণ করে বেঁচে থাকার অধিকারের দাবীতে। তাদের এ আন্দোলন অত্যন্ত যৌক্তিক। বরং বর্তমান সময়কালের বাজার দর অনুযায়ী তাদের এর চেয়েও বেশি মজুরি এবং সুযোগসুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যেন এসব শ্রমজীবী মেহনতি মানুষদের নিয়ে ভাবার কেউই নেই!

চা শ্রমিকদের বেতন না বাড়ার পেছনে মজুরি বোর্ড এর দায়ও কম নয়। সিলেট টুডে পত্রিকার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী: ২০১০ সালে মজুরি বোর্ড চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৪৮ টাকা নির্ধারণ করে। প্রতি পাঁচ বছর পর শ্রমিকদের মজুরি নতুন করে নির্ধারণ করার কথা থাকলেও মজুরি বোর্ড তা করেনি। তাই মালিকপক্ষের সাথে প্রতি দুই বছর পর পর চুক্তির মাধ্যমে ৪৮ টাকা থেকে ১২০ টাকায় মজুরি উন্নীত করে চা শ্রমিকরা।

সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৩ জুন দীর্ঘ ১১ বছর পর চা শিল্প খাতে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গেজেট আকারে খসড়া মজুরির ১২০ টাকা সুপারিশ প্রকাশ করে। কিন্তু এর আগেই মালিক ও শ্রমিক পক্ষের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১২০ টাকা মজুরি কার্যকর হয়েছে। তাই ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি চা শ্রমিকরা। চা শ্রমিকরা এবং তাদের সংগঠনগুলো এই খসড়ার প্রতিবাদ করে আসছেন সেই সময় থেকেই। কিন্তু তাতেও টনক নড়েনি মজুরি বোর্ড কর্তৃপক্ষের। চলতি বছর জুন মাসের শেষ দিকে মজুরি বোর্ডর সর্বশেষ মিটিংয়েও ১২০ টাকা মজুরির সুপারিশ করে মজুরি বোর্ড। মজুরি বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে আগামী ৫ বছর ১২০ টাকা দৈনিক মজুরিতে কাজ করতে হবে চা শ্রমিকদের।

এজন্য চা শ্রমিকরা এখন ন্যায্য মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে নেমেছে। তারা চায় তাদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করা হোক। চারিদিকে এখন দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি তেমন কিছুই না। কিন্তু তাও তাদের দেয়া হচ্ছে না। তাদের দেয়া হচ্ছে দৈনিক ১২০ টাকা করে। সম্প্রতি তাদের আন্দোলনে তা ১২০ টাকা থেকে ১৪৫ টাকা করা হয়েছে। মাত্র ২৫ টাকা বৃদ্ধিতে কিছু আসে যায় না। যা দিয়ে এখনকার সময়ে জীবন নির্বাহ কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা থেকেও বাড়িয়ে এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে চিন্তা করতে হবে।

এই শ্রমজীবী মেহনতি মানুষগুলো যে পরিমাণ শ্রম দেয় সে শ্রমের বিনিময়ে এই পারিশ্রমিক একেবারেই নগণ্য। অথচ এ মানুষগুলো একটা বৃহৎ শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের শ্রম-ঘাম দিয়ে। এই মানুষগুলোকে সুন্দরভাবে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার অধিকার দিতে হবে। এটা তাদের ন্যায্য অধিকার। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫১ বছর পরও দেশে শ্রমিক শোষণ কোনভাবেই কাম্য নয়। শোষণ থেকে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম তা কি আমরা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। চা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত হোক, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

আধুনিক ক্রীতদাস প্রথা এবং চা শ্রমিকদের শ্রমের মর্যাদা ইমরান ইমন মুক্তমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর