Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোহিঙ্গা ঢল; প্রত্যাবাসন শুরু কতদূর

অলোক আচার্য
২৫ আগস্ট ২০২২ ১৪:১২

দেখতে দেখতে মায়ানমার থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। এত বছরেও রোহিঙ্গাদের ফেরানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ মায়ানমার দেখাতে পারেনি। ক্রমশই রোহিঙ্গারা আমাদের দেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পরছে, মাদক দ্রব্য,অন্তর্দ্বন্দ্ব ইত্যাদি লেগেই আছে। কয়েকবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও নানা কারণে এবং মিয়ানমারের টালবাহানায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অথচ এখন তাদের ফিরে যাওয়ার দরকার। যখন প্রয়োজন হয়েছিল তখন আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। তার অর্থ এই নয় যে তাদের আজীবন ধরে রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা পৃথিবী নিজেই এক বিরাট সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি মুহূর্ত পাড়ি দিচ্ছে এই মুহূর্তে। বছর বছর রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নেওয়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের সংখ্যাও। ফলে যত বছর পার হবে তত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যা বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি করবে। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে অনেকবার উঠছে। কিন্তু কার্যকর কোনো কিছু আসেনি।

বিজ্ঞাপন

পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্য কোনো দেশে আশ্রয় নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মিায়ানমার থেকে আসা মানুষ যারা রোহিঙ্গা নামে এদেশে বসবাস করছে। আশ্রয়হীন মানুষের বড় অংশই এখন বাংলাদেশে বসবাস করছে। মিয়ানমারের এই হত্যাজজ্ঞের সময় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু আশা ছিল যে এই সৃষ্ট সমস্যাটির একটি কার্যকর সমস্যা আন্তর্জাতিক মহল করবে। এখনো কার্যত এই সমস্যার কোনো টেকসই সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পারেনি আন্তর্জাতিক মহল। এই বিপুল সংখ্যাক রোহিঙ্গা ভবিষ্যতে কোথায় থাকবে, তাদের সন্তানদের ভাগ্যে কি ঘটবে এ বিষয়ে সিন্ধান্ত নেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় পার হচ্ছে। মাঝে মধ্যে রোহিঙ্গা নিয়ে কিছু কথা শোনা গেলেও মূল সমাধান অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না।

বিজ্ঞাপন

এদিকে ক্রমেই এ দীর্ঘ বিষয়টি আর দীর্ঘতর হচ্ছে। আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে বিশ্বে আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে। আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এদের ভবিষ্যত কি হবে তার অস্থায়ী সিদ্ধান্ত হলেও স্থায়ী সমাধান হয়নি। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যুটিও এরকমই একটি আপাত অমিমাংসিত ইস্যু। যেখানে রোহিঙ্গা ফেরত যাওয়ার কথা তাদের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। রোহিঙ্গারা যেখানে আশ্রয় নিয়েছে সেই উখিয়া, টেকনাফ এবং ভাসানচর থেকেও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তারা কেউ কেউ সাগর পারি দিয়ে অন্য দেশে যাওয়ারও চেষ্টা করছে। সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের নৌকাডুবির ঘটনা ঘটছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় তারা প্রবেশে চেষ্টা করছে।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাটি ছিল মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। এখন তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেওয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বের মধ্যে পরে। সূ চি সরকার এখন ক্ষমতায় নেই। এখন ক্ষমতায় রয়েছে সামরিক সরকার। গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় না থাকলেও জান্তা সরকারের সাথেই ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে এবং কাজে লাগাতে হবে আঞ্চলিক যোগাযোগ। কারণ বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা নিয়ে যে ইস্যু তৈরি হয়েছে তা সমাধান করতে হলে এর বিকল্পও নেই। ২০১৭ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়ংকর সহিংসতা শুরু করার পর থেকে রোহিঙ্গারা ধর্ষণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। মানবতার দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় প্রদান করে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪ টি ক্যাম্পে এসব রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়। তারপর থেকেই এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয়ে রয়েছে। রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেওয়ায় প্রায় আট হাজার একরের বেশি বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। যা আমাদের পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যর ওপর প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আমাদের কৃষিজমির ওপরও চাপ সৃষ্টি হতে পারে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও তা শুরু করা যাচ্ছে না।

এদিকে রোহিঙ্গা শিবিরে মাদক, সন্ত্রাস নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে গোলাগুলি এবং নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিভিন্ন সংস্থার বেসরকারি তথ্যমতে, পাঁচ বছরে ক্যাম্পে ১২০টির বেশি হত্যাকান্ড ঘটেছে। রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতি বছর জন্মগ্রহণ করছে বহু শিশু। তাদের বড় হয়ে ওঠার জন্য একটি স্থায়ী পরিবেশ অর্থাৎ তাদের মাটির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অর্ন্তদ্বন্দ্ব ও সংঘাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বছর যাওয়ার সাথে সাথে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পাবে। তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনিশ্চয়তা, কর্মসংস্থানের সংকটে নিজেদের মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে ফেলাসহ বিভিন্ন সমস্যা দীর্ঘতর হচ্ছে। এই অনিশ্চয়তার আশংকা ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট। তবে এর সমাধানে শিঘ্রই কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। বরং সমস্যা দীর্ঘতর হচ্ছে। রোহিঙ্গারা পালানোর চেষ্টা করছে। তাদের যারা সাহায্য করছে তারা এক শ্রেণির দালাল। তাদের সহায়তায় রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বিভিন্ন শ্রমমূলক কাজে যুক্ত হচ্ছে। এ সংখ্যা বাড়ছে। এসব রোহিঙ্গা কোথায়? কারণ ঝুঁকির বিষয় হলো এদের লোকালয়ে মিশে যাওয়ার মতো ঘটনা।

এদের মধ্যে অনেকের অপরাধে জড়িয়ে পরার ঘটনা উদ্বেগ তৈরি করছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সে কাজে গতি আসেনি। মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ ইস্যু সামনে চলে আসায় যেটুকুও অগ্রগতি হয়েছিল সেটুকুও আড়ালে চলে যায়। রোহিঙ্গাদের সেখানে ফেরা এবং নিরাপত্তা এই দুই বিষয় নিশ্চিত না করলে তাদের সেখানে যেতেও আগ্রহী করা যাবে না। রোহিঙ্গারা অনিচ্ছুক এই কারণে তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। কিন্তু এখানে কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসে। তাহলো কেন রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরত যেতে ইচ্ছুক নয়? নিজ বাসভূমে ফিরে যাওয়ার ব্যপারে রোহিঙ্গাদের ভেতর আস্থা কে তৈরি করবে? সমস্যার শুরু করেছে মিয়ানমার। তাহলে সমাধানও তাদেরই করতে হবে। তবে রোহিঙ্গাদের জন্য নিজ দেশে উপযুক্ত নিরাপদ পরিবেশ মিয়ানমার তৈরি না করতে পারলে এবং রোহিঙ্গাদের বিশ্বাস অর্জন করতে না পারলে তাদের ফেরানো কষ্টকর। কারণ অনিশ্চিত গন্তব্যে তারা যেমন যাবে না আবার তাদের সেখানে পাঠানোও যাবে না। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, চীনসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা বিশ্বের অন্যান্য দেশের। কারণ এই সমস্যাটি মানবিক বিপর্যয়ের একটি বড় উদাহরণ এবং বিশ্বের উচিত হবে তাদের নিজ বাসভূমে নিরাপদে পৌছে দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করা। রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সবসময়ই ইতিবাচক ছিল। এখনও আছে। মানবিক কারণেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে। তবে দিন যাওয়ার সাথে সাথে রোহিঙ্গা নিয়ে বহুমুখী সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, রোহিঙ্গা গ্রুপগুলোর মধ্যে অর্ন্তদ্বন্দ্ব এবং আরো ভয়ংকর মাদকের বিস্তার।

একটি রাষ্টের যে দায়িত্ব ছিল তা মায়ানমার পালন করেনি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব দেশে বসবাসরত সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মিয়ানমার তা করেনি। তার পরিবর্তে রাখাইনে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর এই নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে গাম্বিয়া। এটি ছিল আইনিভাবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি বিশাল অর্জন। কিন্তু প্রত্যাবাসন যেন শুরু হয় হয় করেও শেষপর্যন্ত শুরু হয়নি। রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বারবারই ঝুলে থাকছে। রোহিঙ্গারা নিরাপদ পরিবেশ না পেলে ফিরে যেতে ইচ্ছুক না। এই নিরাপদ পরিবেশ কতদিনে মিয়ানমার তৈরি করতে পারবে তা আদৌ নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ দেশটিতে এখন গণতান্ত্রিক পরিবেশই নেই। যখন সেই পরিবেশ ছিল তখনই কায়ক্রমে কোনো অগ্রগতি হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিষয়টি দীর্ঘায়িত হবে। এখন অপেক্ষা এবং কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার ছাড়া কোনো সমাধান রাতারাতি আসবে বলে মনে হয় না। মিয়ানমারে নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে তারা ফিরতে পারে। আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মিয়ানমারের উপর রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার চাপ আন্তর্জাতিকভাবে অব্যাহত রাখতে হবে।

লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অলোক আচার্য মুক্তমত রোহিঙ্গা ঢল; প্রত্যাবাসন শুরু কতদূর

বিজ্ঞাপন

কলকাতায় অভিষেক হচ্ছে অপূর্ব’র
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:২৮

তানজিব-অবন্তীর নতুন গান
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:২২

আরো

সম্পর্কিত খবর